ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও জাতীয় শিশুদিবস

প্রকাশিত: ০৭:২১, ২৩ মার্চ ২০২০

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও জাতীয় শিশুদিবস

২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। একই দিন জাতীয় শিশু দিবস। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে জাতীয় শিশু দিবস উদযাপন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ রকম দিন এখনকার প্রজন্মের জীবনে আর আসবে না। তাছাড়া ১৯৯৭ সাল থেকে জাতীয় শিশু দিবস পালন করা শুরু হলেও বঙ্গবন্ধুকে নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ এ প্রজন্মের হয়েছে গত ১১ বছরে। তারা জেনেছে, স্বাধীনতার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালবাসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে আজকের শিশুদেরই। তাই শিশুরা যেন সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে- তিনি সব সময়ই তা প্রত্যাশা করতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মাটির মানুষ ও সাধারণ মানুষের নেতা। এ জন্য তাঁর সহজ-সরল আচরণ শত্রু-মিত্র সকলকে আকৃষ্ট করত। মানুষের কল্যাণের জন্য নিবেদিত ছিলেন তিনি আজীবন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর জন্মদিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। কারণ তিনিও শিশুদের ভালবাসতেন। বিশে^র সকল মহামানব শিশুবান্ধব ছিলেন, শিশুদের প্রিয় ছিলেন। মহান নেতা হয়েও, রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ততা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কখনও তাঁর শিশুপুত্র রাসেলকে আদর করতে ভোলেননি। কোথাও যেতে তিনি রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। শিশু রাসেলও তাঁকে খুব ভালবাসত। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লিখেছেন, রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত। আব্বাকে মোটেও ছাড়তে চাইত না। তিনি আরও লিখেছেন, ‘রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো যেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহূর্ত যেন আব্বাকে কাছ ছাড়া করতে চাইত না। সব সময় আব্বার পাশে ঘুরে বেড়াত।’ শিশুরা সুন্দর স্বপ্ন দিয়ে তাদের নিজস্ব জগত নির্মাণ করে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর রাজনৈতিক জীবন স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেছিলেন। শিশুদের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে তারই আলোকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, শিশু হাসপাতাল ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এ ছাড়া শিশুদের জন্য আরও নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিশুদের প্রিয়জন। শিশু-কিশোরদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’। ১৯৬৩ সালে ঢাকা প্রেসক্লাবে আয়োজন করা হয় দশ দিনব্যাপী শিশুমেলা। ওই শিশুমেলায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হাল্কা করার জন্য।’ শামসুজ্জামান খান স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- ‘১৯৬৩ সালে শেখ সাহেবকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ও কাছে পাওয়ার সুযোগ ঘটে। আমরা ওই বছরে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার উদ্যোগে ঢাকাস্থ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে এক শিশু-কিশোর আনন্দমেলার আয়োজন করি। সেই মেলায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি আগ্রহসহকারে আসেন এবং মেলার প্রদর্শনী ও স্টল পরিদর্শন করেন। আনন্দমেলার নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় দেখাশোনার জন্য কচি-কাঁচার মেলার সদস্যদের নিয়োগ করা হয়। পুলিশ বা শান্তিবাহিনী, গোয়েন্দা- সবই ছিল কচি-কাঁচার মেলার সদস্য। শেখ সাহেব যখন প্রদর্শনী দেখছিলেন তখন তাঁর কাছ থেকে মেলার গোয়েন্দা বাহিনী একটি লোককে আটক করে। তার চেহারা উসকো-খুশকো, গায়ে একটি কাঁথা জড়ানো। ক্ষুদে গোয়েন্দারা তার দেহ তল্লাশি করে তার কাছে মেলার একটি ম্যাপ ও কিছু কাগজপত্র পায় এবং পরে দেখা যায় ক্ষুদে গোয়েন্দারা যাকে পাকড়াও করেছে সে সরকারের আসল গোয়েন্দা। শেখ সাহেবের পিছু নিয়ে আনন্দমেলায় ঢুকেছে। শেখ সাহেব সরকারী গোয়েন্দাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘চান্দু, এখানেও আমার পিছু নিয়েছÑ শিশুদের সঙ্গে একটু আনন্দ করব তাতেও ফেউ লাগিয়ে রেখেছে সরকার। যা মাফ করে দিলাম।’ পরে দাদা ভাইয়ের দিকে ঘুরে বললেন, দাদা ভাই, আপনার গোয়েন্দারা সরকারী গোয়েন্দাদের ওপর টেক্কা দিয়েছে, শাবাশ!’ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর মার্চ মাসে রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধা’য় উপস্থিত হন। সঙ্গে ছিলেন ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন ও লুৎফুল হায়দার চৌধুরী। শিশুদের আঁকা ছবিগুলো বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন, ‘আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটু খানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালবাসা পাবে।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেন। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে করেন বাধ্যতামূলক। ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে করা হয় জাতীয়করণ। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এর ১৫ বছর পর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ তৈরি করে। বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের অন্যতম অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। গ্রহণ করা হয়েছে জাতীয় শিশু নীতি ২০১১, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শিশু নীতিকে আরও যুগোপযোগী করতে ঘোষিত হয় শিশু আইন ২০১৩। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়। পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। পরিত্যক্ত শিশুদের সেবা ও ভাতা প্রদান, পথশিশুদের পুনর্বাসনসহ তাদের জীবনমান উন্নত করতে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। শিশু শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে স্কুল টিফিন, শিশুর জন্য নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন কার্যক্রম। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে করা হয়েছে জনকল্যাণমুখী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের ‘মহাকবি’, তিনি বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টিতে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’। তাঁর ছিল দুর্নিবার গ্রন্থপ্রীতি। তিনি ছিলেন সচেতন পাঠক। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন ম্যান্ডেলা, জন এফ কেনেডি, ফিদেল ক্যাস্ত্রো প্রমুখ রাজনৈতিক নেতার মতো যখনই অবসর পেতেন তখনই তিনি বইয়ের বিচিত্র জগতে হারিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু যে প্রচুর শিল্প-সাহিত্যের বই পড়তেন তা তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রবার্ট পেইন দেখেছেন, জর্জ বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনাবলি, মাও সেতুং স্বাক্ষরিত গ্রন্থ। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণকালে একই গাড়িতে করাচী আসার পথে উর্দুভাষী কয়েক পাকিস্তানীকে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃঃ ২১৭) ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের শান্তি সম্মেলনে যোগদান করে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃঃ ২২৮) ১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকদের রুদ্র রোষে ২৪টি মামলায় ১৮ বার জেলে নিক্ষিপ্ত হন শেখ মুজিব। তিনি সর্বমোট ১২ বছর জেল খেটেছেন। আর দশ বছর কড়া নজরদারিতে ছিলেন। জেলবন্দি নিঃসঙ্গ জীবনেও বই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। ২১ ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল থেকে বঙ্গবন্ধু একটি চিঠি লিখেছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে। সেই চিঠিটি তৎকালীন সরকার বাজেয়াফত করলেও গবেষকরা পরবর্তী সময় উদ্ধার করেন। সেই চিঠিতে আছে- Last October when we met in the Dacca Central Jail gate, you kindly promised to send some books for me. I have not yet received a book. You should not forget that I am alone and books are the only companion of mine. (নিরীক্ষা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১২, প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মায়ের অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পর পর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলোতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যতœ করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মায়ের সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বইকেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলো ওরা (পাকিস্তানীরা) নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ওই বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ হাসিনা : শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৪, পৃঃ ৭০-৭১) বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কেবল সাধারণ মানুষ কিংবা কৃষক-শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন না তিনি ছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবে স্বীয় শ্রেণীর শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তা ছাড়া পূর্বেই বলা হয়েছে তিনি সাহিত্যের একজন অনুরাগী পাঠক ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন- ‘শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে-কোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’ (আতিউর রহমান, ‘বাঙালী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু’, শোকাশ্রু, বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদ, ২০১৫, পৃঃ ৩০) ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর পরই বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করে ঢাকায় আনেন। ১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় কবির বাসায় যাবার সময় ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর থেকে বের হয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে পথ হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধু। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র সূত্র অনুযায়ী আব্বাসউদ্দিনের ভাটিয়ালি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। এই কণ্ঠশিল্পীর বাংলা ভাষা রক্ষার আকুতিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে অবদান রাখেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হয়েও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন- ‘এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।’ (দৈনিক ইত্তেফাক ১৬/২/১৯৭১) তার আগে ৯ জুন ১৯৬৯ সালে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাংবাদিক ‘মানিক ভাই’ প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন- ‘তিনি ছিলেন এক সর্বক্ষণিক প্রেরণা। অতি বড় দুর্দিনেও তাঁর ওপর আমরা ভরসা রাখতে পেরেছি। কাছে গিয়ে সাহস ফিরে পেয়েছি। তিনি নিষ্ঠাবান সংগ্রামী ছিলেন। সংগ্রামীদের তিনি ভালবাসতেন।’ (বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম, সম্পাদক ড. মোহাম্মদ হাননান, পৃঃ ১৩) বেবি মওদুদ লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুটিকে বিজয় লাভের পর পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সব রকম সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ (সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও শেখ মুজিব, নিরীক্ষা, জুলাই-আগস্ট ২০১৩) বঙ্গবন্ধুর সময়ে কয়েকটি দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদও ছিলেন কোন না কোন পত্রিকা বা রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। মহাত্মা গান্ধী নিউ ইন্ডিয়া, মতিলাল নেহরু ইন্ডিপেনডেন্ট, মাওলানা মোহাম্মদ আলী কমরেড, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বেঙ্গলি, জওয়াহরলাল নেহরু ন্যাশনাল হেরাল্ড, অরবিন্দ ঘোষ বন্দেমাতরম, সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড, বিপিন চন্দ্র পাল ইয়ং ইন্ডিয়া, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নারায়ণ, ফজলুল হক কৃষক ও নবশক্তি পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন নতুন দিন, ইত্তেহাদ, ইত্তেফাক, মিল্লাতসহ কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সবসময়ই কাছে পেয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের। জসীম উদদীন, সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, হাশেম খান, সমরজিত রায় চৌধুরী প্রমুখ কবি ও চিত্রশিল্পী এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক ছবি রয়েছে। ১৯৭৩ সালে ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের মাঝেও তাঁকে দেখা গেছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন- ‘মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী।’ এ জন্য তাঁদের প্রতি তাঁর প্রাণের টান এতো। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতিচারণ’-এ আছে, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্মথ রায়কে বাম পাশে ও তাঁকে দক্ষিণ পাশে বসিয়ে সেদিন নানা অন্তরঙ্গ কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি অসুস্থ কবি হুমায়ূন কাদির, আবুল হাসান ও মহাদেব সাহাকে সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন, মস্কো, লন্ডন প্রেরণ করেন এবং একটি কবিতা লেখার জন্য দাউদ হায়দারকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা এবং নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কবি আল মাহমুদকে জেল থেকে মুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি ছিলেন নাটকের একজন সুহৃদ। টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর ও সেন্সর প্রথা সহজ করেছিলেন নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তাঁর অবদান ছিল। প্রাদেশিক পরিষদে এফডিসির বিল উত্থাপন করেন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল। তখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ছিল চলচ্চিত্র বিষয়ক দফতর। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয় বাংলাদেশের ১৮ এবং ভারতের ৪ জন বিশিষ্ট শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতার কর্মীকে। অর্থাৎ কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি যুক্ত করেছিলেন শিক্ষক-প্রকৌশলী ও পেশাজীবীদের, শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রশাসনের সঙ্গে রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্থ ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার পঙ্ক্তি- ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, / রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করনি’ এবং ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি’ এবং ‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস’ তাঁর কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল বেশি। তাঁর অন্তর দখল করে রেখেছিলেন বিশ্বকবি। রাজনৈতিক জীবনে দুঃখ-দৈন্য-সঙ্কটে আবৃত্তি করতেন- ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা’ কিংবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...’ বহুল পরিচিত চরণসমূহ। জেলে যাবার সময় ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে তুলে নিতেন। বোঝা যায় একমাত্র সঙ্গী বা অনুপ্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বাজাত্যের যে চেতনা বাঙালী কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালীর সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালীর রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোন দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে সকালের নাস্তা সারতেন। এক স্মৃতিচারণে মাহবুব তালুকদার টুঙ্গিপাড়ার সফরসঙ্গী হিসেবে সকালে ঘুম থেকে উঠে বঙ্গবন্ধুকে নৌযানে বসে নদীর দু’পাড়ের গ্রাম-বাংলার দৃশ্য দেখে আবৃত্তি করতে শুনেছিলেন- ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/ গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি’ রবীন্দ্র পঙ্ক্তিমালা। জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি ১৯৫৬ সাল থেকেই তাঁর উদ্যোগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে ঠিক করে ফেলেন সোনার বাংলা গড়ার। গানটি সর্বত্র প্রচারে শেখ মুজিবের সক্রিয় ভূমিকার কথা জানিয়েছেন প্রফেসর ড. সনজীদা খাতুন। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ মে ২০০৫) অর্থাৎ শিল্প-সংস্কৃতির একজন অনুরাগী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের গভীর সম্পর্ক ছিল। এ জন্য ১৫ আগস্টের (১৯৭৫) হত্যাকান্ড রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সঙ্গে অভিঘাত রাখে শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিদের চেতনায়। পরবর্তীতে তাঁরা তাঁদের লেখনীতে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। মূলত জাতিকে এই হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে প্রেরণা যুগিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য সমাজের ব্যক্তিবর্গ। বঙ্গবন্ধুর শিল্প সংস্কৃতি ভাবনায় শিশু এবং দুঃখী মানুষের কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে। লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বিস্তর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ে ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়। ১৯৭২ সালের ১-৫ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে সেখানকার নেতৃবৃন্দের জন্য উপহার হিসেবে তিনি নিয়ে যান- কচি-কাঁচার মেলার শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম। রাজনীতি করে যেমন গরিব কৃষক ও শ্রমিকের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন, তেমনি শিল্প-সংস্কৃতির চেতনাসম্পন্ন উপযুক্ত জাতি গঠনে নিবেদিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির অমর কবি বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার অঙ্গীকার পরবর্তীকালে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা ভুলতে পারেননি। দেশ পরিচালনায় খুব কম সময় পেলেও তাঁর আত্মবলিদান প্রেরণার শতধারায় উৎসারিত এখনও। তাঁকে আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী করে তুলেছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা- সৃষ্টি হয়েছে কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, চিত্রকলা। আদর্শের মৃত্যু নেই যেমন কবি পাবলো নেরুদা লিখেছেন- ‘কোন কোন রক্তের দাগ কিছুতেই শুকাবার নয়।’ বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। প্রেরণার উৎসে মহীরুহ তিনি। এ জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের জাগরণ হলো। বিনা দ্বিধায় আমরাও বলে উঠলাম, ওই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যতদিন লড়াই চলবে, ততদিন আমরাও সঙ্গে আছি। বাঙালী হিসেবে আমরাও সহযোদ্ধা।’ (আমরা কি বাঙালী, পত্রভারতী, কলকাতা, পৃঃ ১৪৩) ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেয়া মন্মথ রায় লেখেন (আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন স্মরণিকা) ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অবলম্বনে লিখিত আমার দুটি নাটক এক. স্বাধীনতার ইতিহাস, দুই. আমি মুজিব নই- গ্রন্থ দুটি তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে ধন্য হতে পেরেছিলাম।’ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ১০ ধারায় মৃতব্যক্তির মাহাত্ম্য প্রচার নিষিদ্ধ করে এক ঘোষণা দেয়া হয়। ফলে ২১ বছর ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৬ থেকে পুনরায় ব্যবহৃত হতে থাকে শব্দটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার যুগ শুরু হয়। একই সঙ্গে জাতীয় শিশু দিবসের প্রচলনও সেই আমল থেকেই। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×