ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জানা-অজানা

বাজে মশা, ভাল মশা

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৬ মার্চ ২০২০

 বাজে মশা, ভাল মশা

বিশ্বজিৎ দাস ॥ মানুষের প্রধান শত্রু কে? উত্তর, মশা। সেই জুরাসিক যুগ থেকে মশারা পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের থেকে মুক্তি পাওয়া কি অতই সহজ? ডাইনোসরেরা ফসিল হয়ে গেল; কিন্তু মশারা রয়ে গেল বহাল তবিয়তে। মশা ১০ থেকে ৫০ মিটার দূর থেকেই মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধ আর ঘামের মধ্যে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিকের গন্ধ পায়। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এসে হাজির হয় ৫ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে। ২০ সেন্টিমিটারের মধ্যে চলে এলে মশা মানুষের শরীরের তাপ আর আর্দ্রতার হদিস পায় এবং পৌঁছে যায় লক্ষ্যে। মশা তাড়াতে নাজেহাল বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত তাই সমঝোতার রাস্তায়। মশাও থাকুক, মানুষও। কামড়াও, কিন্তু অসুখ ছড়িও না। মশারা হয়ে ওঠো ‘ভাল মশা’। ব্যাপারটা কী? এত দিন পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে যে সব পদ্ধতি প্রচলিত ছিল বা এখনও আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো কীটনাশকের প্রয়োগ। কিন্তু কীটনাশক মানুষ, অন্য প্রাণী এবং পরিবেশেরও ক্ষতি করে। মশারাও কিছুদিন পরে কীটনাশকের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতি, গবেষণাগারে কীটপতঙ্গের পুরুষ প্রজাতির উপর এক্স-রশ্মি বা গামা-রশ্মি প্রয়োগ করে তাদের বংশবিস্তারের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়া। এটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি; মানুষ বা প্রাণীর ওপর এর কোন ক্ষতিকর প্রভাব নেই। কিন্তু পুরুষ প্রজাতির মশার এই নির্বীজকরণ গবেষণাগারে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বার বার করতে হয়, নইলে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না। আর একটি পন্থা হলো, মশাদের জিনগত পরিবর্তন ঘটানো। দুর্ভাবনার একটি দিক, জিন পরিবর্তিত মশাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে তারা অন্য রকমভাবে শক্তিশালী হয়ে আরও জটিল কোনও অসুখের বাহক হয়ে উঠতে। পদ্ধতিটি ব্যয়সাপেক্ষও বটে। তাই মশাকে ভাল মশায় পরিণত করার পথে হেঁটেছেন অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কট ও’নিল। তিনি একটি বিশেষ ব্যাক্টিরিয়ার সাহায্য নিলেন, যার নাম ওয়াবাকিয়া। ওয়াবাকিয়া নতুন কোন ব্যাক্টিরিয়া নয়; কিন্তু তাদের এই গুণপনার কথা জানা ছিল না। ৬০ শতাংশ পোকামাকড় যেমন, মৌমাছি, মথ, প্রজাপতি, কয়েক ধরনের মশা এদের শরীরে ওয়াবাকিয়া ছিলই এবং বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে আজও আছে। যে সমস্ত মশার শরীরে ওয়াবাকিয়া আছে, তারা মানুষকে কামড়ালেও রোগ সংক্রমণের কোন ভয় থাকে না। স্কট ও’নিল লক্ষ্য করলেন, এডিস এজিপ্টাই মশার শরীরে এই ব্যাকটেরিয়া নেই; আর তাই তারা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকার মতো রোগ সংক্রামিত করে। যদি এডিস এজিপ্টাই-এর শরীরে ওয়াবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায়, তা হলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রোগের জীবাণুর সঙ্গে ওয়াবাকিয়ার ধুন্ধুমার লড়াই বাধে; তাতে জীবাণুর বংশবৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়; ফলে বন্ধ হয় রোগ ছড়ানোও। মশার শরীরে ওয়াবাকিয়া প্রবেশ করিয়ে দিলে মশাদের জিনগত কোন পরিবর্তন হয় না, কিন্তু তারা ভাল মশায় পরিণত হয়। অর্থাৎ, তাদের অসুখ সংক্রমণের ক্ষমতা হারিয়ে যায় বংশ পরম্পরায়। এই পদ্ধতিতে গবেষণাগারে বেশ কিছু স্ত্রী ও পুরুষ মশার শরীরে ওয়াবাকিয়া ব্যাক্টিরিয়া অনুপ্রবেশ করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। ওয়াবাকিয়াবাহী পুরুষ মশা অন্য স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হলে মশার ডিম ফোটে না। ওয়াবাকিয়াবাহী স্ত্রী মশা অন্য পুরুষ মশাদের সঙ্গে মিলিত হলে বা ওয়াবাকিয়াবাহী স্ত্রী এবং পুরুষ মশা মিলিত হলেও নতুন প্রজন্মের শরীরেও ওয়াবাকিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এবং তারাও অসুখ সংক্রমণের ক্ষমতা হারায়। এই ভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতেই থাকে। বাড়তে থাকে ওয়াবাকিয়াবাহী মশা। বেশ কয়েক বছর কোন এলাকায় এভাবে ভাল মশা ছড়িয়ে দেয়ার পর সেই এলাকার মশা রোগ ছড়ানোর ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। স্কট ও’নিলের পদ্ধতিটি এখন আর গবেষণাগারেই আবদ্ধ নয়; এই পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগও শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, নিউ ক্যালিডোনিয়া, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশে। ব্রাজিলের কথাই ধরা যাক। সে দেশে নতুন করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯৮১তে। তার পরে ৩০ বছরের মধ্যে ৭০ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। সারা পৃথিবীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ব্রাজিলেই সর্বাধিক। চিকুনগুনিয়ার আক্রান্তের সংখ্যাও ভয়াবহ। সরকারী অনুমোদন পাওয়ার পরে ব্রাজিলে ২০১৪ সালে ওয়াবাকিয়াবাহী মশা ছাড়ার শুরু হয় রিয়ো ডি জেনেইরোতে। ১১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ এর আওতায় আসেন। পাঁচ বছর পরে দেখা গেল এই এলাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় ৬৬-৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ব্রাজিল ছাড়াও কলম্বিয়াতেও ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হচ্ছে ওয়াবাকিয়া মশা। এশীয় দেশগুলোও আপন করে নিচ্ছে ওয়াবাকিয়া মশাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কায় ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের গড় সংখ্যা যা ছিল, ২০১৭-তে সংখ্যাটা প্রায় তার তিনগুণেরও বেশি। অবস্থা সামাল দিতে এ বছরই কলম্বোতে ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ওয়াবাকিয়াবাহী মশা ছাড়ার কাজ শুরু হয়েছে। ভারতেও প্রাথমিক স্তরে ওয়াবাকিয়াবাহী মশা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে পুদুচেরীর ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারে। পুদুচেরীর প্রায় ৬ লাখ মানুষকে এর আওতায় এনে কাজ শুরু হবে খুব শিগগিরই। ধৈর্য রেখে এগোতে পারলে এক দিন মানুষও থাকবে, থাকবে ভাল মশার দল। থাকবে না শুধু ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার, ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ। সূত্র : আনন্দবাজার
×