ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোছাঃ ফাতিমাতুজ্জোহরা

বাংলা ভাষা-ভাবনা

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 বাংলা ভাষা-ভাবনা

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার ছাড়াও অনেক নাম না জানা ছাত্র ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এরই ফলে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। একুশ কেবল বাংলা ভাষারই লড়াই ছিল না, একুশ ছিল বাঙালীর সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম ছিল। বাঙালীর আত্মাবিষ্কার বা স্বরূপ অন্বেষার সূচনালগ্ন। তবে ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের এ সংগ্রাম হঠাৎ করে আসেনি। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরই পূর্ববঙ্গে এ সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা দেখা হয়। কারণ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি দেশই মুসলমান প্রধান হলেও দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতিগত, জীবন-পদ্ধতিগত, ভাষাগত অনেক পার্থক্য ছিল। আবার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের শোষণ-বৈষম্যমূলক আচরণ তো ছিলই। তবে ২১ ফেব্রুয়ারির সেই গৌরবময় জাগরণের সামনে স্বৈরাচারী পাকবাহিনীকে সাময়িকভাবে হলেও পিছু হটতে হয়েছিল। তার প্রমাণ হলো শাসনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসকদের আর সাহস হয়নি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ তাই তাদের দুর্বল হতে হয়েছিল। তবে তাদের দুর্বলতারও একটি কারণ ছিল। কারণটা হলো ‘ইংরেজী’ তখনও কয়েক বছর রাষ্ট্রভাষারূপে চালু ছিল। আবার স্কুল-কলেজে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার কার্যপরিচালনায় উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে শাসকচক্র পেছনের দরজা দিয়ে উর্দু ভাষাকে চাপাতে চেয়েছিল। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তানের শাসকচক্র প্রধানত উর্দুভাষী। সেজন্য তারা অন্যান্য ভাষাকে পদদলিত করে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। আবার অন্যদিকে তারা যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর ব্রিটিশ ও মার্কিন প্রভাব রয়েছে সেজন্য এরা আরও ২০ বছর ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালু রাখার জন্য ওকালতি করেছিল। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির গৌরবময় সংগ্রাম তাদের সেই পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এই একুশে ফেব্রুয়ারিই পূর্ব পাকিস্তানের জনতাকে পথ দেখিয়েছে। তবে শুধু একুশের দিনেই যেন বাঙালীর এত আবেগ। অথচ যে ভাষার জন্য বাঙালীর এত সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, আমরা কি পেরেছি সেই ভাষার চেতনা, মানমর্যাদা ধরে রাখতে? আজ আমাদের তরুণ প্রজন্মের মুখের বাংলা ভাষার আড়াই ভাগ ইংরেজী, সিকি ভাগ হিন্দী আর বাকিটা বিকৃত উচ্চারণের বাংলা। আর আমাদের টিভি চ্যানেল, বিজ্ঞাপন, রেডিওতে ব্যবহৃত মুখের কথাকে কী ধরনের ভাষা বলা যায় তা আমার ঠিক জানা নেই। কথায় কথায় বাংলার মধ্যে ইংরেজী শব্দ না বললে নাকি উচ্চ শিক্ষিত হওয়া যায় না। এটাই কী আমাদের আজকের একুশের চেতনা? অথচ ২০১০ সালে ইউনেস্কোর একদল ভাষাবিজ্ঞানীর দীর্ঘ গবেষণার পর পৃথিবীর সব থেকে শ্রুতিমধুর ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল বাংলা ভাষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধতম জন্মবার্ষিকীতে ভারতের বিশিষ্ট লেখক দিবেন্দু পালিতও ঠিক একই কথা বলেছিলেন, ‘বাংলা পৃথিবীর সব থেকে শ্রুতিমধুর ভাষা।’ তবে শুধু দিবেন্দু পালিতই নন, বিশ্বের সব প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানীও সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রুতিমধুর ভাষা হিসেবে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলাকে। বাংলা ভাষায় আমরা যত তীব্রভাবে মনের আবেগ প্রকাশ করতে পারি পৃথিবীর আর কোন ভাষার মানুষ ততটা সাবলীল সুন্দরভাবে মনের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। সেই আমরা ইংরেজী, হিন্দীকে বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে কথা বলি। আমাদের এরকম ভাবনার জন্যই কি বাঙালীরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল? মানছি যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইংরেজী হচ্ছে একটি মার্কেট ইকোনমির ভাষা। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইংরেজী ভাষা শিখতে হবে। তবে ইংরেজী শিক্ষার নামে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা বা বিকৃত করে নয়। কথায় কথায় বাংলার মধ্যে ইংরেজী বা হিন্দী শব্দ ঢোকানো কোন ফ্যাশন বা গর্বের বিষয় নয়, বরং বাঙালীর সেই আত্মত্যাগ বা আত্মমর্যাদাকে হেয় করা। বাংলা ভাষা বিকৃত হয়ে করার জন্য বাঙালীরা সেদিন রক্ত দেয়নি। ইংরেজী বা হিন্দী শেখা অন্যায় নয়। তবে বাংলার মধ্যে হিন্দী বা ইংরেজী মিশিয়ে জগাখিচুড়ি করে বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়া অন্যায়। আজকাল বাংলার ঘরে ঘরে যে হারে হিন্দী সিরিয়াল দেখা হচ্ছে, ভারতীয় সংস্কৃতির লালন করা হচ্ছে, তাতে মনে প্রশ্ন জাগে বাংলা ভাষা বিকৃত হওয়ার হাত থেকে বাঁচবে তো? বিকৃত হতে হতে আমাদের প্রাণের ভাষা এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে না তো? কারণ আমরা জানি, এই পৃথিবীতে অনেক ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার কিছু ভাষা থেকে প্রভাবিত হয়ে অনেক নতুন ভাষার জন্মও হয়েছে। আজকের বহুল ব্যবহৃত ইংরেজী ভাষাও এককালে এরকম ছিল না। ইংরেজী ভাষার অনেক শব্দই ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে। আমাদের সমাজে অনেকেই বাংলার সঙ্গে জগাখিচুড়ি মিশিয়ে কথা বলাকে তেমন দূষণীয় মনে করেন না। অথচ বাংলা ভাষার মধ্যে আন্তঃআণবিক ফাঁক অনেক বেশি অর্থাৎ বাংলা ভাষা খুব সহজেই অন্য যে কোন ভাষাকে হজম করতে পারে। ইংরেজী বা হিন্দী বা অন্য যে কোন ভাষা বাংলা ভাষার মধ্যে ঢুকে সহজেই শব্দ গঠন করতে পারে। তাই আমরা যদি শুদ্ধভাবে বাংলা না বলি তাহলে খুব সহজেই বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিকৃত হয়ে যেতে পারে প্রাণের বাংলা ভাষা। লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
×