ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যাকারীদের বিচারের আন্দোলনের পুরোগামী নেতা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২৫ মার্চ ২০২০

গণহত্যাকারীদের বিচারের আন্দোলনের পুরোগামী নেতা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

সমগ্র বিশ্ব যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ আতঙ্কে হতবিহ্বল, এমন সময় জাতীয় গণহত্যা দিবসের দুদিন আগে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন বাংলাদেশের বরেণ্য লেখক, গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের আন্দোলনের পুরোগামী নেতা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। মানববিদ্যার সকল শাখায় অবাধ ও স্বচ্ছন্দ তাঁর বিচরণ। গদ্য-পদ্যে সিদ্ধহস্ত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে তাঁর অনুজ লেখকরা বলি- তিনি লেখকদের লেখক, বুদ্ধিজীবীদের ভেতর সর্বাগ্রগণ্য। শিল্প ও সাহিত্যের জগতের বাইরে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্ববৃহৎ নাগরিক আন্দোলন অবধি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার আন্দোলনের বাইরে নাগরিক সমাজের আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত নির্মাণ করেছেন তিনি। সিভিল সোসাইটির ধারণা আমরা গ্রহণ করেছি ইউরোপ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যখন গ্রামসি, রাসেল ও সার্ত্রদের সমাজচিন্তা চেতনার জগতে বিপ্লব এনেছে, বাংলাদেশে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আমাদের নাগরিক আন্দোলনের পরিসরে এর প্রতিস্থাপন করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তাত্ত্বিক ভিত নির্মাণে যে সব শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাঁদের অন্যতম বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আমরা যারা এই আন্দোলনের সংগঠক ও কর্মী আমাদের আলোকিত করেছেন তিনি। পাকিস্তানের কলোনিকাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বদা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তিনি। তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, ব্যক্তিগত নিবন্ধ, এমনকি কবিতায়ও নানাভাবে সামরিক শাসনের শবব্যবচ্ছেদ করেছেন। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার আমল থেকে জিয়া-এরশাদ-খালেদা এবং সর্বশেষ ফখরুদ্দিন-মঈনদের সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের সকল প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের বয়স পাঁচ দশক অতিক্রম করেছে। বন্ধু মুনতাসীর মামুনের পিতৃব্য হওয়ার কারণে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তাঁর সংস্পর্শে এসেছি। অগ্রজ জহির রায়হানের বন্ধু ছিলেন তিনি। যে কারণে মামুনের চাচা হলেও আমি তাঁকে ভাই সম্বোধন করতাম। আমার সমবয়সী ও অনুজদের কাছে তিনি বোরহান স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রুটিনে তিনি বিকেলে। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর এটা অবধারিত হয়ে গিয়েছিল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সমবয়সী কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাধীনতার দাবিকে জনপ্রিয় করতে হবে। বেবী মওদুদ আমাদের নেতা ছিলেন। তার স¤পাদনায় আমরা ছাত্ররা সাপ্তাহিক ‘রানার’ বের করেছিলাম ’৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে। ট্যাবলয়েড আকারের ‘রানার’-এর লোগো তৈরি করে দিয়েছিলেন শিল্পী রফিকুননবী। গেরিলা যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী জেনে এর কলাকৌশল আমরা নিজেরা লিখতাম। হো চি মিন, চে গুয়েভারা, ফ্যানন থেকে আরম্ভ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। ‘রানার’-এ তখন ‘মলোটভ ককটেল’ বানাবার কৌশলও ছেপেছিলাম বিপ্লবী বারীন ঘোষ আর পান্নালাল দাশগুপ্তের লেখা থেকে। অগ্রজদের অনেকে আমাদের কর্মকাণ্ডকে বালখিল্য মনে করলেও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ‘রানার’-এ নিয়মিত লিখতেন। স্কেচ আঁকতেন ভাষাসৈনিক শিল্পী মূর্তজা বশীর। ’৭১-এর মার্চে রানার-এ প্রকাশিত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের একটি লেখার প্রথম বাক্যটি এখনও মনে আছে- ‘এখন একটাই দাবি : স্বাধীনতা।’ ততদিনে স্বাধীনতার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে, ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, ঘরে বসে থাকার সময় নেই- আঠারো থেকে একুশের কিছু তরুণকে এভাবেই অনুপ্রাণিত করেছিলেন বোরহান ভাই। মুক্তিযুদ্ধকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সাইক্লোস্টাইলে ছেপে ‘প্রতিরোধ’ বের করেছিলেন, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল ‘রানার’-এর তরুণরা, যারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের ভেতর নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছিল। অনেকে উগ্রপন্থার দিকেও ঝুঁকেছিলেন। ’৭২-এর প্রথম দিকে আমাদের বন্ধু বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রথম সাধারণ সম্পাদক কবি হুমায়ূন কবির নিহত হলেন। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তরুণ লেখকদের কয়েকজন হুমায়ূন কবিরকে হত্যার জন্য রক্ষী বাহিনীকে দায়ী করলেন। বন্ধুর হত্যাকাণ্ডে আমরা ক্ষুব্ধ ছিলাম। আমি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করি। বোরহান ভাই আমাকে ডেকে বললেন, হুমায়ূন কবিরের হত্যার জন্য সরকারকে দায়ী করা ঠিক হচ্ছে না। তাকে হত্যা করেছে তার নিজের দলের লোক, বাইরের কেউ নয়। এভাবে তিনি প্রকৃত অভিভাবকের মতো আমাদের বহু বিভ্রান্তি থেকে দূরে রেখেছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা যখন ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের ঘোষণা প্রদান করি, তখন এর উদ্যোক্তা ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের অন্যতম ছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আমাদের ঘোষণায় বলেছিলাম, সরকার যদি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার না করে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত গঠন করে তার বিচার করব। নির্মূল কমিটির এই উচ্চাভিলাষী ঘোষণা সারাদেশে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বোরহান ভাই তখন বলেছিলেন, এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করতে হবে। বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী লীগ যদি এই কর্মসূচী সমর্থন না করে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ক্ষমতায় তখন জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত খালেদা জিয়ার বিএনপি, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। নির্মূল কমিটির ঘোষণা যখন প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন দেশের বাইরে। বোরহান ভাইয়ের অগ্রজ মিসবাহ উদ্দিন খান তখন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তাঁকে বলে বোরহান ভাই আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সঙ্গে আমাদের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। যা না হলে খালেদা জিয়ার সরকারের যাবতীয় হুমকি ও ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে গণআদালতে ’৭১-এর ঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার সম্ভব হতো না। গণআদালতের কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমরা শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের বিচারকম-লী গঠন করেছিলাম। ৩০ লাখ শহীদ পরিবারসহ বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতির পক্ষে অভিযোগ উত্থাপনের জন্য আমরা তিনজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীকে নির্বাচন করেছিলাম, যাঁদের অন্যতম অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। গণআদালতে অপর দু’জন অভিযোগকারী ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। এই গণআদালত গঠন, এর কার্যক্রম এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ‘গণআদালতের পটভূমি’ গ্রন্থে আমি বিস্তারিত লিখেছি। সরকারের হুমকি ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের জন্য এর ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করেছিল। এই ২৪ জনের তালিকায় ছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরসহ মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়করা এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা। মামলার শুনানিতে উচ্চতর আদালতের বিচারক সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন, যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন তারা কিভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী হন? খালেদা জিয়ার বিএনপির বিবেচনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টারা রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ববিরোধী, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী দেশপ্রেমিক! এত বছর পেরিয়ে গেছে, ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য শেখ হাসিনার সরকার দশ বছর আগে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতাদের বিচার করে দণ্ডও প্রদান করেছে- বিএনপির জামায়াতপ্রেমে একটুও ভাটা পড়েনি। ১৯৯২-এর ৩ মার্চ শহীদজননী জাহানারা ইমামের প্রথম জনসভায় আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন- ক্ষমতায় এলে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে তিনি তা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩’-এর অধীনে ২০১০-এর ২৫ মার্চ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শেখ হাসিনা তাঁর কথা রেখেছেন। গত দশ বছরে এই ট্রাইব্যুনালে প্রায় একশ’ গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীর বিচার হয়েছে, যাদের অধিকাংশ জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের হাতে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা পতাকা তুলে দিয়ে, তাদের মন্ত্রিসভায় বরণ করে পাকিস্তানপ্রেমী খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির অপরাধে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে অন্তরীণ। ’৭১-এর গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে যখন জামায়াতের শীর্ষনেতাদের গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল খালেদা জিয়া তখন বলেছিলেন, এদের রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে বিএনপি নেতারা এখন বলেন, খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে কারাগারে রাখা হয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। এর পাশাপাশি মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিরলসভাবে লিখেছেন তিনি। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার নিয়ে জামায়াত-বিএনপি দেশে ও বিদেশে কম অপপ্রচার করেনি। এসব অপপ্রচারের বিরোধিতা করে বিচারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে তিনি অবিরাম লিখেছেন। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ নামক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- ‘জাহানারা ইমাম এবং তাঁর সহযোগী যোদ্ধারা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষরা বিচার এবং ন্যায়বোধকে একটি ব্যবস্থার মধ্যে গ্রথিত করে একটি আন্দোলনকে দশ দিগন্তব্যাপী ব্যাপ্তি দিয়েছেন। সে হচ্ছে হত্যা মনুষ্যত্ববিরোধী অপরাধ এবং মনুষ্যত্ববিরোধী অপরাধের বিচার সভ্যবোধেরই প্রকাশ। বিচার যদি কোন ব্যবস্থায় না হয় সে ব্যবস্থার প্রতিরোধ করা বৈধ। এই বোধটিই সভ্যতার বোধ এবং এই সভ্যবোধ বাংলাদেশে প্রবর্তন করার জন্য জাহানারা ইমাম লড়াই করেছেন। এই বোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই গণআদালতের প্রবর্তনা। সেজন্যই খালেদা জিয়ার রাষ্ট্রশক্তি তাকে এবং আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ‘জাহানারা ইমাম ঠিকই ধরেছেন যারা রুমীকে হত্যা করেছে, তারাই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে, তারাই নূরজাহানদের হত্যা করে চলেছে। হত্যা যাদের নেশা এবং হত্যার রাজনীতি যাদের মতাদর্শ সেই শক্তি হচ্ছে পাপ এবং সেই শক্তিকে মেনে নেয়া যায় না। যে শক্তি ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে উৎসারিত, যে শক্তি নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করে এবং মানুষ হত্যা যে শক্তির মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার প্রথম শর্ত, সেই শক্তি অন্ধ এবং বর্বর এবং সভ্যতাবিরোধী। যুদ্ধের সময় এই শক্তি রুমীদের হত্যা করে এবং যুদ্ধপরবর্তী সময় এই শক্তি সিভিল রাজনীতিকে হত্যা করে, এই শক্তি নূরজাহানাদের হত্যা করে। ধর্মান্ধতা বর্বরতা এবং বর্বরতা সভ্যতা বিনাশী, সেজন্য সভ্যতাবিনাশী মতাদর্শের সঙ্গে সহাবস্থান হয় না। ‘জাহানারা তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এই বোধটি তুমি আমাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছ। হত্যার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করে যাব এবং লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমরা রাষ্ট্রদ্রোহীরা ফের রাষ্ট্রের দখল নেব ন্যায় এবং বিবেক এবং বিচার প্রবর্তনের জন্য। জাহানারা তোমার বাগান থেকে তুমি আমাকে ফুল তুলে দিতে, সেই ফুল হাতে করে তোমার মুখের দিকে আমি এবং আমরা অনন্তকাল তাকিয়ে আছি। তোমাকে ঘিরে থাক আমাদের ভালবাসা।’ ’৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ অনেক বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে এক দশক অতিক্রম করেছে। এই বিচার চলমান থাকবে শেষ যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর বিভিন্ন লেখায় বলেছেন সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠার জন্য এই বিচার প্রয়োজন। ব্যক্তির পাশাপাশি এখন প্রয়োজন গণহত্যাকারী সংগঠন এবং পাকিস্তানী হাই কমাণ্ডের বিচার এবং গণহত্যার রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্যও আমাদের লড়তে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলন ও সংগ্রামে আমাদের প্রেরণার অফুরন্ত উৎস বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। ২৪ মার্চ ২০২০
×