ভারতের রাজধানী দিল্লীতে সহিংসতার তৃতীয় দিনে মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলার খবর পাওয়া গেছে। রবিবার রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ২৩ জন নিহত হয়েছে। গত এক দশকের মধ্যে চলমান ঘটনাবলীকে ভারতে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ডিসেম্বরে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন কেন্দ্র করে সংঘাতের সূচনা হয়েছে। বিবিসি, এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়া।
সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লাঠি-রড নিয়ে হামলাকারীরা মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। নিহতদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক আছে। এই সংঘাতে আহত হয়েছে দেড় শতাধিক মানুষ। দফায় দফায় সংঘর্ষে মঙ্গলবার রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল দিল্লীর মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল। দিল্লীতে এমন সহিংসতা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মঙ্গলবার কয়েকটি এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। বিভিন্ন স্থানে মেট্রো স্টেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। উত্তেজনা যেন না ছড়ায়, সেজন্য বেসরকারী টেলিভিশনগুলোকে সংঘাতের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সাবধান করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই উন্মত্ততা বন্ধ করে হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাস করার পর থেকে ভারতের মুসলমানরা ক্ষোভে ফুঁসছে। এই আইন বাতিলের দাবিতে নানা কর্মসূচীও চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি আইনের পক্ষে কর্মসূচী নিয়ে নামলে দেখা দেয় সংঘাত। রবিবার সংঘাত শুরুর পরদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফর শুরু করেন। তার সফরের প্রথম দিনই নিহত হন এক পুলিশ কনস্টেবলসহ চারজন। পরিস্থিতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য বিব্রতকর বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। কেননা ট্রাম্পের সফরের খবর সহিংসতার আড়ালে চলে যায়।
সোমবারের পর কেন্দ্রীয় সরকার ও পুলিশ সহিংসতা দমনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দিল্লী পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ট্রাম্প এ মুহূর্তে রাজধানীতে আছেন বলে শীঘ্রই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ দেন অমিত শাহ, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। মৌজপুর, ব্রহ্মপুরী, ভজনপুরা চক, গোকুলপুরীসহ বিভিন্ন এলাকায় মঙ্গলবার নতুন করে ব্যাপক সংঘাত বাঁধে। মৌজপুরে এক সাংবাদিককে লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়ার খবরও এসেছে। এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও একজন। মৌজপুরে একাধিক গাড়ি ও দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। গোকুলপুরীর বাজারে আগুন দেয়া হয়েছে। দুপুরে সিএএবিরোধী ও সমর্থকদের মধ্যে খ-যুদ্ধে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ভজনপুরা চক। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বহু দোকান। ভজনপুরা, চাঁদবাগ ও কারাওয়ালনগরের রাস্তায় লাঠি ও রড হাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে মানুষ। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে কারবাল নগরে। ভোররাতে সেখানে একটি টায়ার কারখানায় বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরানো হয় বেশ কিছু গাড়িতেও। পুলিশি নিরাপত্তা না পাওয়ায় সেখানে পৌঁছেনি অগ্নিনির্বাপক বাহিনী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশন থেকে সিএএবিরোধীদের হটিয়ে মৌজপুরের দিকে এগোয় পুলিশ। মৌজপুরের বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের নেতৃত্বে সিএএর পক্ষে কর্মসূচী চলছিল। এই বিজেপি নেতা নানা সময়ে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার জন্য সমালোচিত। উত্তর-পূর্ব দিল্লী পাথর হাতে দল বেঁধে থাকা সিএএ সমর্থক একদল স্লোগান দেয় ‘দালালদের গুলি কর’। নিহতদের মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত চারজনের পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন মুসলমান; তারা হলেন রিক্সাচালক শহিদ (২৬) ও দোকানি মোহাম্মদ ফোরকান (৩২)। অন্য দুজন হিন্দু; তারা হলেন পুলিশ কনস্টেবল রতন লাল (৪২) ও বিপণন কর্মকর্তা রাহুল সোলাঙ্কি (২৬)। সহিংসতা দমনে ব্যর্থতার জন্য পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক সমালোচনা চলছে। আগের দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যথেষ্ট পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবারও বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষকারীদের তুলনায় অনেক কম পুলিশই দেখা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ পুলিশ কর্মকর্তারা তুলেছেন বলে খবর প্রকাশ হলেও না ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন দিল্লীর পুলিশ কমিশনার অমূল্য পট্টনায়েক। সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করায় সোমবারই দিল্লীর একাধিক মেট্রো স্টেশন বন্ধ রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবারও জাফরাবাদ, মৌজপুর-বাবরপুর, গোকুলপুরী, জোহরি এনক্লেভ ও শিব বিহার স্টেশন বন্ধ রাখা হয়। উত্তর-পূর্ব দিল্লীর সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: