ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তুহিন আহমদ পায়েল

দল বেঁধে সৈকতে...

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ২০ মার্চ ২০২০

দল বেঁধে সৈকতে...

ঘুরে বেড়াতে কার না ভাললাগে! মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণই দেখে। প্রতিনিয়ত চোখ অন্বেষণ করে নতুন কিছু। সৌন্দর্য খুঁজতে থাকে সারাক্ষণ। এই খোঁজের কোন ব্যাস কিংবা ব্যাসার্ধ নেই। নেই কোন প্রান্তসীমা। ঘুরে বেড়ানোর প্রয়াস অন্তহীন। আর যারা ভ্রমণপ্রেমী তাদের ক্ষেত্রে এক জোড়া চোখ সব সময় চায় নতুন নতুন জায়গা দেখার। ভ্রমণ জিনিসটা একটা দারুণ প্রশান্তি দেয়। মনের চোখ খুলে দেয়। আপনার অনুভূতিগুলোকে চৌকস করে। আর সেটা যদি হয় সমুদ্রদর্শন, তাহলে তো কথাই নেই! বিশেষ করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাটাই আলাদা। দেশের ভেতরে কোথাও ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে দেখা যায় প্রথমে অবশ্যই কক্সবাজারের নাম এসে যায়। কেবলমাত্র দেশীয় পর্যটকই নয়, বিদেশ থেকেও প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এ সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে আসে। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত উপভোগ করেন। দেখা যায়, যথাযথ তথ্যের স্বল্পতা এবং সুন্দর একটি ভ্রমণ পরিকল্পনার অভাবে আমাদের অনেকেরই কক্সবাজার ভ্রমণ শতভাগ সার্থক হয়ে ওঠে না। কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, তথা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শহরটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার প্রধান শহর হিসেবে বিবেচিত। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতটি এখানেই অবস্থিত। সৈকতটি কক্সবাজার থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত একটানা ১৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃৃত। এছাড়া এখানে আছে বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্যবন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন। চট্টগ্রাম শহর থেকে দক্ষিণে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫২ কি.মি এবং ঢাকা থেকে ৪১৪ কি.মি। দিগন্তজোড়া বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা, মেঘ কালো সারি সারি ঝাউবন, সৈকতের বুকে আঁছড়ে পড়া একেকটি ঢেউ, নৌকা ও ট্রলার নিয়ে জেলেদের কর্মচাঞ্চল্য, ভোরের আকাশে পূর্ব পাহাড়ের পেছন থেকে বেরিয়ে আসা সূর্য, আবার সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের মায়াবী রূপÑ এ সমস্ত সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ঘুরে আসি কক্সবাজার থেকে। সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্ট : সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টেই পর্যটকদের আনাগোনা অপেক্ষাকৃত বেশি। দুটি সৈকতই পাশাপাশি। পছন্দসই যে কোন সৈকতে বেড়াতে পারেন। ইচ্ছে হলে ছাতার নিচে আরামচেয়ার ভাড়া নিয়েও সমুদ্র উপভোগ করতে পারেন। বর্ষায় সমুদ্রস্নানের জন্য নিরাপদ জায়গা লাবণী ও সুগন্ধা। কারণ এ দুটি সৈকতেই সার্বক্ষণিক লাইফ গার্ড আছে। দিনের প্রথম অংশ রাখতে পারেন সমুদ্রস্নানের জন্য। দ্বিতীয় অংশ সৈকতে ঘুরে বেড়ান। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখতে ভুলবেন না যেন। ইচ্ছে হলে অনেক রাত অবধি সৈকতেই কাটাতে পারেন। সৈকত সংলগ্ন শামুক-ঝিনুক, নানা প্রজাতির প্রবালসমৃদ্ধ বিপণি বিতান ও নতুন সাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেট। শামুক-ঝিনুক ও প্রবালের দোকানের পাশাপাশি বার্মিজ পণ্যসামগ্রী, কসমেটিক্স, শুঁটকি, স্টুডিওসহ নানা দোকানের সমাহার রয়েছে এ সব মাকের্টে। আছে বেশকিছু রেস্টুরেন্ট, যেখানে বসে এক মগ কফি পান করতে করতে মনোরম সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত একটি মায়াবী ও রূপময়ী সমুদ্র সৈকত। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এর রূপ পরিবর্তন করে। গোধূলিবেলার বিচের হাওয়া-অবস্থা আর রাতের বেলার আবহাওয়া-অবস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সি-বিচের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিবসে ওপেন কনসার্ট, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিচ-ফুটবল, বিচ-ভলিবল, বিচ-ক্রিকেট প্রতিযোগিতা, জাতীয় ঘুড়ি উত্তোলনের উৎসব, বালু স্কাল্পচার নির্মাণসহ অনেক অনুষ্ঠান আয়োজন হয়ে থাকে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ার-ভাটার জনসচেতনতা ও শিক্ষামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য সমুদ্র সৈকতে কলাতলী, সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টে এলসিডি টিভি মনিটর রয়েছে। হিমছড়ি : মেরিনড্রাইভ ধরে কক্সবাজার থেকে ১৮ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। সৈকতের মেরিনড্রাইভ একটি অসাধারণ রাস্তা। এই রাস্তা ধরে যত দূরে যাবেন, পুরো জায়গায়ই আপনাকে মুগ্ধ করবে। একপাশে পাহাড় আর একপাশে সমুদ্র দেখে হবেন বিমোহিত। হিমছড়িতে গিয়ে এখানকার প্রসিদ্ধ ঝর্ণা দেখতে পারেন, যদিও শীতকালে ঝর্ণাটি শুকিয়ে যায়। তবে বর্ষাকালে এখানে আসলে ঝর্ণার পানির পূর্ণ প্রবাহ উপভোগ করা যায়। পাম গাছ এবং বাঁশঝাড়ে ঘেরা একটি অপূর্ব পিকনিক স্পট হলো হিমছড়ি। শীতকালে যখন সূর্য পাহাড়ের ওপর উদিত হয় এবং নীল সমুদ্রে অস্ত যায়, তখন হিমছড়ি ভিন্ন এক রূপ ধারণ করে। হিমছড়ির পথে ভোরবেলা সৈকত ধরে ভ্রমণ করলে আপনি এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। হিমছড়ির নানাবিধ আকর্ষণ প্রচুর পর্যটকদের এখানে আকর্ষিত করে নিয়ে আসে। এখানে পাহাড় চূড়ায় একটি রিসোর্টও রয়েছে, যেখান থেকে নীল জলরাশির বিশাল সমুদ্রকে সহজেই দেখা যায়। সিঁড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড়ে উঠে সাগর, পাহাড় ও কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অতিসহজে উপভোগ করা যায়। হিমছড়ি যাওয়ার পথে দরিয়ানগরসহ (ভাঙ্গামোড়া) অনেক পিকনিক স্পট আছে। ছোট ছোট সুরেলা ঝর্ণার পানি প্রবাহ অবলোকন করতে চাইলে পর্যটকদের ভরা পর্যটন মৌসুম ছাড়া বর্ষা মৌসুমে আসতে হবে। হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গবেষণা ও শিক্ষণ, পর্যটন ও বিনোদন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ। হিমছড়ির একপাশে রয়েছে সুবিস্তৃৃত সমুদ্র সৈকত আর অন্য পাশে রয়েছে সবুজ পাহাড়ের সারি। উদ্যানে অনেকগুলো জলপ্রপাত রয়েছে, যার মধ্যে হিমছড়ি জলপ্রপাতটি সবচেয়ে বিখ্যাত। হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ইনানী সৈকত : ইনানী সৈকতের প্রধান আকর্ষণ প্রবাল আর পাথর। প্রায় প্রতিটা পাথরই নানা আকার আর ধরনের। কত বছরের পুরনো সে পাথর! আর তাতে মিশে আছে কত স্মৃতি! টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ইনানী সৈকতে যান তবে যাবার পথে আপনার দু’চোখ জুড়িয়ে দেবে উঁচু উঁচু পাহাড় আর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ। শুধু চোখই জুড়বে না, বরং পুরো সময়টা আপনি থাকবেন এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায়! একপাশে পাহাড়, আরেক পাশে সাগর। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন? মন যে দুদিকই দেখতে চাইবে! কক্সবাজার থেকে ইনানী সৈকতের দূরত্ব ৩৫ কিমি। অভাবনীয় সৌন্দর্যে ভরপুর এ সৈকতটি দিনকে দিন অধিক পর্যটক-প্রিয় একটি জায়গা হিসেবে পরিচিত লাভ করছে। পরিষ্কার পানির কারণে পর্যটকদের কাছে ইনানী সৈকত সমুদ্রস্নানের জন্য উৎকৃষ্ট স্পট বলে বিবেচিত। সাগরে নামতে না চাইলে বা সে রকম পরিকল্পনা না থাকলে ইনানী সৈকতে যেতে পারেন বিকেল বেলায়। পড়ন্ত বিকেলের শান্ত সাগর আপনার সামনে তুলে ধরবে তার বিশালতা। সূর্যাস্তটাও উপভোগ করে ফিরতে পারেন। বিকেলে জোয়ার থাকে বলে সাধারণত অন্য সময়ের তুলনায় সে সময়ে মানুষের উপচেপড়া ভিড় কিছুটা কম থাকে। ভাটার সময় এখানকার সমুদ্রের মাঝে অনেক প্রবাল পাথর দেখা যায়। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি পোনা উৎপাদনের অনেক হ্যাচারি রয়েছে ইনানীতে। সুপারি গাছের সারি ইনানীকে যেন আরও মোহনীয় করে রেখেছে। বন বিভাগের রেস্ট হাউসটি এক সময় একমাত্র রেস্টহাউস হলেও এখন ব্যক্তি মালিকানায় অনেক রেস্টহাউস ও হোটেল-মোটেল-কটেজ রয়েছে। পর্যটকরা অনায়াসে এখন ইনানী সমুদ্র সৈকতে পিকনিক করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এছাড়াও ঘুরে আসতে পারেন ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, সেন্টমার্টিন ও ছেড়াদ্বীপ, মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপ, বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম চর্চা কেন্দ্র রামু। কক্সবাজারের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে বার্মিজ বাজার, শুঁটকি বাজার, লাইট হাউস, মাহাসিংদোগী বৌদ্ধ খ্যাং, মাথিনের কূপ, বদর মোকাম মসজিদ, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, লবণ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, কানা রাজার সুড়ং, কুতুবদিয়া দ্বীপের বাতিঘর, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ শাপলা সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি। ঘোরাঘুরির জন্য জিপ বা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করা যেতে পারে। দূরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রিজার্ভ গাড়ি ব্যবহার করা ভাল। সবকিছু ঘুরে দেখতে ও উপভোগ করতে দশ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা প্রয়োজন। তবে প্রধান আকর্ষণগুলো ঘুরে দেখতে তিন থেকে চার দিনই যথেষ্ট। কখন যাবেন : কক্সবাজারের পিক সিজন বলে অক্টোবর থেকে মার্চ। এ সময়টায় বৃষ্টি কম হওয়ায় বেশি পর্যটক আসেন। অফপিক সিজনেও ঘুরে আসতে পারেন, ভাললাগবে। অফসিজনে হোটেলগুলো ৩০% থেকে ৬০% পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে। কিভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে নন-এসি গাড়ি আছে অনেকগুলো। গ্রীন লাইন, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী, সোহাগ, টিআর, হানিফ, ইউনিক, এস আলম, সৌদিয়া ইত্যাদি। নন-এসি ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা। এসিতে ভাড়া পড়বে ১৬০০ টাকা (ইকোনমি ক্লাস) থেকে ২০০০ টাকা (বিজনেস ক্লাস)। এছাড়া বিমানেও যেতে পারবেন। বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা, নোভো এয়ার কক্সবাজার যায়। থাকার ব্যবস্থা : কক্সবাজারে প্রচুর হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট রয়েছে। মারমেইড বিচ রিসোর্ট, সায়মন বিচ রিসোর্ট, ওশেন প্যারাডাইজ, লং বিচ, কক্স টুডে, হেরিটেজ সি প্যালেস, সি গাল, কোরাল রিফ, নিটোল রিসোর্ট, আইল্যান্ডিয়া, বিচ ভিউ, সি ক্রাউন, ইউনি রিসোর্ট ইত্যাদি। এর কমেও হোটেল পাওয়া যায়, তবে খোঁজাখুঁজি করে দেখতে হয়। খাওয়ার ব্যবস্থা : কক্সবাজারে ভাল ও মানসম্মত খাওয়ার মতো ঝাউবন, রোদেলা, ধানসিঁড়ি নিরিবিলি ধরনের বেশকিছু রেস্টুরেন্ট আছে। এছাড়াও হান্ডি, কেএফসি তো রয়েছেই।
×