ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত রাস্তা পার হতেই হবে- নিয়মের তোয়াক্কা নেই ॥ দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ১১:০২, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দ্রুত রাস্তা পার হতেই হবে- নিয়মের তোয়াক্কা নেই ॥ দায় ও দায়িত্ব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত ইচ্ছা করলেই সড়ক পারাপার সম্ভব নয়। কারণ রাস্তার মাঝখানে উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে রোড ডিভাইডার। তাতেও বেপরোয়া পথচারীদের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হচ্ছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিভাইডারের ওপর স্টিলের পাত দেয়া হয়েছে এক ফুটের বেশি। এখন জেব্রা ক্রসিং নয়তো ওভারব্রিজ ছাড়া সড়ক পারাপার সম্ভব হচ্ছে না। নানামুখী উদ্যোগে এই এলাকায় যত্রতত্র রাস্তা পারাপার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। প্রশ্ন হলো বাদ বাকি শহরের কি হবে? বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত উঁচু রোড ডিভাইডার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে নানা কথা। আলোচনা। সমালোচনা। কারও মতে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিথিরা বিমানবন্দরে নামার পরই এই সড়কটি বেশি ব্যবহার করেন। একটি দেশে আসা মাত্রই যত্রতত্র সড়ক পারাপারের দৃশ্য দেখলে ধারণা খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। তাই এখানে নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মিরপুর মাজার রোড থেকে আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত সড়কেও উঁচু করে ডিভাইডার রয়েছে। বাদ বাকি এলাকায় কেন এরকম ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। এ তো গেল সড়ক নিরাপত্তার এক রকম চিত্র। আবার কিছুটা উল্টো চিত্রও রয়েছে। যেমন রাজারবাগ থেকে খিলগাঁও উড়াল সড়ক মোড় পর্যন্ত রাস্তার মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছিল প্রায় বছর দেড়েক আগে। আবার সায়েদাবাদ থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত পথচারী নিরাপত্তায় সড়কের মাঝখানে কাঁটাতারসহ স্টিলের বার দিয়ে বেড়া দেয়া হয়। সেগুলো কি একই রকম আছে? সরেজমিন অন্তত এক সপ্তাহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে রাস্তা পারাপারে একেক সড়কে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। কোথাও একেবারেই নিরাপত্তার বালাই নেই। এজন্য সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ মোটেও দায় এড়াতে পারেন না বলছেন নগরবিদ, সাধারণ মানুষসহ বিশেষজ্ঞরা। তবে সাধারণ মানুষের যে একেবারেই দায় নেই তাও বলা যাবে না। এক্ষেত্রে নাগরিক নিরাপত্তায় সিটি কর্তৃপক্ষ যেমন উদাসীন তেমনি পথচারী থেকে শুরু করে নগরবাসীও বেপরোয়া। এরমধ্যে মধ্যে ৯০ ভাগের বেশি মানুষ সড়ক পারাপারের নিয়ম রয়েছে- সেকথাই জানেন না। ট্রাফিক আইন সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে পুলিশ যদি রাস্তা আটকে দেয় তাতে কোন সমস্যা হয় না। নির্দেশ অনুযায়ী সাধারণ মানুষ পথ চলতে পারেন। মালিবাগ রেলগেট থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত সড়কের বেশিরভাগ অংশে বাঁশ দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে সড়ক বিভাজকের ওপর। এরমধ্যে অন্তত ২৫টি পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া খুলে ফেলা হয়েছে। কোথাও আংশিক। কোথাও বেশি। রেল লাইন পার হয়ে ইচ্ছেমতো সড়ক পারাপার হতে দেখা যায় পথচারীদের। তাই সুবিধা অনুযায়ী কাঁটাতার খুলে মাটিতে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। খুলে নেয়া হয়েছে বাঁশ। যেখানে আংশিক খোলা সেখানে ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে। একেবারে নুয়ে ঝুঁকি নিয়ে বিভাজক অতিক্রম করতে দেখা গেছে। তারের সঙ্গে লেগে কখনও জামা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ক্ষত হচ্ছে শরীর। তাকে কি। দ্রুত পার হওয়া চাই। তা সম্ভব হয়েছে। যদিও সড়কের বিভিন্ন অংশে রয়েছে ক্রসিং ও ইউটার্ন নেয়ার ব্যবস্থা। কেউ যেন কষ্ট করতে নারাজ। খিলগাঁও উড়াল সড়ক থেকে নেমে সড়ক বিভাজকে দেখা যাবে স্টিলের বার দেয়া আছে। পাশে পদচারী সেতু। কিন্তু যত মানুষ পদচারী সেতু ব্যবহার করেন তার চেয়ে ততো বেশি ঝুঁকি মানুষকে নিচ দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে। উঁচু বিভাজক দিয়ে কিভাবে রাস্তা পার হন? এটা সম্ভব? এ প্রশ্ন অমূলক নয়। দেখা গেছে, স্টিল বারের ভেতরের একটি অথবা দুটি রড কেটে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া একটি বারের সঙ্গে অন্য বারের সংযোগ স্থলটি টেনে ফাঁকা করা হয়েছে। কোন রকমে একজন পার হওয়া যায়। তাও মোটা মানুষের জন্য কষ্টকর। এমন বুদ্ধির চাতুরি দেখা গেল সড়কে। একই চিত্র খিলগাঁও মোড় থেকে রাজারবাগ পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো কাঁটাতার কেটে দেয়া, বা খুলে ফেলা, স্টিলের বার কেটে ফেলা এ কেমন বদভ্যাস। কার প্রয়োজনে বিপুল অর্থ ব্যয়ে এসব লাগানো হয়। নাগরিক হিসেবে কি তাহলে কারও কোন দায় দায়িত্ব নেই। যেখানে সড়ক নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা হচ্ছে। এমন কোন দিন নেই- যেদিন সড়ক দুর্ঘটনার খবর থাকে না। আছে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুও। তবুও যেন কানে পানি যায় না। তবে নাগরিক নিরাপত্তার প্রয়োজনে এতকিছু কেন। যেখানে উদ্যোগ নেই সেখানে সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে সেখানে কেন উল্টো চিত্র দেখা যায়। দায়িত্বরত পুলিশ ও আনসার সদস্যরা বলছেন, বাসাবো উড়াল সড়কে একপাশে গাড়ি ওঠে, অন্যপাশে নামে। উভয়পাশে গতি নিয়ে যানবাহনের নামা ওঠা। কিন্তু পথচারীদের এ নিয়ে যেন কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। বারণ করলেও না শোনার প্রবণতা। আরেকটি বিপজ্জনক পয়েন্টের চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে বসুন্ধরা। যেখানে রাত দিন গাড়ি আর মানুষের জমজমাট চিত্র। এই পয়েন্টের জেব্রা ক্রসিং দিয়ে সড়ক পারাপারের সময় বিশ^বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন গত বছর আগে। দুই বাসের রেষারেষিতে চাপা পড়ে এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পর দেশজুড়ে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে ফের আন্দোলন হয়। শুরু হয় তোলপাড়। হৈচৈ। গোটা দেশ এই ঘটনায় কার্যত অচল হয়ে যায়। দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নে অগ্রগতি সম্পর্কেও তাদের অবহিত করা হয়। যেখানে দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো কতজন তা ব্যবহার করছেন? বুধবার সকালে এই এলাকার চিত্র যদি বর্ণনা করা যায় তবে বলাই বাহুল্য সর্বোচ্চ ৪০ ভাগ মানুষ ওভারব্রিজ দিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছেন। বাদ বাকি ৬০ ভাগ মানুষ সুবিধা অনুযায়ী ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে। কখনও ক্রসিং সময়, কখনও গাড়ি চলা অবস্থায় হাত উঁচিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায়। তবে কি সেই দুর্ঘটনার কথা সবাই বেমালুম ভুলে গেল। কিন্তু যারা ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগ মানুষের স্মৃতিতে এখনও জ্বল জ্বল করে ভেসে ওঠে সেদিনের দুর্ঘটনার কথা। তবে? নিজের জীবনের কি কোন মায়া নেই। অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেলে একজনের চেয়ে আরেকজনের জীবনের মায়া কম নয়। কেন এভাবে রাস্তা পারাপার? জবাবে তারা বলছেন, সব সময় নিয়ম মেনে চলা কঠিন। তবে সড়কে উঁচু বিভাজক থাকলে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করা ছাড়া কোন পথ ছিল না এমন পরামর্শও দিয়েছেন তারা। আবার ধানম-ি ও নিউমার্কেট এলাকায় সড়ক বিভাজকে উঁচু স্টিলের বার দেয়া আছে। কোথাও রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ডিভাইডার। কিন্তু মানানো যাচ্ছে না পথচারীদের। ডিভাইডার টপকে মহিলাদেরও পথ চলতে দেখা গেছে। একপাশ থেকে একজন উঁচু করে ডিভাইডারের ওপর তুলে দেন। অন্যপাশে আরেকজন নামান। বলুন তো এরকম চিত্র আর কোন উন্নত শহরে দেখা সম্ভব কি না। বিরল। অথচ একটু কষ্ট করলেই সহজ ও নিরাপদে রাস্তা পার হওয়া সম্ভব। কে শোনে কার কথা। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরে এখন ১৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৮৫টি যানবাহন বৈধভাবে চলাচল করছে। এরমধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সাত লাখ ২৪ হাজারের বেশি। প্রাইভেটকার প্রায় তিন লাখ। বাস-মিনিবাস মিলিয়ে আছে ৪৬ হাজারের বেশি। সঙ্গত কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে বা হওয়া স্বাভাবিক তা পরিসংখ্যানই বলছে। একমাত্র সচেতনতাই পারে দুর্ঘটনা থেকে মুক্ত রাখতে। সড়ক দুর্ঘটনারোধে কাজ করা বেসরকারী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘নিরাপদ সড়ক-গতিময় জীবন’ নামক কর্মসূচী পরিচালনা করতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে দেশের বৃহত্তর ২৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কর্মসূচী পরিচালিত হবে। প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কর্মসূচী কার্যকর করা গেলে শহরের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপারের চিত্র বদলে যাবে। শিশুরা যখন নিয়ম মেনে রাস্তা পার হবে তখন অভিভাবকরাও নিয়ম মানতে বাধ্য হবেন। একদিকে সড়ক নিরাপত্তার জন্য যেসব কার্যক্রম নেয়া হয়েছে সেগুলো যেমন শতভাগ মানা হচ্ছে না, তেমনি সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কার্যক্রম নেই বেশিরভাগ সড়কে বিশেষ করে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার ঠেকাতে সড়ক বিভাজকের ওপর উঁচু করে দেয়াল-বা নিরাপত্তামূলক কোন রকম পদক্ষেপ নেই। গোটা শহরের রাস্তায় ইচ্ছেমতো পারাপারের দৃশ্য চোখে পড়ে। গুলশান, বনানী, মীরপুর, বাড্ডা, নতুনবাজার, রামপুরা, কাকরাইল, শান্তিনগর, মতিঝিল, পল্টন, শাহবাগ, বাংলামোটর, ধানম-ি, নীলক্ষেত, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় সড়ক বিভাজক আছে নামেমাত্র। যেখানে দ্রুত পারাপার ঠেকাতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে মেট্রো রেল প্রকল্পের কারণে যেসব এলাকায় রাস্তা পারাপারে উঁচু বিভাজক ছিল সেগুলো খোলে ফেলা হয়েছে। নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উদ্যোগ জরুরী। এরমধ্যে ইচ্ছেমতো রাস্তা পারাপার ঠেকানো গেলে রাজধানীর সড়কে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা কমে আসবে। তাছাড়া সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করা গেলে ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা থাকবে না। তাই এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জরুরী।
×