ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ঘটনায় ছাত্র খেলোয়াড় শিশুসহ এত মৃত্যু কেন?

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দুর্ঘটনায় ছাত্র খেলোয়াড় শিশুসহ এত মৃত্যু কেন?

কি হচ্ছে দেশে? প্রতিদিন রাজপথে আয়ু থাকা শিক্ষার্থী, খেলোয়াড়, শিক্ষক, শিশু, নারী-পুরুষের বাস-ট্রাকের ধাক্কায়, দুর্ঘটনায় মৃত্যু কিছুতেই কোন সুস্থ মানুষ মেনে নিতে পারে না। সেই দুই কলেজ শিক্ষার্থীর ওপর বাস চাপা দিয়ে চলে যাবার পর পুরো ঢাকায় যখন শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিজেরা নিয়ন্ত্রণে নিল, তখন সরকার এবং নাগরিকসহ বাস, ট্রাক মালিক, শ্রমিক, চালকবৃন্দ একটি জোরালো বার্তা পেয়েছিল যেÑ চালকদের বেপরোয়া, বাসে বাসে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং বিভিন্ন রকম যানের যাত্রী ও পথের যাত্রীদের প্রাণ রক্ষার প্রধান লক্ষ্য না হওয়া পর্যন্ত দুর্ঘটনায় নির্মম মৃত্যুর হার হ্রাস করা যাবে না। এ নিয়ে বহু আলোচনা, টকশো হয়েছে। নতুন পরিবহন আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা কমেনি। কিশোর-কিশোরীদের আন্দোলন অথবা ইলিয়াস কাঞ্চনের রাজপথে দুর্ঘটনা হ্রাসের নানা প্রচেষ্টা, উদ্যোগের পর যখন সর্বশেষ পরিবহন আইনটি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, পরিবহন নেতা-মন্ত্রী-সংসদ সদস্য একমত হয়ে প্রণয়ন করা হয় তার কোন সুফল দেখা যাচ্ছে না কেন? বিদেশে যে কোন দুর্ঘটনায় প্রথমে গাড়ি চালককে দায়ী করা হয়। পরে দুর্ঘটনার তদন্ত হয় এবং চালক ও পথযাত্রীর দায় খুঁজে বের করা হয়। বিদেশে বাস বা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, বড় যানবাহন, সে সব যানের চালকের ডান পাশে কোন জানালা থাকে না। বাঁ পাশে যাত্রী ওঠার পাশটিতে যান্ত্রিক দরজাটি যাত্রী ওঠার পর বন্ধই থাকে। বোতাম টিপে হয়ত খোলা যায়, কিন্তু ওদেশের চালক যাত্রী ওঠার সময় ছাড়া এই দরজাটি ব্যবহার করে না। আগেও লিখেছি, বিদেশে চালককে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তার প্রধান শিক্ষাটি হলো- ১. চালকের প্রথম দায়িত্ব রাজপথের মানুষ এবং অন্য যানের যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা, তার নিজের প্রাণ রক্ষা নয়। যেটি বাংলাদেশের চালকেরা প্রধান কর্তব্য মনে করে না। দুর্ঘটনার পর তারা পাশের জানালা দিয়ে লাফিয়ে মুহূর্তে পলাতক হয়ে যায়! ২. বাস চালকের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছেÑ নারী, শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষা করে, বাসে ওঠানো এবং নামতে সাহায্য করা। একই সঙ্গে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বয়স্কদের জন্য, প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট সিটে সমান যতœসহকারে ওঠানো, নামানোরও দায়িত্ব থাকে। কোন চালকের বিরুদ্ধে যাত্রীদের প্রতি কোন রকম আচার-আচরণের অভিযোগ আসলে সাধারণত ওই চালকের চাকরি থাকে না। ৩. রাজপথে, হাইওয়েতে বড় গাড়িটি ছোট গাড়িকে আঘাত করলে বা দুর্ঘটনা ঘটালে, বড় গাড়ির চালককে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এর বিপরীতে আমাদের দেশের চালকদের আচরণ দেখা যাক- ১. কোন এক চালক তরুণ শিক্ষার্থীর হাতকে অন্য বাসের সঙ্গে পিষে ছিঁড়ে ফেলেছে! ২. মহাখালীতে দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে হত্যা করে চলে গেছে অন্য বাসের আগে যাবার প্রতিযোগিতার কারণে! ৩. বাংলামটরে ফুটপাথে দাঁড়ানো এক নারীর পায়ের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে চলে গেছে! ৪. মহাখালীর মোড়ের ফুটপাথে দাঁড়ানো তরুণীর ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়ায় তরুণীটি নিহত হয়! অথচ ফুটপাথে বাস উঠলে এটা সরাসরি চালকের দোষ। এ ক্ষেত্রে চালক হত্যাকারী। ৫. যাত্রাবাড়ীতে এই সেদিন এক কিশোর স্কুলের শেষ দিনের উৎসব অনুষ্ঠান করতে গিয়ে রাজপথে ওঠার পর বাসের ধাক্কায় মুহূর্তে লাশ হয়ে যায়! এ রকম ভবিষ্যত পড়ে থাকা কিশোরের চিরবিদায় কি কোন মা, বাবা, ভাই, বোন সইতে পারে? নাকি কোন সুস্থ মানুষ মেনে নিতে পারে! এ ছাড়া প্রতিদিন হাইওয়েতে অর্থাৎ এক জেলা থেকে অনেক জেলায় যাত্রাপথে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় কত মোটরসাইকেল আরোহী তরুণ যে নিহত হচ্ছে তার কোন হিসাব পরিবহন মালিক, শ্রমিকরা যদি রাখত তা হলে তারা সর্বপ্রথম চালকদের রাজপথে চলাচলকারী মানুষ, অন্য যানের যাত্রীদের, ফুটপাথে দাঁড়ানো মানুষের প্রাণে বাঁচানোর দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত ও সচেষ্ট হওয়ার শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিত। কিন্তু আমরা দেখছি এর বিপরীত চিত্র। দিনে দিনে অমানবিক চালকদের দৌরাত্ম্যে, বিচারহীনতার সুবিধা ভোগ করার কারণে এবং সর্বোপরি মানুষের প্রাণের প্রতি চালকদের বিন্দুমাত্র সংবেদনশীলতা, মায়া, দয়া না থাকার কারণে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধিই পাচ্ছে, যা সান্ত¦নাহীন এবং আমাদের জন্য খুবই দুঃখের কারণ। পাঁচ-ছয় বছর আগে আমাদের এক তরুণ উঠতি ক্রিকেটার কুষ্টিয়ার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। সম্প্রতি জাতীয় হ্যান্ডবলের গোলরক্ষক সোহান নামের তরুণ এক সঙ্গীসহ সম্ভবত বাসের ধাক্কায় তাদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়ায় নিহত হয়! এ ছাড়া না জানা, অচেনা এসএসসি শিক্ষার্থী যারা পরীক্ষা দিচ্ছে কত স্বপ্ন নিয়ে, তাদের বেশ ক’জনের মৃত্যুর খবরে প্রাণ কেঁদে ওঠে। কেননা, ওরা যে ওদের মা-বাবার কষ্ট-দুঃখ দূর করতে, জাতিকে উন্নয়নের পথে নিতে কত বাধা অতিক্রম করে শিক্ষার একটা প্রধান স্তর উত্তীর্ণ হচ্ছিল, তা ভেবে দুঃখ রাখার জায়গা পাই না। এদের মৃত্যু পরিবারকে শূন্য করে দেয়। যারা মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া শেষ করেছে তারা উচ্চ শিক্ষার যে কোন একটি ক্ষেত্রে প্রবেশ করে পরিবার ও দেশকে অনেক কিছু দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। মধ্যপথে ওদের ঝরে পড়া, তাও কোন রোগ-অসুস্থতায় নয়, একটা অমানবিক, হৃদয়হীন চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যÑ এটা কোনমতেই সহ্য করতে পারি না। শিশু শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গত দু’সপ্তাহে মা, বাবা, সন্তান, পরীক্ষার্থী, কলেজ ছাত্র, সিএনজি যাত্রী অনেকে মারা গেছেন, যাদের বেঁচে থাকার কথা ছিল। সিএনজির সব যাত্রী কেন দুর্ঘটনায় পড়লে মারা যায়, এটি আমি বিশেষভাবে খেয়াল করে দেখেছি। আগে সিএনজি বা বেবিট্যাক্সি ছিল দু’দিকে খোলা, ধাক্কা লাগার আগেই সামনের অবস্থা দেখে বাঁ পাশে যাত্রীরা নেমে যেত। ফলে সব যাত্রী মারা পড়ত না, অনেকেই বেঁচে যেত। বর্তমানে ছিনতাই-মলম পার্টির উৎপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে শুনেছি সিএনজির দু’পাশ গ্রিল দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে সিএনজিতে চড়ি বলে লক্ষ্য করেছি, সিএনজির যাত্রীর বাঁ পাশের দরজার ছিটকানি খুলতে, লাগাতে হয় চালকের দিক থেকে! অর্থাৎ সিএনজির চালকের দু’পাশের দুটি ছিটকানি খোলা ও বন্ধ করার খিলটি চালকের দিকে। যাত্রীর দিকে একটিরও খোলার ব্যবস্থা নাই! অথচ, বাঁদিকে যাত্রীর পাশের ছিটকানিটির খিল খোলার ব্যবস্থা যাত্রীর দিকে যদি থাকত, যাত্রী আসন্ন বাস, ট্রাক দেখে অনেক ক্ষেত্রে খিল খুলে নেমে পড়তে পারত। এটি সামান্য কাজ। যাত্রীর বাঁ পাশের ছিটকানিটির মুখটি যাত্রীর দিক থেকে খোলার ব্যবস্থা রাখার জন্য শুধু মুখটি ঘুরিয়ে যাত্রীর দিকে করে দিলে অনেকেই প্রাণ রক্ষা করতে পারবে। বিশেষত তরুণরা তো ঝট করে খিলটা খুলে বাঁ পাশে লাফ দিতে পারবে। আমার এই পরামর্শ যত সিএনজিতে উঠেছি সব চালককে বলেছি, ওরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিল যে, এতে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে যাত্রীর প্রাণ। শেষ পর্যন্ত আমি দুটো সিএনজি পেয়েছি, যে দুটোর ছিটকানির মুখ যাত্রীর দিক থেকে খোলার ব্যবস্থা রয়েছে। সিএনজি মালিকরা তাদের সব সিএনজির ছিটকানির মুখটা যাত্রীর দিক থেকে খোলার ব্যবস্থা করলে যাত্রীর প্রাণহানি কম হবে বলে মনে করি। যাই হোক, সবচেয়ে বড় কথা, চালকদের হৃদয়বান, মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, একই সঙ্গে গাড়ি চালনার উন্নতমানের প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ চালক হয়ে নিয়ম মেনে গাড়ি চালালে অনেক দুর্ঘটনাই এড়ানো যেতে পারে। রাজপথে উন্মাদের মতো গাড়ি চালিয়ে রাস্তা পার হওয়া নারী, তরুণকে চাপা দিয়ে চলে যেতে মানবিক চালকরা পারবে না। তার মধ্যে বিবেক, দায়িত্ববোধ থাকলে সে অকারণ দুর্ঘটনাগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হবে। সবশেষে, অমানবিক, নিয়মবিধি ভঙ্গকারী বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চালকদের কঠোর দ-ের ব্যবস্থা থাকলে চালক আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে গাড়ি চালাবে- এটাই সবার কাক্সিক্ষত। চালকদের বুঝতে হবে, তাদেরও স্বজন, ছেলেমেয়ে, মা, বাবা অন্য নিয়মবিধি ভাঙ্গা চালকদের হাতে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত, আহত হতে পারে। নিজের জন্য আমরা যা চাই অন্যের জন্যও তা চাইলে তবেই অবস্থার উন্নতি হবে। উন্নত দেশের অবস্থানে যেতে হলে বাংলাদেশকে রাজপথের দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনায় নিহত, আহত হওয়ার ঘটনা হ্রাস করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×