ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

যুগে যুগে বাংলার বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৭ মার্চ ২০২০

যুগে যুগে বাংলার বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

বর্তমান আমরা যে বাংলাদেশে বসবাস করি, তা কিন্তু চিরায়ত বাংলা নয়। প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা যে চিরায়ত বাংলার সীমানা পাই তা হলো- উত্তরে গিরিরাজ হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে মায়ানমার, পশ্চিমে বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও এই বাংলার সীমানা অখ- ছিল না। তখন এটা পু-্রবর্র্ধন ও দ-ভুক্তি নামে দুটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। পু-্রবর্র্ধনভ্ুিক্তর রাজধানী ছিল পু-্রবর্ধন যা বর্তমান বগুড়া জেলার অন্তর্গত মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। আর দ-ভুক্তির রাজধানী মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত ছিল। গুপ্তযুগে এই ভুক্তি দু’টি ভেঙ্গে বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল, রত্নদীপ নামে ছয়টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার দুইশত বছর পূর্বে মধ্য এশিয়া থেকে আর্য নামে এক যাযাবর জাতি, পু-্রবর্ধন তথা বাংলাদেশে আগমন ঘটে। তারা (পু-্রবর্ধন) এদেশের জনগণের উপর অকথ্য অত্যাচার ও আগ্রাসন চালায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এটাই ছিল সম্ভবত বাঙালী জাতির উপর সর্বপ্রথম বৈদেশিক আক্রমণ। বাঙালীর স্বাতন্ত্র্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শোচনীয়ভাবে তারা এই আর্য জাতির নিকট পরাজিত হয়। অনুমান করা হয়, এটাই বাঙালী জনতার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎপত্তির বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য, কলাকৌশলে, সামরিক শক্তিতে আর্যরা সে সময়ে অনেক উন্নত ছিল। এর কারণেই পরবর্তীতে তারা আর্য জাতির নিকট পর্যুদস্ত ও পরাজিত হয়। আর্যরা এদেশ দখল করে তৎকালীন অনার্য জনগণকে দস্যু, অসুর প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদেরকে দেবজাতি বলে প্রচার করতে শুরু করে। আর্র্যদের পরে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে শক্তিশালী পুরুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। পুরু বীরবিক্রমে প্রাণপণে যুদ্ধ করে আলেকজান্ডারের নিকট পরাজিত ও বন্দী হন। আলেকজান্ডার বাংলা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলে তদানীন্তন শক্তিশালী বাংলার সামরিক বাহিনীর উন্নত যুদ্ধের কলাকৌশল ও শৌর্যবীর্যের পরিচয় পেয়ে বীরবিক্রম বঙ্গরাজের নাম শুনে পিছু হটতে বাধ্য হন। এরপর ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে, বর্তমান মেসোপটেমিয়া বা ইরাকে আলেকজান্ডার মৃত্যুমুখে পতিত হন। এরপর বাংলার তুর্কী ও পাঠান শাসনের উদ্ভব হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী রাজা লক্ষ্মণ সেনকে বিতাড়িত করে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। শিরিন খলজী, আলী মর্দান খলজী, গিয়াস উদ্দীন ইওয়াজ খলজী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে খলজী শাসনের অবসান হয় এবং ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৬০ বছরের পরিক্রমায় বাংলা দিল্লীর অধীনে চলে যায়। এই দীর্ঘ ৬০ বছরে বাংলা ১৬ জন শাসনকর্তা দ্বারা শাসিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলার এই দীর্ঘ ৬০ বছরের ইতিহাস অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও গৌরবম-িত। এই শাসকদের অনেকের মুখে দিল্লীর স্বাধীনতা স্বীকার করলেও কার্যত বাংলা প্রায় স্বাধীনই ছিল। দিল্লী থেকে বাংলার দূরত্ব দীর্ঘ এবং বর্ষাকালে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত ও দুর্গমতার জন্য বাংলার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্রোহ দেখা দিতো। ঘন ঘন বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার জন্য বাংলাকে বলা হতো ‘বুলগ্রাকপুর’ বা বিদ্রোহী নগরী। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তুর্কী জাতি ক্রমে ক্রমে সমগ্র বঙ্গ জয় করে স্বাধীনভাবে বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুর্কী শাসনামলে ১৬ জন গবর্নর বাংলা শাসন করে বলে ইতিহাসবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেন। অবশ্য উল্লেখ করতে হয় কেন্দ্র ও বাংলার শাসনকর্তা মূলত সবাই ছিলেন সে সময় তুর্কী জাতি। তৎকালীন বাংলার শাসনকর্তার সেই ১৬ জন গবর্নরের নাম ও পরিচিতি তুলে ধরা হলো- ১) বখতিয়ার খলজী [১২০৪ খ্রিস্টাব্দ], ২) শিরিন খলজী, ৩) আলী মর্দান খলজী, ৪) গিয়াস উদ্দীন ইওয়াজ খলজী, ৫) নাসির উদ্দীন মাহমুদ [১২২৭-১২২৯ খ্রিস্টাব্দ], ৬) মালিক বলখ খলজী [১২২৯-১২৩০ খ্রিস্টাব্দ] ৭) নশরত শাহ বিন মওদুদ [অল্প দিন], ৮) মালিক আলাউদ্দীন জানী [১ বছর], ৯) সাইফ-উদ-দীন আইবক [৩ বছর], ১০) আওর খান [অল্প দিন], ১১) তুগরল তুগান খান [১২৩৬-১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ], ১২) ওমর খান কিয়ান [১২৪৫-১২৪৭ খ্রিস্টাব্দ], ১৩) মালিক জালাল উদ-দীন-মাসুদ [১২৪৭-১২৫১ খ্রিস্টাব্দ], ১৪) মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন ইউজবেক [১২৫১-১২৫৭ খ্রিস্টাব্দ], ১৫) ইজ্জ উদ-দীন বলখ ই-ইউজ-বলকী [১২৫৭ খ্রিস্টাব্দ] এবং ১৬) তাজ উদ্দীন আরসালান [১২৫৭-১২৬৫ খ্রিস্টাব্দ মৃত্যু]। এরপর ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে বলবন, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। বলবনী শাসনের অধীনে বাংলার গবর্নর ছিলেন যথাক্রমে- ১) তাতার খান [১২৬৫-১২৬৮ খ্রিস্টাব্দ], ২) শের খান [১২৬৮-১২৭২ খ্রিস্টাব্দ], ৩) আমীন খান [অল্পদিন], ৪) তুগরল খান [১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ] এবং ৫) নাসির উদ্দীন মাহমুদ বুগরা খান [১২৮১-১২৮৮ খ্রিস্টাব্দ]। বুগরা খান সত্যিকারভাবেই বাংলা ও বাংলার মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালবেসেছিলেন বলেই জীবনে অনেক মূল্যবান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এমনকি তিনি বাংলার মসনদ ছেড়ে দিল্লীর সিংহাসনে বসতে রাজি হননি। বুগরা খান বাংলায় কখন মৃত্যুবরণ করে তা আজও জানা যায়নি। বুগরা খানের পুত্র সুলতান রুকুন উদ-দীন কায়কাউস [১২৯১-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ] পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার খলজী, তুর্কী, মালিক এবং বলবনী সুলতান ও গবর্নরগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলায় প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য লালায়িত ছিলেন। ভারতে মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স¤্রাট জহিরুদ্দীন বাবর। বাবরের আমলে বাংলা বিজিত হয়নি। বাবরের পুত্র বাদশাহ হুমায়ুন ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ গৌড় দখল করেন, কিন্তু কনৌজের যুদ্ধের পর শেরশাহ বাংলার মুঘল শাসক জাহাঙ্গীর কুলিকে পরাজিত করে বাংলাকে শূর সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ। চুনার দুর্গ দখল করতে যেয়ে বারুদের আগুনে পুড়ে শেরশাহ মারা যান অকস্মাৎ। শেরশাহ মারা যাবার কিছু দিন পরেই এই শুর সা¤্রাজ্যে পতন ঘটে। আকবর বাংলা জয় করেন ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে। বাংলা আবার মুঘল সা¤্রাজ্যভুক্ত হয়। স¤্রাট আকবরের সময় সমগ্র বঙ্গদেশ ‘সুব-ই-বঙ্গাল’ নামে পরিচিত হয়। স¤্রাট আকবর শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বৃহত্তর বাংলাকে ১৯ টি সরকারে বিভক্ত করেন। তখন বাংলার রাজধানী ছিল রাজমহল। মুঘলদের হাত থেকে বাংলার স্বাধীনতা পুনঃরুদ্ধারের জন্য দাউদ খান কররানী ও বারভুঁইয়া এবং তাদের নেতা ঈশা খাঁ বহুদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে ছিলেন এবং বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য মুঘলদের বিরুদ্ধে তারা প্রচ- প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদের সেই সময় এই বাংলায় সৈন্যদল ও নৌবহর ছিল। ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল ঢাকার অদূরে সোনারগাঁও নামক স্থানে। অনেক সময় তারা একজোট হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। কিন্তু বিশাল মুঘল বাহিনীর সাথে তারা কিছুতেই পেরে উঠতে পারেনি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাংলার সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলাকে নামে মাত্র দিল্লীর অন্তর্ভুক্ত রেখে প্রায় স্বাধীনভাবে রাজকার্য পরিচালনা করেন। বাংলার রাজধানী ছিল তখন মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সারা বাংলাকে ১৩ টি চাকলায় বিভক্ত করেছিলেন। মুর্শিদ কুলি খাঁর পর বাংলার নবার হন তার নিজ পুত্র সুজাউদ্দৌলাহ তদ্বীয় পুত্র সরফরাজ খান ও পরবর্তীতে আলীবর্দী খান। আলীবর্দী খানের সুশাসনে প্রজারা বাংলায় সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন। তার আমলে বাংলার বিখ্যাত বর্গীর হামলা হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে সময় বর্গী হামলা মোকাবেলা করেন। বাংলা থেকে বর্গীদের চিরতরে পর্যুদস্ত, পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে তার কোন ঔরসজাত পুত্রসন্তান না থাকায় বিহার, উড়িষ্যার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান সিরাজউদ্দৌলাকে। এ সময় সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন পর্যন্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর সিংহাসনের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ১৪ মাস ১৪ দিন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ জাতি পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে প্রহসনের যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করেন। ইতিহাসের কালানুক্রমিক অনুসঙ্গ এসেছে বাঙালীর বিদ্রোহের সোপান বেয়ে। ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলমান ছিল বাংলাদেশে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যার নাম দিয়েছিলেন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। অতঃপর মেদিনীপুরে আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৭৮৩ খ্রি.), কুমিল্লার কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৭-১৭৬৮ খ্রি.), সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯, ১৮১৯, ১৮৭০ খ্রি.), তাঁতি বিদ্রোহ (১৭৭০-১৭৮০ খ্রি.), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭ খ্রি.), নীল বিদ্রোহ (১৭৭৮-১৮০০ খ্রি, ১৮৩০-১৮৪৮ খ্রি, ১৮৫৯-১৮৬১ খ্রি.)। এভাবে একে একে লবণ চাষী বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪ খ্রি.), রেশম চাষী বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০ খ্রি.) রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮১-১৭৮৩ খ্রি.), যশোহ, খুলনার কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৪-১৭৮৬ খ্রি.), বীরভূম কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৫-১৭৮৬ খ্রি.), বীরভূমে বাকুড়ায় আদিবাসী বিদ্রোহ (১৭৮৯-১৭৯১ খ্রি.), বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ (১৭৯২ খ্রি.), ময়মনসিংহ গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২ খ্রি. ১৮৩৭-১৮৮২ খ্রি.), ময়মনসিংহ কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২-১৮৩০ খ্রি.), মহাবিদ্রোহ যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত (১৮৫৭ খ্রি.), পলাশী পরবর্তী ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সেই হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য বাঙালী জাতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটা ছিল সে সময় আধুনিক বাংলার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। কিন্তু যুদ্ধে তিনি জয়ী হতে পারেননি। ইংরেজদের প্রহসনের বিচারে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, এবং বর্তমানে মায়ানমারের রেঙ্গুনে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। তাঁর স্ত্রী জিনাত-উন-নেসাসহ তাঁর সমাধি আজও রেঙ্গুনে বিদ্যমান রয়েছে। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস ইংরেজরা তার দুই পুত্রকেও প্রকাশ্য দিবালোকে দিল্লীর রাজপথে গুলি করে হত্যা করে। দৃপ্তমুক্ত আলোর আজাদীর সংগ্রামে বাংলার রাজপথ বারবার হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। পরবর্তীতে সুন্দরবন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ হয় (১৮৬১ খ্রি.), সিরাজগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-১৮৭৩ খ্রি.), কুমিল্লার কৃষক বিদ্রোহ (১৯২৮-১৯৩১ খ্রি.), কিশোরগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৩০ খ্রি.) এবং তেভাগা কৃষক বিদ্রোহ জ্বলে উঠে (১৯৪৬-১৯৪৭ খ্রি.)। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ভারত ত্যাগ করলে দিল্লী ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে দ্বিখ-িত করে ভারত ও পাকিস্তান ভুক্ত করে নেয়। প্রায় দীর্ঘ ২০০ বছর পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে চিরতরে ইংরেজ শাসনের অবসান হয়। পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত হলো কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ধীর ধীরে বাঙালীদের মধ্যে প্রচ- অসন্তোষ ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে এগিয়ে যায়। এর পরেই এলো সেই অগ্নিঝরা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২৬ মার্চের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলে। দেশকে স্বাধীন করার জন্য চলে মরণপণ স্বাধীনতার যুদ্ধ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশবিক অত্যাচারের কবল থেকে মুক্তির জন্য চলে আপসহীন স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধ। ২৫ বছর ব্যাপী শোষণ, বঞ্চনা, এক যুগব্যাপী সামরিক শাসনের প্রতিবাদে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও মানসিক জাগরণ আবর্ত হয়ে এক মোহনায় প্রবেশ করেছিল বাঙালীর স্বাধীনতার ডাক সেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের স্মৃতি অমর হোক। সেই সাথে যুগে যুগে এই বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের যেসব বীর শহীদরা অকাতরে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদেরও আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে যে গৌরব আমাদের অর্জিত হয়েছিল তা যেনো চিরকাল এই বাংলায় অটুট থাকে।
×