ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এমরান চৌধুরী

একাত্তরের এক কিশোর

প্রকাশিত: ০৭:২১, ২১ মার্চ ২০২০

একাত্তরের এক কিশোর

‘এক্ষুণি তুমি আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাও।’ কমান্ডারের আচমকা নির্দেশে ক্যাম্পের অন্য মুক্তিযোদ্ধার চোখ কপালে ওঠে। সবার বুকের ভেতর একটা প্রশ্ন দলা পাকাতে থাকে। এই ছোট ছেলেটা আবার করল কি? তবে কার সাহস হয় না বাদশার অপরাধ কি তা জানার। সবাই নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে একবার চোখ ফেলে কমান্ডারের ওপর, আরেকবার বাদশার প্রতি। বাদশা এ ক্যাম্পের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক মাসের মাথায় সে অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয় সীমান্তের এক ট্রেনিং সেন্টারে। মাত্র দু’সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে সে হয়ে ওঠে পুরোদস্তর একজন যোদ্ধা। রাইফেল থেকে শুরু করে আস্ত মেশিনগান পর্যন্ত চালনা শিখে ফেলে সে অল্প সময়ে। বয়সে সবে কৈশোর পেরোলেও শারীরিক গঠনে বাদশা ছিল যেমন প্রকৃত বাদশার মতো তেমনি সাহসী। এ কারণে কমান্ডার তাকে পাঠিয়েছিল টিলাগড় চা বাগান অপারেশনে। কিন্তু অপারেশনের আগেই সে ঘটিয়ে বসে এক অঘটন। খবরটি দ্রুত কমান্ডারের কানে গিয়ে পৌঁছে যায়। ফলে বাদশাকে অপারেশন থেকে প্রত্যাহার করা হয়। নির্দেশ দেয়া হয় ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবার। নির্দেশ শুনে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বাদশা বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার।’ ‘ক্ষমা, জানো তুমি কত বড় অপরাধ করেছ?’ মুহূর্তে কমান্ডারের চোখ দুটো টুকটুকে লাল মরিচের মতো হয়ে যায়। ‘আমার ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর কখনও এমনটি হবে না।’ ‘যে একবার ভুল করে, সে বার বার ভুল করতে পারে। তাই তোমার কোনো ক্ষমা নেই।’ ‘আমাকে আরেকবার সুযোগ দিন স্যার! আমি কথা দিচ্ছি আর কখনও এমন হবে না।’ ‘না, তা হবার নয়। মনে আছে! তোমাকে কেন চা বাগানে পাঠানো হয়েছিল?’ ‘জি, স্যার। দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।’ ‘আর তুমি কী করলে? চা শ্রমিকদের সঙ্গে মিলে খেলে ছাইপাশ। তারপর শুরু করলে মাতালমি। শুধু মাতলামি নয়, নিজের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করলে নিজের মানুষদের। আর একটু হলে তো খুন করে ফেলতে নিজেদের লোককে। তোমার জানা নেই এ রকম অপরাধের কি সাজা হতে পারে?’ বাদশা মাথা নিচু করে বলল, ‘না স্যার।’ ‘অনেক বড় দন্ড। অনেক বড় শাস্তি।’ উচ্চৈঃস্বরে বললেন কমান্ডার। বাদশা তাঁর অপরাধ যে কত বড় তা বুঝতে পারল। ফলে সে বিষম লজ্জিত হয়ে অবনত মস্তকে কমান্ডারের সামনে সটান দাঁড়িয়ে থাকল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বাদশা থাকত ঢাকায় বাবার সঙ্গে। বাবার রিক্সা গ্যারেজে। তারও আগে সে থাকত সিলেটে মামার বাড়িতে। মামার বাড়িতে থেকে সে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বছরখানেক আগে তার বাবা রহিম মিঞা মনে করল, মাতৃহীন ছেলেটাকে নিজের কাছে এনে রাখলেই ভাল হয়। গরিবের ছেলে পড়াশোনা করলেও কতটা আর পারবে? তার চেয়ে এই স্বাধীন কাজটা শিখে রাখলে ভবিষ্যতে কাজ দেবে। যেখানেই থাকুক দু’মুঠো ভাতের চিন্তা অন্তত করতে হবে না। সেই ভাবনা থেকে রহিম মিঞা ছেলেকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। রহিম মিঞার গ্যারেজটা ছিল ওই এলাকার বড় গ্যারেজ। বাবার সঙ্গে বাদশাও রিক্সার ছোটখাটো সমস্যা সারিয়ে দিত। এই যেমন, চাকায় পাম্প দেয়া, লিকেজ দেখা, স্পোক ভাঙ্গা কি না দেখা, থাকলে নতুন লাগানো ইত্যাদি। তাদের গ্যারেজে নানা কিসিমের লোকজন আসত। ভাল লোক, মন্দ লোক সবাই থাকত এদের দলে। গ্যারেজে রিক্সাচালকদের পরিবার, ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলোচনা হতো তেমনি আলাপ হতো দেশের কথা। দেশের সর্বশেষ অবস্থার কথা। বাদশা আগ্রহের সঙ্গে রিক্সাচালকদের কথোপকথনে কান রাখত। নির্বাচনে জয় লাভ করার পরও বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানায় সবার মধ্যে ক্রমাগত ক্ষোভ বাড়ছিল। রিক্সা চালকদের মধ্যেও প্রায় সবার ধারণা ছিল ইয়াহিয়া অত সহজে বাঙালীদের ক্ষমতা দেবে না। গ্যারেজে প্রতিদিন আসা লোকদের মধ্যে কেউ একজন বাদশাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এ রকম ছাইপাশ খাইয়েছিল একদিন। ছাইপাশ খেয়ে প্রথম তার বেশ ভালই লেগেছিল। কারণ এগুলো খাওয়ার পর রাজা রাজা ভাব আসল তার মনে। মনে হলো ডানা ছাড়া সে আকাশে উড়ছে। পাড়ি দিচ্ছে সাত সমুদ্দুর তের নদী। কিন্তু দু’-একবার খাওয়ার পর বাদশা নিজেই বুঝল, এগুলো মোটেই ভাল জিনিস নয়। তার এই বোধোদয় হওয়ার পর থেকে সে মন্দ লোকদের কাছ থেকে বরাবরই দূরে থেকেছে। চা বাগানে গিয়ে কি যে হলো তার বুঝতেই পারল না সে। হয়ত তার ওপর শয়তান চেপেছিল। তা না হলে এমন কাজ কেউ করে! ছাইপাশটা হাতের কাছে পেয়ে হয়ত লোভ সামলাতে পারেনি বাদশা। নেশা কেটে যেতেই বাদশা বুঝতে পারল সে বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে কমান্ডারের পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। অনুনয় করে বলল, ‘স্যার একটিবার, শুধু একটিবার আমাকে সুযোগ দিন। আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখব।’ বাদশার কান্নাকাটিতে কমান্ডারের দয়া হলো। তিনি তাকে শেষবারের মতো সুযোগ দিতে রাজি হলেন। কিন্তু সাব-কমান্ডার তাকে গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। সাব- কমান্ডারের যুক্তি, যে ছেলে লড়াই করতে এসে দেশের কথা ভুলে যায়। ছাইপাশ খেয়ে মাতলামি করে। তার দ্বারা আর যাই হোক দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়, যুদ্ধ দূরের কথা। এ অবস্থায় কমান্ডার তাকে অন্য কমান্ডে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলেন। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়। বাদশার সুযোগ আসল দেশের জন্য যুদ্ধ করার। সিলেটের নতুনপাড়ায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় ক্যাম্প। সেদিন পাকিস্তানী সৈন্যরা অতর্কিতে আক্রমণ করে সে ক্যাম্পের ওপর। অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সৈন্যরা যে এ রকম আচমকা আক্রমণ করে বসবে তা তারা ভাবেনি। এ অবস্থায় এগিয়ে আসল বাদশা। বলল, ‘আমাদের সামনে বড় বিপদ। আমাদের ক’টা রাইফেল আর একটামাত্র মেশিনগান দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব। এক্ষেত্রে আমাদের একজনকে কভারিং ফায়ারের দায়িত্ব নিতে হবে। আর সেই দায়িত্বটা আমি নিতে চাই।’ বলেই সে মেশিনগান হাতে নিয়ে সবাইকে অনুরোধ করল ফায়ার শুরু হলেই তাঁরা যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। বলেই বাদশা মেশিনগানে ফায়ার শুরু করল। এ সময় তাঁর সামনে ভেসে উঠল সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণদানরত ছবি। সে দেখতে পাচ্ছে রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার সমাবেশ। আর শুনতে পাচ্ছে মুহুর্মুহু স্লোগান। জয় বাংলা- জয় বাংলা, আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ, বীর বাঙালী অস্ত্র ধর -বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে বলছেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠ বাদশার শিরা-উপশিরায় বইয়ে দেয় অতুল গতি। সে চোখ বুজে মেশিনগানের ফায়ার অব্যাহত রাখে। অবিরাম মেশিনগানের গর্জনে পাকিস্তানী সৈন্যরা বুঝে নেয় আজ তাদের সামনে এগোনো সম্ভব নয়। এরই মধ্যে কখন যে একটা গুলি এসে বাদশার পেট চিরে বেরিয়ে যায় সে টেরই পায়নি। হঠাৎ পেটে ভেজা ভেজা ভাব অনুভূত হলে বাদশা বুঝতে পারে তার সময় ফুরিয়ে আসছে। বাদশার একাই মেশিনগান নিয়ে লড়াই করার খবর পেয়ে ছুটে আসেন কমান্ডার। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে পিছু হটে গেছে। তিনি পরম বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন বাদশার পেট চুয়ে রক্ত পড়ছে, তখনও বাদশা এক হাতে পেট চিপে ধরে অন্য হাতে মেশিনগানে ফায়ার করে যাচ্ছিলেন। কমান্ডারকে দেখেই বাদশা ফায়ার বন্ধ করে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্যার, আমি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আরও রক্ত দেব। আমি রক্ত দিয়েছি। দেশের জন্য রক্ত। বলেই সে ঢলে পড়ল মা ও মাটির কোলে।
×