ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

লেখালেখি স্বামীর অপছন্দ, তাই ছদ্মনামে প্রথম বই, অব্যক্ত বেদনা

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

লেখালেখি স্বামীর অপছন্দ, তাই ছদ্মনামে প্রথম বই, অব্যক্ত বেদনা

মোরসালিন মিজান ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রায় শেষ হতে চলল। এর পরও নতুন বই আসা থেমে নেই। প্রতিদিন আসা বইয়ের পেছনেও আছে অনেক গল্প। মেলা ঘুরে তেমন একটি গল্পের খোঁজ পাওয়া গেল সম্প্রতি। তার আগে বলি, এখন বিখ্যাত লেখকরাও তাদের সদ্য প্রকাশিত বই হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরছেন। ঘ্রাণ শুঁকছেন। মলাটে নিজের নাম বারবার ছাপা হচ্ছে। তবুও মুগ্ধ চোখে নিয়ে দেখছেন। বই হাতে টেলিভিশনে কথা বলছেন নিয়মিত। এবার পূর্বের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র এখানে। দূর গাঁয়ের কোন এক গৃহবধূর জীবনের প্রথম বইটি মেলায় এসেছে ছদ্মনামে। স্বনামে লেখার সাহস তার নেই। এক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত বই এখনও চোখে দেখেননি তিনি। ঘ্রাণটি কেমন, জানেন না। মনে মনে ভীষণ খুশি। তারও বেশি আতঙ্ক তাড়া করছে তাকে। কারণ স্ত্রীর লেখালেখি একদমই পছন্দ করেন না স্বামী। এসব আমার এখানে চলবে না বলে সাবধান করে দিয়েছেন। অতঃপর পতিদেবতা কাজে বের হলে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের জন্য লেখা। সেসব লেখারই কিছু আলাদা করে নিয়ে এ বই। শিরোনাম ‘আকাশটা দূরে নয়।’ লেখিকা বইয়ের শিরোনামে আকাশ শব্দটি রেখেছেন, নিজের ছদ্মনামের বেলায়ও তা-ই। ‘মেঘলা আকাশ’ নামে লিখেছেন তিনি। বোঝার বাকি থাকে না, নারী মুক্তির চির আকাক্সক্ষা থেকে সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনে আকাশ শব্দটি দু’বার ব্যবহার করা হয়েছে। বইয়ে ২০টির মতো রচনা। লেখিকার ভাষায়, কাব্যধর্মী অনুগল্প। নবীন প্রয়াস সাহিত্যের বিচারে কতটা মূল্য পাবে তা সময় বলবে। তবে বর্তমানে পড়তে গিয়ে উপলব্ধি হয় এগুলো শুধু গল্প নয়, অব্যক্ত বেদনা। নারী মুক্তির এখনও কত বাকি, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নানা চরিত্রের আশ্রয়ে মেঘলা আকাশ যে গল্প বুনেন, সেখানে নারী অধিকার সমতার ভাবনা কিংবা মানববিক চাওয়ার কোন মূল্য নেই। কষ্টসাধ্য অনুসন্ধান বলছে, মেঘলা আকাশ নাম ধারণ করা লেখিকা থাকেন বরিশালের এক চরাঞ্চলে। গাঁয়ের মেয়ে হলেও, স্কুল জীবন থেকেই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার প্রতি ঝোঁক। স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গাইতেন। সুন্দর নাচতেন। তারও বেশি আগ্রহ বই পড়ায়। পড়তে পড়তেই লেখার আগ্রহটা জন্মে। কিন্তু হঠাৎই এক ঝড় এসে তার সব ল-ভ- করে দেয়। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাল্যবিবাহের বলি হন তিনি। স্বামীর সঙ্গে বয়সের তফাত অনেক। এর পরও কবুল বলতে বাধ্য হন। নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্বামীটি তাকে ঘরে তুলেন। তখন থেকেই ভগ্নহৃদয়। লাঞ্ছনা গঞ্জনার জীবন। স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যেতে থাকে। অচিরেই দু’ সন্তানের মা হন তিনি। মেঘলা আকাশের নাচ বন্ধ হয়ে যায়। গান করা বারণ। এ অবস্থায় লিখেই মনটাকে হাল্কা করার চেষ্টা করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটা ওটা লিখতে শুরু করেন। জানার পর তার হাতের এনড্রয়েড ফোনটি কেড়ে নেয়া হয়। ফেসবুকে লগইন করা যায় নাÑ এমন ফোন দেয়া হয় ব্যবহারের জন্য। মেঘলা আকাশ, জানা যায়, স্বামী নিজের কাজে ঘরের বাইরে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতেন। নিজের জন্য লেখা। কোনদিন ছাপা হবে, ভাবেননি। কিন্তু সব জেনে এগিয়ে আসেন কয়েকজন নিকটাত্মীয়। লেখিকাকে উৎসাহ যোগাতে বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন তারা। বই মেলায় আসার পর লেখিকা বিষয়টি জানতে পারেন। মেঘলা আকাশ তার আকাশটা যেন হাতে পেয়ে যান! কিন্তু উচ্ছ্বাস বেশি সময় ধরে রাখতে পারেননি। ভয়ে গুটিয়ে যান। তার সঙ্গে ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়। কথা বললে জানাজানি হয়ে যাবে। এই ভয়ে চুপ তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজের পর নিকটাত্মীয়দের একজনকে মেলায় পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মেয়েটা নিজের আপ্রাণ চেষ্টায় গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু তার অস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। মায়ের উৎসাহে লেখালেখি করত। সে মা-ও বেঁচে নেই। স্বামী সংসার তাই একমাত্র অবলম্বন। এ অবলম্বন হারাতে চায় না সে। যা আছে তা নিয়েই থাকতে চায়। এ কারণেই বইয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে চায় না। তিনি বলেন, বই প্রকাশিত হয়েছে এটাই আমাদের বড় পাওয়া। সব বইয়ের লেখকের নাম থাকে। সুন্দর ছবিসহ লেখক পরিচিতি থাকে। আমাদের লেখিকার বেলায় তেমন কিছুই করা গেল না। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে তিনি বলেন, আক্ষেপ নেই। এটুকু তো হলো। বইটির সাহিত্য মূল্য কী হবে, জানি না। তবে প্রতিকূল পরিবেশ লেখার জন্য ও যে যুদ্ধ করছে, তার মূল্য আমাদের কাছে অনেক। তার চর্চাকে উৎসাহিত করতেই বইটি প্রকাশ করেছি। প্রথম প্রকাশের পর লেখিকার অনুভূতি জানতে পেরেছেন কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, হাউমাউ করে কাঁদছিল। এটা আনন্দের কান্না। তবে এরই মাঝে বই বের হওয়ার খবর তার অন্য আত্মীয়দের কেউ কেউ জানতে পেরেছেন। বই পৌঁছে গেছে তাদের হাতে। এর ফলে লেখিকা আতঙ্কে আছে বলে জানান তিনি। নিকটাত্মীয়দের অর্থে বইটি প্রকাশ করেছে জিনিয়াস পাবলিকেশন্স। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হাবিবুর রহমানও এ পর্যায়ে আপ্লুত। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা তো শহর নিয়ে থাকি। অথচ গ্রামে একজন নারী এত বাধার মুখেও লেখার অভ্যাস বাঁচিয়ে রেখেছেন। ভবিষ্যতে মেঘলা আকাশ চাইলে তার আরও বই ছাপবেন বলে জানান তিনি। এবার ‘আকাশটা দূরে নয়’ প্রসঙ্গে ফেরা যাক। বইটিতে মোট ২০টি গল্প। গল্প? নাকি জীবনের জলছবি? প্রতিটি গল্পে নারীর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। দীর্ঘশ্বাস। একটি গল্পের মূল চরিত্রটি বর্ণনা করতে মেঘলা আকাশ লিখেছেন, ‘এতসব ফুলের মাঝে একটা মিষ্টি ফুল ছিল চাঁপা। এই চাঁপাফুল কুঁড়ি থাকা অবস্থাতেই এক দুষ্টু ভ্রমরের খপ্পরে পড়ে, আর তেমন কোন দখিনা বাতাসের দেখা পায়নি, পায়নি মৌসুমি বৃষ্টির ছোঁয়া। অন্য ফুলগুলো যখন জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় সারাদেহ ভিজিয়ে নিয়ে তারাদের সঙ্গে গান করত, এই চাঁপাফুলটা তখন বদ্ধ ঘরে ঢুকরে কাঁদতোÑ খুব নীরবে সংগোপনে। যদি এই কান্নার জলগুলো সে ছড়িয়ে দিতে পারত তবে আরেকটা প্রশান্ত মহাসাগর তৈরি হতো।’ চরিত্রটির ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে এর পরের অংশে তিনি লিখেছেন, ‘ভেসে যেতে পারে সেই কালো বন। বনের সব ফুল।’ একটি গল্পে ২০১৩ সালের ফ্ল্যাশব্যাক। মূর চরিত্রের নাম নূরী। চরিত্রটি তার প্রিয় পোষা টিয়া পাখি স্বামীর ঘরে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু স্বামীর তা মোটেও পছন্দ নয়। চতুর্থ দিন ঘুম থেকে দেখল, পাখিটি মারা গেছে। আসলে তার স্বামী মরিচ গুলানো পানি জোর করে ঠোঁটে দিয়ে একে হত্যা করেছে। মেঘলা আকাশ লিখেছেন, ‘নূরী কিছুই বলতে পারল না। কারণ এই লোকটাই দিন শেষে তার স্বামী।’ ‘চিতায় বসবাস’ নামের গল্পটিতেও মূল চরিত্র নূরী। এ নূরী রান্না বান্না ঘর গৃহস্থালি সব করে। কুয়ো থেকে জল তুলে আনে। আলনা আলমারি মুছে পরিষ্কার করে। ‘অথচ নিজের ভেতরে জমে প্রলেপ পড়তে থাকা মনের দুঃখগুলো সে মুছতে পারে না।’ স্বপ্নগুলোকে নিজ হাতে গলাটিপে মারে আরেক চরিত্র নন্দিনীও। মেঘলা আকাশের বর্ণনায়: ‘নন্দিনী কখনই খুব একটা সাজে না। তবুও ওর আজ সাজতে ইচ্ছে হলো, খুব। ইচ্ছে হলো চোখে কাজলের রেখাটা হোক না একটু গাঢ়। কিংবা ছুঁয়ে যাক না ঠোঁট একটুখানি আকাশ রঙের লিপগ্লোসে। নন্দিনী পরক্ষণেই মনকে বোঝায়... আর সাজে না।’ ‘মায়া’ গল্পটির মূল চরত্রটির নাম সালেহা। সালেহার জীবন বড় একঘেঁয়ে শাসনের নাম করে ঘরবন্দী জীবন। পদে পদে চোখ রাঙানি, সুখ ভালবাসার সঙ্গে জন্মগত বৈপরিত্য নিয়ে এখন স্বামীর ঘরে এসেও একটু সহানুভূতি নেই। তবুও জোড়াতালির এই সংসারে কেউ জানে নাÑ সেই গোপন ব্যথা। জানতে দেয় না সালেহা। সন্তানের কথা ভেবেই সালেহা সব সহ্য করে। সালেহা মনকে বোঝায়Ñ ‘সয়ে যাওয়া আর মেনে নেয়ার নামই জীবন।’ অন্য একটি গল্পে আকাশ ধরার ব্যর্থ চাওয়া। মেঘলা আকাশ লিখেছেন, ‘আমি অনেকটা পথ দৌড়ে আকাশ ধরতে গেলাম, ওমনি আকাশটা আরো দূরে সরে গেল।’ ‘নিয়তি’ শিরোনামের গল্পে নায়িকার বলাটি এরকম: ‘একদিন জানি কী হলো! সেই পাতাটা ছিঁড়ে ফেললো বনের এক পাঁজি মালি। কঠিন নিঠুর রুষ্ট হাতে পাতাটা সে ছিঁড়ে নিল। এক পলকেই ঝরল পাতা। বন্দী এখন সে পালি মালির খপ্পরে। পাতার সে আর সাধ্য নেই মুক্তি খোঁজে।’ নায়িকার ওপর স্বামীর নির্যাতনেরও আভাস পাওয়া যায় এ গল্পে। একই কথার প্রতিধ্বনি করে অন্যত্র লেখা হয়েছে, ‘কেরোসিনের তেলে একটা কাপড়ের সলতে নিজেকে পুড়িয়ে সারা ঘর আলোকিত করে।’ এভাবে প্রতিটি গল্প লেখিকার জীবনের দীর্ঘশ্বাসকে ধারণ করে। একইসঙ্গে ফুটিয়ে নারী স্বাধীনতা বিরোধী নিষ্ঠুর সমাজ সংসারের চিত্র। তবে আলোর নিচের অন্ধকারটুকু দেখানো হলেও, ‘আকাশটা দূরে নয়।’ সে আকাশ নিশ্চয়ই একদিন ধরা দেবে। ধরা দিক, আমাদের তা-ই প্রত্যাশা।
×