ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অতিক্রান্ত জন্মদিন এবং জনকের মুখ

প্রকাশিত: ১১:৫৯, ২৪ মার্চ ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অতিক্রান্ত জন্মদিন এবং জনকের মুখ

আমি তখন ষোলো বছরের তরুণ। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফলের জন্য অপেক্ষায়। খেলাঘরের সহ-সভাপতি হলেও মূলত ছড়াকার আর কবিতা মকসো করি। যৌবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো আমাদের চোখে তখন অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা। দেশ তখন যত অনগ্রসর আর দরিদ্র হোক না কেন, আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমাদের নেতাই পারবেন সবকিছু সামাল দিতে। এতবড় একজন মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কখনও আসেননি, আসবেনও না। অনেকে বলেন বিশেষত অপপ্রচারকারীরা বলে বেড়ায় শেষদিকে নাকি তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছিল। আমি বলছি পঁচাত্তরের এপ্রিল মাসের কথা। এদের কথা যে কতটা মিথ্যা, আমি তা চোখে দেখেছি। তিনি যাবেন বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধনে। রাস্তাজুড়ে মানুষের উল্লাস আর কি অধীর চাওয়া। এখনকার মতো ছিল না বাংলাদেশ তখন। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিরাট তফাত। তারপরও মানুষ নিয়ে এসেছিল তাদের প্রাণের উপঢৌকন। যার যা ছিল তাই নিয়ে এসেছিল তারা। সবজি দিয়ে বানানো মালা, ফুলের মালা, নিজের বাগানের সদ্যজাত কোন ফসলÑ কিছুই বাদ ছিল না। নেতা আসবেন। মানুষের নেতা। সকাল থেকে দাঁড়িয়েছিলাম এনায়েত বাজার বরফকল এলাকায়। তিনি আসবেন আগ্রাবাদ হয়ে কদমতলী পেরিয়ে। সময় যায় কিন্তু তাঁর দেখা মেলে না। এপ্রিলের কড়া রোদে মাথা ঘুরে পড়ার মতো অবস্থা। একপর্যায়ে ফিরে গিয়েছিলাম ব্যর্থ মনোরথ হয়ে। কিন্তু বাসায় কি মন টেকে? আবার এসে দাঁড়িয়েছিলাম তীর্থের কাকের মতো। নেতা আসবেন বলে, আমাদের প্রাণের নেতা। মনে আছে, দুপুর গড়ানোর আগেই তিনি এসেছিলেন। কিন্তু যে গাড়িটিতে তিনি থাকার কথা সে গাড়ির মাথা ফুঁড়ে বের হলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মনসুর আলী। তিনি মাথা বের করে দেখলেন জন¯্রােত। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গনগনে সূর্যের মতো পরের গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন তিনি। কথা বলতে পারছিলেন না নেতা। কিছুদিন আগেই বিদেশ থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন। গলার স্বর ভেঙে গেছে। কথা বলা বারণ। তবু কি মানুষ তা মানে? আজ এত বছর পর পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় একজন মানুষ, একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য বাঙালীর এমন আকুলতা ছিল স্বপ্নের মতো। এমনটি আর হয়নি, হবেও না। তাঁকে ছুটে গিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দিল আমাদের বন্ধু বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী মেজবাহ। সেই চিরচেনা গোঁফের ফাঁকে মৃদু হাসি। মানুষটি গড়পরতা যে কোন বাঙালীর চাইতে দীর্ঘকায়। তিনি না ঝুঁকলে তাঁর গলায় মালা পরানোর সাধ্য কার? মাথা নিচু করেই মালা পরলেন একটি দুটি করে শ খানেক। তারপর গাড়িতে ঢুকে গেলেন তিনি। কিন্তু মানুষ কি তা মানে? তারাও ছুটল পেছন পেছন। সে ভিড় স্রোতের মতো, ঢেউয়ের মতো ছুটে এসে থামল চট্টগ্রাম কলেজের সামনে। সেখানে হাজার ছাত্র জনতা ঘিরে ধরেছে নেতাকে। তারা তাঁর কথা শুনবেই। হোক তা কেবলই একটি বাক্য। নেতা আমাদের তেমনই যিনি জানেন কখন কোথায় কি বলতে হবে। আমাদের সেই বজ্রকণ্ঠ প্রাণভোমরা নেতা আবারও তাঁর পাইপ হাতে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চারপাশে তাকিয়ে আওড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, চারদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ ইতিহাস... তারপর? নেতা তো ছুটলেন। গাড়ির বহর তাঁকে নিয়ে চলল বেতবুনিয়ার দিকে। আর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ভাসতে লাগল জয় বাংলা ... জয় বাংলা...। সে ঘটনার পর খুব বেশিদিন বাঁচতে দেয়া হয়নি তাঁকে। খুব স্বল্প আয়ুর একটি জীবন। অথচ কি বিশাল আর কি ব্যাপক। আপনি তাঁর ছবিগুলো দেখুন। তাঁর কথা শুনুন। বুঝতে কষ্ট হবে না এই মানুষের ভয় বলতে কিছু ছিল না। আপোস দুর্নীতি বা সমঝোতা এখন যে সব শব্দ মানুষ ঘৃণা করে, যেগুলো রাজনীতিকে কলুষিত করে, সেগুলোর জন্ম হয়েছে তিনি চলে যাবার পর। আমি ভাবি আর কষ্ট পাই এমন একজন মানুষকে এত নৃশংসভাবে হত্যা করাও সম্ভব ছিল? পাকিস্তানের কারাগার থেকে যখন দেশে ফেরার জন্য লন্ডনে গেলেন দেখবেন, তাঁর চেহারা বা আদলে একফোঁটা উদ্বেগ নেই। কি আত্মবিশ্বাসী আর কি মনোবল। দেশ তখন টিকবে কি টিকবে না এ নিয়ে কত কূটতর্ক। আমেরিকা চীন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বিরুদ্ধে। আমেরিকার ছায়াসঙ্গী বিলেত। আর তিনি কথা বলছিলেন সে দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে। এতটুকু বিচলিত নন তিনি। বসার ভঙ্গি থেকে পাইপ ধরাতেই বুঝে যাবেন কি তাঁর ভাবমূর্তি। সে ইমেজ আমরা ভারত ভ্রমণেও দেখেছি। লৌহমানবী নামে পরিচিত ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাবলীল। দিল্লীর ময়দানেও তিনিই মূল আকর্ষণ। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁকে এমনই দেখেছে দুনিয়া। আর কোনদিন এমন কোন নেতা জন্মাবে কি-না বলা মুশকিল। বেঁচে থাকলে শতবর্ষে পা দিতেন বলে এই বছরটিকে নাম দেয়া হয়েছে মুজিববর্ষ। তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলেই ডাকে বাংলার মানুষ। কত ষড়যন্ত্র, কত জঘন্য অপপ্রচার আর কত কুৎসা। সব আজ ভেসে গেছে। কাউকে কিছু করতে হয়নি আসলে। সময় নিজেই তার জবাব দিয়েছে। কিভাবে সময় দেশের রাখালকে বলবে দেশের রাজা? কিভাবে সময় এই মানুষটি ও তাঁর প্রিয় চার বন্ধু সহকর্মীর রক্ত এড়িয়ে মেনে নেবে অপ ইতিহাস? তাই সময় তার জবাব দিয়েছে সময়মতো। অথচ এখনকার নেতাদের আস্ফালন আর উল্লাস দেখলে মনে হবে তারাই তাঁকে পুনরুদ্ধার করে এনেছেন পাদ-প্রদীপের আলোয়। আজ তাঁর শততম জন্মদিনে এসব কথা বলে মন খারাপ করব না। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে। এদের আচার আচরণের কোথাও তিনি নেই। বরং দেখে শুনে মনে হয়, তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল...। তিনি এসবের অনেক বাইরে অনেক ওপরে। তাঁকে যেমন কেউ কলুষিত করতে পারবে না, তেমনি তাঁকে নতুন করে চেনারও দরকার পড়ে না। যতদিন বাংলা বাঙালী যতদিন বাংলাদেশ ততদিন তিনি আছেন তিনি থাকবেন। আমরা দেখি না বলে এটা মিথ্যা না যে তিনি আসেন না। এই যে শততম জন্মবার্ষিকী, তিনি কি একবার হলেও এসে দাঁড়াবেন না। আজও মেঘের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। চোখে পুরুকাঁচের চশমা। একহাতে পাইপ। বাতাসে ভেসে যাচ্ছে এরিন মোর তামাকের মিষ্টি সুবাস। চশমাটা একহাতে খুলে নিচে তাকাতেই চোখ দুটো আবেগে ভালবাসায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। মানুষের ভালবাসায় ভেসে যাওয়া শ্যামল মাটিতে পদ্মার ঢেউয়ে আকাশে উড়ে যাওয়া পায়রার দিকে তাকিয়ে একবার মানুষের কাছে নেমে যাওয়ার খুব ইচ্ছে হয় তাঁর। পা বাড়াতেই বুক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে যান তিনি। গলগল করে ছুটে আসা বুলেট বিদ্ধ বুকের রক্তধারা রুখে দেয় তাঁকে। তিনি দেখেন রক্তের ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে। তারপরও তিনি দুহাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গীত ভরসা দিতে দিতে মিলিয়ে যান আকাশের আরও গভীরে, আরও গোপন কোন স্তরে। আপনাকে কোনদিন ভুলব না আমরা বঙ্গবন্ধু। আপনি যে আমাদের পিতা। [email protected]
×