ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

’৬৯-এর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ১১:০৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

’৬৯-এর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলা নামের দেশটিতে কত না বীরের জন্ম হয়েছিল! শিরদাঁড়া উঁচু করে বাঁচার প্রয়োজনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন তারা। দৌড়ে পালাননি। বরং প্রতিবাদ করেছেন। বুক ফুলিয়ে প্রতিবাদ করতে করতে, প্রতিরোধ করতে করতে লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে। সেইসব মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের একজন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বাঙালীর মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আরও যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের একজন তিনি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকা অবস্থায় পাকিস্তানী বর্বররা এই বাঙালী অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। জহুরুল হকের নির্মম মৃত্যু হলেও, তার তাজা রক্তের ধারা ঊনসত্তরের গণআন্দোলনকে বেগবান করে। চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। ইতিহাসটি, হ্যাঁ, সকলের জানা। তবে একই ইতিহাস আরও মর্মস্পর্শী হয়ে ধরা দিয়েছে ’৬৯-এর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ বইটিতে। গ্রন্থের রচয়িতা নাজনীন হক মিমি। ইতিহাসবিদ নন তিনি। এ চর্চার সঙ্গে সরাসরি যুক্তও নন। তবে জহুরুল হকের পরিবারের সদস্য। শহীদ সার্জেন্টের অতি আদরে ভ্রাতুস্পুত্রী। শিশুর চোখ দিয়ে চাচাকে তিনি যেমন দেখেছেন, যেভাবে স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তার একটি মর্মস্পর্শী বর্ণনা এ বইতে পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের গল্প হলেও, ইতিহাস চেতনায় সমৃদ্ধ। সে চেতনা থেকেই অনুসন্ধিৎসু হয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সামনে এনেছেন অনেক অজানাকে। বইয়ে পুরো বিষয়টিকে মোট তের অধ্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা হয়েছে। সার্জেন্ট জহুরুল হককে কেন কীভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়? গ্রেফতার করা হয় কখন? ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকাকালীন সময় পাকিস্তানী সৈন্যরা কেমন ব্যবহার করেন তার সঙ্গে ? এবং অতঃপর যে মৃত্যু, সেটি কেমন ছিল ? ইত্যাদি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর খোঁজার চেষ্টা বইতে লক্ষ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে সূত্র হয়েছেন সার্জেট জহুরুলের দুই ভাই, বন্ধু, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। বই পাঠে আবারও স্পষ্ট হয়, পাকিস্তানে চাকরিরত বাঙালী অফিসারদের নানাভাবে হেনস্তা করা হতো। অপমান অপদস্ত করা হতো। বঞ্চিত করা হতো। সেই বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন জহুরুল হকও। পরিবারের কেউ কেউ তখনই বিষয়টি জানতেন। অজানা আতঙ্ক কাজ করত তাদের মধ্যে। পরবর্তীতে সে আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়েছিল সার্জেন্ট জহুরুল হককে। রাষ্ট্রদ্রোহী অপবাদ দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেসব বর্ণনা যুক্ত করা হয়েছে বইতে। আছে সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকা-ের নাতিদীর্ঘ বিবরণ। পড়তে পড়তে চোখের পাতা যেমন ভিজে যায়, তেমনি বাঙালী হিসেবে গর্বে বুক ভরে ওঠে। ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায়ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হতো ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের সঙ্গে। নিম্নœমানের খাবার পরিবেশন করা হতো। এ অবস্থায় যেটুকু না খেলেই নয়, রাজবন্দীরা ততটুকু মুখে তুলতেন। বাকি খাবার কাঁটাতারের বেড়ার অপর প্রান্তে অপেক্ষারত অভুক্ত শিশুদের মধ্যে বিতরণ করতেন। কিন্তু মেনে নিতে পারত না পাকিস্তানীরা। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্বর পাকিস্তানী হাবিলদার মঞ্জুর শাহ বাঙালী শিশুদের বন্দী শিবিরের সামনে এনে বেদম প্রহার করতে থাকে। বন্দীরা নিজ কামরা থেকে বের হয়ে এসে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। মিমির বর্ণনাটি এ রকম : ‘মঞ্জুর শাহ ক্ষিপ্ত হয়ে বাচ্চাদের লাথি মারা শুরু করে। জহুর মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়ান এবং অতর্কিতে মঞ্জুর শাহ’র ওপর ঝাঁপ দিয়ে তার রাইফেলটা কেড়ে নেন। মঞ্জুর শাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ...জহুর বলে ওঠেÑ চাইলে আমরা খালি হাতে এই ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারি। এই কথা বলার পর জহুর সবলে রাইফেলটি মঞ্জুর শাহ’র দিকে ছুঁড়ে দেন।’ এবং পরদিন সে অস্ত্রের গুলিতেই বিদ্ধ হন জহুরুল। পরের বর্ণনাটি আরও হৃদয় বিধারক। মিমি লিখেন, ‘(পাকিস্তানী বর্বররা) রাইফেল খাড়া করে জহুরের গুলিবিদ্ধ পেটের ওপর উঠে দাঁড়াল। রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে সরাসরি পেটের মধ্যে আঘাত শুরু করল। বেয়নেটের আঘাতে জহুরের পেটের সমস্ত তন্ত্রী ছিড়ে যাচ্ছে। তবুও বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যটি ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাকে জুতা দিয়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে। বুটের আঘাতে জহুরের কলার বোন ভেঙ্গে গেল...।’ জহুরুল হকের চিকিৎসায় যে গাফিলতি করা হয়েছিল, সে সত্যও ওঠে এসেছে বইতে। ডাঃ কর্নেল এম. এ. আলীর মুখে শোনা বর্ণনা দেশপ্রেমিক মানুষের মনকে নতুন করে ভারাক্রান্ত করবে, নিশ্চিত বলা যায়। পরেরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি বীর শহীদের মর্যাদা লাভ করেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। এর বহু বছর পর পরিণত বয়সের মিমি লিখছেন, ‘আমি একটি ট্র্যাঙ্ক খুলে ধীরে ধীরে অনেক কিছু খুঁজে পেলাম। রঙের কৌটা, তুলি, কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম। কাঠ মসৃন করার ফাইলার, চিরুনি, পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সোয়েটার, লং কোটÑএকটার পর একটা জিনিস বের করতে করতে হঠাৎ সেই রক্তভেজা তোয়ালেটি পেলাম।’ বর্ণনা পড়ে জানা যাচ্ছে, শুকনো রক্তমাখা তোয়ালেটি সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃতদেহের সঙ্গে জড়ানো অবস্থায় এসেছিল। বীরের মৃত্যুতে ঊনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময়ের পত্রিকার অনুলিপি, ফটোগ্রাফ ইত্যাদির মাধ্যমে ইতিহাসটিকে জীবন্ত করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে অনেকটা ধারাবাহিক আলোচনা। প্রাসঙ্গিক আরও অনেককিছু যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে শহীদ পরিবারের সদস্যদের শোক বহন করার ইতিহাসটি একেবারেই অজানা। কখনও তেমন সামনে আসেনি। এ বইতে তার কিছুটা আঁচ করতে পারবেন পাঠক। এ সংক্রান্ত আলোচনায় দুঃখ করে নাজনীন হক মিমি লিখেছেন, ‘একজন স্বাধীনতাকামী মানুষের পরিবারে কী কী ঘটনা ঘটেছিল, তা হয়ত কোন জাদুঘরে স্বাধীনতার ইতিহাসের গ্যালারিতে ‘বুলেট ক্যাপশন’ হবে না। বাঙালী জাতির সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনায় অথবা বিশ্লেষণে, সাহিত্য রচনায়, বাঙালী পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক আলোচনায় একেকটি পরিবারের এই ছোট ছোট ভালবাসাপূর্ণ ঘটনাগুলো হয়ত কোন একদিন সামাজিক ইতিহাসকে প্রাণিত করবে।’ সার্জেন্ট জহুরুল হক সম্পর্কে অজানা এবং অল্পজানা অনেক তথ্য বইতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তেমন একটি তথ্য দিয়ে বইতে মিমি লিখেছেন, ‘ছোট চাচা জহুরুল অসাধারণ কবিতা আবৃত্তি করতেন। মা বলেছিল, সেই দিন তিনি কাজী নুজরুলের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ আবৃত্তি করছিলেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় জহুরুল হক পরিবারের অবদানও বইতে তুলে ধরা হয়েছে। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরও কষ্ট সইতে হয়েছে অনেক। আছে সেসব বর্ণনাও। বইতে লেখিকার সঙ্গে চাচা জহুরুল হকের সম্পর্কের গল্প করা হয়েছে। তবে অবাক হতে হয় সেই ছোট্ট বেলার স্মৃতি বুকে বড় হওয়া মেয়েটির কথা ভেবে। বই লেখার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘ছোট চাচা সেই যে আমাকে সজোরে স্নেœহের আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তার থেকে আমি কোনদিন মুক্ত হতে চাই না।’ জার্নিম্যান বুকস থেকে প্রকাশিত বইটি অমর একুশে গ্রন্থ মেলার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। প্রায় ২৩০ পৃষ্ঠার বইয়ের মূল্য ১৫০০ টাকা।
×