ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু, ২৫ মার্চ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৫ মার্চ ২০২০

বঙ্গবন্ধু, ২৫ মার্চ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের রক্তস্নাত ২৫ মার্চের কালরাত। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, গাজী গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য নেতাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রায় সারাক্ষণ নিচের লাইব্রেরি রুমে বসেছিলেন। সেদিন সবার চোখে-মুখে ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই মুখে সেনাপতির সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সবার সঙ্গে আলাপ করছেন। এরই মাঝে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য ছাত্র ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ এবং নির্দেশ দিয়ে এক এক করে বিদায় দেন। রহস্যের ব্যাপার, সেদিন খন্দকার মোশতাক আহমেদকে কখনও দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর বন্ধুরা তাঁকে ঢাকা ছেড়ে যেতে সম্মত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল। আমি যদি সেখানে না থাকতাম তবে আমার খোঁজে ইয়াহিয়া খান গোটা শহর জ্বালিয়ে দিত।’ বঙ্গবন্ধু বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তাঁর জীবনে গ্রেফতার কোন নতুন বিষয় ছিল না। তাঁকে বহুবারই কারাগারে আটক করা হয়েছে। কিন্তু সামরিক শাসকদের চক্রান্ত সব সময়ই ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে। এবার তারা তাঁকে মেরে ফেলতেও পারে, তবে সেটা তাঁর কাছে গৌণ ব্যাপার ছিল। একটি দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পালিয়ে যেতে পারেন না। সে রাতে এত উত্তেজনার মাঝেও বঙ্গবন্ধু শান্তভাবে পাইপ টানছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁর যা কিছু করণীয়, সবই তিনি করেছেন। ইতোমধ্যে সারা পূর্ববঙ্গের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তিনি বাঙালী জনগণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে ফেলেছেন। শুধু গ্রেফতার কেন, যে কোন পরিস্থিতির জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে একটি দেশের জন্মের প্রসববেদনার সময় আঁতুড়ঘরে ফেলে কি কখনও কোন জনক চলে যেতে পারে? উদ্ধৃত ঘটনা এবং কথার মধ্য থেকে বোঝা যায় জনকের দায়িত্ববোধ, চূড়ান্ত ঈড়সসরঃসবহঃ, সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং ঝুঁকি নেয়ার অসম সাহস। একা একটা মানুষ পাকিস্তান নামক একটি রক্তপিপাসু সামরিক জান্তার দেশের মুখোমুখি। তাঁকে উড়িয়ে দিতে পারত, নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারত- এসব কিছুই ভাবেননি তিনি। তিনি প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন তেইশ বছরের তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্বাধীনতার গর্ভপাতÑগোলা-বারুদ, আগুন, কান্না আর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এটি কেবল সম্ভব ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষেই। ‘কায়হান ইন্টারন্যাশনাল’ পত্রিকার সাংবাদিক আমির তাহেরি একাত্তরের জুলাই মাস নাগাদ জেনারেল টিক্কা খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন কেন? টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, স্যার শুনুন, শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন।’ আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনি। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। সাংবাদিক আরও জানতে চাইলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে যেতেন তবে সেক্ষেত্রে আপনি কি করতেন স্যার? উত্তরে টিক্কা খান বলেছিলেন, আমি খুব ভাল করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তাঁর জনগণকে পরিত্যাগ করবে না। আমি গোটা ঢাকা শহরে তাঁকে খুঁজে বেড়াতাম এবং একটি বাড়িও তলাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তাঁর মতো অন্য নেতাদের গ্রেফতারের কোন অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তাঁরা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন। জেনারেল টিক্কার এই উক্তি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধুই তাদের চিন্তার প্রধান কারণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের ঘটনা সম্পর্কে মেজর সিদ্দিক সালেক তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন ‘যখন প্রথম গুলিবর্ষণ করা হয় তখন রেডিও পাকিস্তানে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবের কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হলো পূর্বে রেকর্ডকৃত বাণী। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন। কয়েক মিনিট পর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর তার বেতার কণ্ঠ শুনতে পেলেন (বিগ বার্ড ইন দ্য ফেজ)। ২৫ মার্চ রাতে যখন প্রায় বারোটা বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল, বঙ্গবন্ধুর পার্সনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদ টেলিফোন ধরলে ওপাশ থেকে বলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে বলেন মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে। মেশিন নিয়ে কি করব? তখন বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোরশেদকে বললেন যে, ওই ব্যক্তিকে বল মেশিন ভেঙ্গে সে যেন পালিয়ে যায়। লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়ার করেস্পন্ডেন্ট ডেভিড লোশাক, যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ভাষণটি উল্লেখ করেন, তিনি লিখেছিলেন যে, গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল এবং যাতে মনে হচ্ছিল খুব সম্ভবত ওটা আগেই রেকর্ড করা ছিল। পাকবাহিনী ট্রান্সমিটার খুঁজতে ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশনের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলী নূরুল হকের ওয়্যারলেস কলোনির বাসা ঘেরাও করে এবং ২৯ মার্চ তাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে তেইশ বছর ধরেই বাঙালীর জাতির চেতনাকে উজ্জীবিত করার জন্য এবং বাঙালীর সার্বিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুকে দিনের পর দিন নিরলস আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছে। আর তার ফলে শাসকগোষ্ঠী বরাবর তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবেই অভিযুক্ত করেছে। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তিনি একই কথা শত-সহস্রবার উচ্চারণ করে বলেছেন- ‘আমরা আমাদের অধিকার চাই-রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সমতা। শুধু মুখের ভাষা প্রকাশের অধিকারই নয়Ñ একটা গোটা জাতিকে তিনি মুক্ত করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নাগপাশের বন্ধন থেকে। বঙ্গবন্ধুর বিদ্রোহী সত্তার উন্মেষ কোন আকস্মিক ঘটনার ফলশ্রুতি নয়। তার শৈশব কৈশোরের দিনগুলো এমন একটি সময়ে কেটেছে যখন বাংলার আকাশে-বাতাসে অসন্তোষের বহ্নি ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। বাংলার মানুষের চোখে মুখে বিদ্রোহের অগ্নি ছিল সংগুপ্ত। দেশের একটা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর যৌবনে এই প্রধূমায়িত বিদ্রোহের লক্ষণগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ধীরে ধীরে জাগ্রত হয়েছে। তবে এই সত্তার একটি স্বতন্ত্র রূপ ছিল, ছিল স্বতন্ত্র নির্যাস। তাঁর বিদ্রোহের মধ্যে হঠকারিতা ছিল না, ছিল না ধ্বংসাত্মক মনোভাবের কোন প্রতিফলন। বুদ্ধদেব, গান্ধীজী, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বিদ্রোহ করে গিয়েছিলেন সেই ঐতিহ্যই বঙ্গবন্ধুর বিদ্রোহী সত্তায় লালিত। অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনই ছিল বঙ্গবন্ধুর বিদ্রোহী সত্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি সকল সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। বস্তুত অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের তিনি এক সাক্ষাত প্রতিমূর্তি। বাংলাদেশের মাটি থেকে ধর্মান্ধতার বিষ অপসারিত করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় তিনি এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির সকল স্বপ্ন/ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে ফেলেছিল। তাঁর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও বাবার আদর্শকে আঁকড়ে ধরে রেখে আবার বাঙালী জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। দেশবাসী আশা করে, জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক সামাজিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সুশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলবে, যেখানে দেশবাসী নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়ে তোলায় উদ্বুদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন আমাদের রাজনীতির বড় পাথেয়। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×