ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক গুণীজনের প্রস্থান

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ২৬ মার্চ ২০২০

এক গুণীজনের প্রস্থান

বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর একজন স্বনামখ্যাত শিক্ষক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, লড়াকু সাহসী ব্যক্তিত্ব এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী প্রাজ্ঞজন। ২৩ মার্চ ২০২০ সোমবার ৮৪ বছর বয়সে গুলশানের নিজ বাসভবনে এই বিশিষ্ট গুণী ব্যক্তিত্ব চিরবিদায় নেন। আবহমান বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করা এই শিক্ষাবিদ দীর্ঘ জীবনের পথ পরিক্রমায় শৈল্পিক জগতকে যেমন অসামান্য সৃষ্টিসম্ভার উজাড় করে দেন, পাশাপাশি বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামী অভিগমনেও অবদান রাখতে কখনও পিছপা হতেন না। নিজের যাপিত জীবনের অভাবনীয় দার্শনিক, নান্দনিক ও মানবিক সত্তায় বাংলা ও বাঙালীকে যে অবিস্মরণীয় ভাব সম্পদ উপহার দিয়ে গেছেন, সেখানে তিনি একজন কীর্তিমান সৃজন ও মননসাধক। দেশের পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই পুরোধা শিল্প ব্যক্তিত্বের চির প্রয়াণে নেমে আসে শোকের ছায়া। জাতি হারাল এক মুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন শৈল্পিক যোদ্ধাকে। দেশের ও আপন ঐতিহ্যের প্রতি একান্ত দায়বদ্ধতায় সমকালীন সমস্ত ঘটনা, আন্দোলন ও জাতির চরম দুঃসময়ে তাঁর ক্ষুরধান লেখনী যেভাবে পথনির্দেশকের ভূমিকায় অনবদ্য হয়ে ওঠে, তা এক দেশবরেণ্য চিন্তানায়কের যুগান্তকারী সৃষ্টিদ্যোতনা। ১৯৩৬ সালের ৯ জানুয়ারি চাঁদপুরে জন্ম নেয়া এই প্রাজ্ঞজন অল্প বয়স থেকেই তাঁর লেখনীসত্তার বিকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর গবেষণায় পিএইচডি অর্জন করা এই শিক্ষাবিদ পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে অসংখ্য শিক্ষার্থীর পথ চলার বাতিঘর হয়ে আজও তাদের জীবনে আলো বিকিরণ করছেন। আর সৃষ্টিশীল ভুবন দ্যুতিময় করা এই বিচক্ষণ প্রাজ্ঞজনের মননশৌর্য বাংলা সাহিত্যের ভা-ারকে যে মাত্রায় পূর্ণ করেছে, তা স্পষ্ট হয়ে আছে তার সুচিন্তিত অভিব্যক্তিতে। মনন চেতনার ভাবসম্ভারে কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, আলোচনা, পর্যালোচনা সবই এই নিপুণ কলমযোদ্ধার নান্দনিক মহিমায় পাঠকদের সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে। অসংখ্য চিন্তাশীল ও গবেষণা গ্রন্থের নির্মাতা বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সামাজিক আন্দোলনকেও নানামাত্রিকে উজ্জীবিত করেছেন। বিশেষ করে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও সংগঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরও একজন অগ্রগণ্য সহযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৬৮ সালেই অর্জন করেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো ও ফ্রান্স সরকার কর্তৃক অলঙ্কৃত হন ফল অব অনার। ২০০৫ সালে পান কলকাতার মুজাফফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার। শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে ২০০৯ সালে তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। জীবনব্যাপী সমস্ত অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এই লেখক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরও একজন মুক্তমনা সৈনিক ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়ায় আমাদের বৃহত্তর সামাজিক বলয় এক ন্যায় ও আদর্শনিষ্ঠ কর্মবীরকে হারাল। যারা জাতির বিপন্ন সময়ে কাণ্ডারির ভূমিকায় নেমে আলোকিত পথনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের প্রতি অন্তর নিঃসৃত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
×