ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী

একুশের গ্রন্থমেলা ॥ প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

একুশের গ্রন্থমেলা ॥ প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে প্রতিবছর ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে ইতিহাস বিজড়িত সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে একুশের বইমেলা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মেলার পরিধি, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পাঠক, শিশুরা আগ্রহী হয়ে উঠছে বইয়ের প্রতি। বইমেলা পরিণত হয়েছে জনমেলায়। মেলাকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে ফুলের ব্যবসা থেকে শুরু করে খাবারের ব্যবসা পর্যন্ত। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিকশিত হচ্ছে কবিমন। পেশাদার লেখক থেকে শুরু করে মৌসুমি লেখকদের বই দেখা যাচ্ছে প্রতিটি স্টলে। বিগত দশ বছরে হাজারও নতুন কবি-সাহিত্যিক, রম্য লেখক, রাজনীতি বিশ্লেষক তৈরি হলেও পাঠক হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন কতজন? প্রকাশিত বইয়ের লেখার মান যাচাই ছাড়াই যে কোন লেখক তার বই বইমেলায় বিক্রি করছেন। মেলায় গেলে ঘোষণাকক্ষ থেকে ভেসে আসে নানা বই এবং লেখকের নাম। মাঝে মাঝে খুব অশ্লীল বইয়ের নাম কানে ভেসে আসে। একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাতটায় কানে ভেসে আসল এমনি একটি বইয়ের নাম ‘পাশের বাসার ভাবি’। এ রকম অসংখ্য অশ্লীল নামের বই দেখা যায় একুশের বইমেলায়। সবচেয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা কৌতুকের বইয়ের। শতাধিক কৌতুকের বইয়ের লেখককে অনেক চেষ্টা করেও চিনতে পারলাম না। পুরনো জোকস বই থেকে জোকস নিয়ে নিজের নামে নতুন বই ছাপানো নিশ্চয়ই ভাল লক্ষণ নয়। একটি নতুন জোকস তৈরি করতে কি পরিমাণ সময় এবং ভাবনা লাগে তা শুধু একজন জোকস লেখকই জানেন। নকল জোকস বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে নতুন জোকস বই। তবে অনেকটা ভাল লাগার বিষয় যারা সরাসরি জোকস নিয়ে রেডিও, টেলিভিশন এবং মঞ্চে কাজ করেন তারা বইমেলায় নতুন জোকস বই নিয়ে হাজির হয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি বই ছাপা হয়েছে এবারের বইমেলায়। কিন্তু একই লেখা বিভিন্ন বইয়ে প্রকাশ, নতুন কোন তথ্য সন্নিবেশ না থাকা, নি¤œমানের ভাষার প্রয়োগ বঙ্গবন্ধুকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেয়ে মনে হয়েছে লেখকগণ নিজেদের প্রকাশে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বেশিরভাগ লেখকই কোন ধরনের গবেষণা করেছেন বলে বই পড়ে মনে হয়নি। জাতির জনককে নিয়ে লেখা বইগুলোর বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে পাঠক মনে করেন। সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি লোকমুখের কথা স্মরণ করতে চাই। লোকমুখে আছে, ‘পুরান ঢাকায় কাক বেশি নাকি উকিল বেশি দেখা যায়।’ বইমেলায় গেলে তেমনই পাঠকমুখে শোনা যায় ‘বইমেলায় পাঠক বেশি নাকি কবি এবং কবিতা বেশি।’ ছোটবেলায় ভাবতাম কবিতা লেখা মনে হয় সবচেয়ে কঠিন কারণ কবিদের মাত্রাজ্ঞান বেশি থাকার পাশাপাশি তারা সব সময় ভবিষ্যত ভাবনাগুলো পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দেন। কবিতাগুলো পদ্য বা গদ্য রীতিতে লেখা হতো। তাই তো শত বছর আগের কবিতাগুলো এখনও পাঠক হৃদয়ে দোলা দেয়। কিন্তু বর্তমানে অনেক কবির কবিতা পড়লে তাদের মাত্রাজ্ঞান নিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্নের জন্ম দেয়। একটি বা দুটি কবিতার বই বের করেই নিজেকে কবি দাবি করা কবিদের প্রতি বিনম্র চাওয়া আপনারা প্রবীণ কবিদের সান্নিধ্যে থেকে কবি এবং কবিতা সম্পর্কে মাত্রাজ্ঞান অর্জন করবেন। হাজারো উপন্যাসের ভিড়ে পাঠক মনে জায়গা করে নেয়া উপন্যাসের সংখ্যা খুবই কম। ঔপন্যাসিকরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থেকে অথবা সমাজের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে পুঁজি করে সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে নতুন নতুন উপন্যাস নিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির হন। এক একটি উপন্যাস সমাজের এক একটি দর্পণ মনে করা হয়। উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় চোখ বুলালে ভেসে ওঠে সমাজের বাস্তব চিত্র। ধর্মীয় গোড়ামি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সমাজ সংস্কারকদের কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে হাজারো গল্প উপন্যাস। লাল সালু পড়ে আমরা যেমন জানতে পারি গত শতাব্দীর ধর্মীয় গোড়ামির কথা তেমনি লাইলী মজনু পড়ে জানতে পারি মধ্যপ্রাচ্যের বালুময় দেশের দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার অমর প্রেমের করুণ কাহিনী। একুশের বইমেলায় পাঠক আবিষ্কার করেছেন হিমু, মিসির আলীর মতো কালজয়ী চরিত্রকে। কিন্তু বিগত দশ বছরে কতজন হিমু বা মিসির আলীর জন্ম হয়েছে একুশের বইমেলায়। এখনও পাঠক বইয়ের স্টলে গিয়ে পুরনো লেখকদের বই খুঁজতে থাকে যেটা বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের জন্য অবশ্যই অবমাননাকর। তাদের নতুন নতুন ভাবনা ভাবতে হবে। খুঁজতে হবে পাঠক হৃদয় কি চাই। এক একজন লেখককে হতে হবে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনার দিশারী। লিখতে হবে মানুষ নিয়ে, সমাজ নিয়ে এবং রাষ্ট্র নিয়ে । গল্প বা উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় যেন সমাজের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। ঔপন্যাসিক বা গল্পকারগণের নিকট থেকে আরও ভাল ভাল লেখা পাঠক প্রত্যাশা করে। সস্তা এবং জনপ্রিয় বই নয়, মেধা মনন বিকশিত হয় এমন গল্প বা উপন্যাস চাই। প্রতি বছর না হোক কয়েক বছর পর পর যেন একজন হিমু বা মিসির আলীর আবিষ্কারক পাই। ছাত্রজীবনে একটা কথা শুনতাম বিজ্ঞানে অজ্ঞান। এই ভয়েই অধিকাংশ দুর্বল চিত্তের ছাত্ররা বিজ্ঞানবিমুখ ছিলেন। মাধ্যমিক স্তরে এক আতঙ্কের নাম ছিল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে মনে করা হতো জ্ঞানবান ছাত্রদের বিষয়। কিন্তু বিগত বিশ বছরে আমজনতাকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার পেছনে একুশের বইমেলার ভূমিকা অনেকটাই লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞানবিমুখ জাতিকে বিজ্ঞানমুখী করেছেন এদেশের স্বনামধন্য কয়েকজন লেখক। বিজ্ঞানের পাশাপাশি থ্রিলারের সমন্বয় ঘটিয়ে পাঠকদের একুশের বইমেলায় টানতে সক্ষম হয়েছেন। একুশের বইমেলায় নতুন নতুন কবিতার বইয়ের চেয়ে বিজ্ঞানবিষয়ক বই বেশি ছাপা হলে আগামী প্রজন্ম বিজ্ঞানমুখী হবে। বিজ্ঞানমুখী একটি প্রজন্ম বদলে দিতে পারবে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেলের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন এদেশের তরুণরা। বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করবেন আগামী প্রজন্ম। চোখে চোখ রেখে লড়াই করবে বিশ্বের সকল বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। তার জন্য শুধু দরকার একটি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখকদের প্রজন্ম। আমাদের অহঙ্কার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বইমেলায় পাওয়া যায় হাজারো বই। মুক্তিযুদ্ধ যেমন গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা লেখেন তারাও সমাজের গৌরব করার মতো স্বনামধন্য মানুষ। এই মানুষগুলো শুধু লেখক নন, তারা গবেষকও বটে। তাদের গবেষণার জন্যই আমরা খুঁজে পেয়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য এবং অজানা বীরদের। নারী বীরপ্রতীক তারামন বিবির বিরত্বগাথা তারাই প্রথমে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। আমার বন্ধু রাশেদ এর মতো হাজারো বীর বন্ধুদের হাজির করেছেন বইয়ের পাতায়। মুক্তিযুদ্ধের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর মহান দায়িত্ব তাদের কাঁধে। তাদের দেখানো সঠিক ইতিহাস এ প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানা প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলবে। একুশের বইমেলার মাধ্যমে সেতুবন্ধন হয়েছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কবি-সাহিত্যিক-গবেষক-আলোচক এবং সমালোচকদের মধ্যে। ভিন্ন দেশে বসবাসরত ভিন্নমতের লেখকদের ভিন্ন ভিন্ন লেখা পড়ে অধিকতর সমৃদ্ধ হচ্ছে এ দেশের পাঠক সমাজ। একুশের বইমেলা আজ আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। বইমেলার ভিড়ে দেখা যায় সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান থেকে শুরু করে কালো চামড়ার আফ্রিকান পাঠক/দর্শককে। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লাগে একুশের বইমেলার প্রবেশ পথের সামনেই খাবারের দোকান দেখে। ভোজন রসিক বাঙালীরা বই কেনার পাশাপাশি ভোজন রস ভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রবেশ পথের পাশে খাবারের দোকানগুলো একুশের বইমেলার সঙ্গে বড্ডই বেমানান লাগছে পাঠকদের কাছে। এ যেন কবিতার মাঝে রাজনৈতিক আলখ্যের প্রতিচ্ছবি। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পাঠকদের জন্য মেলার শেষ প্রান্তে খাবারের দোকানগুলো থাকলে হয়তবা ভাল হতো। বিজ্ঞাপনের ভিড়ে একুশের বইমেলাকে বড্ড বেশি কর্পোরেট মেলা মনে হয়। আয়োজকদের মনে রাখতে হবে এটা যতটানা কর্পোরেট মেলা তারচেয়ে বেশি আবেগের মেলা। বায়ান্নর আবেগ এবং চেতনাকে নিয়ে ব্যবসা না করলেই কি হয় না। ব্যাংক থেকে লুটেরারা নিয়েছে লুটে হাজারো কোটি টাকা। সেখানে না হয় ষোলো কোটি বাঙালীর আবেগের মেলা প্রাণের মেলা ভাষার মেলা একুশের বইমেলার জন্য সরকারের না হয় কয়েক কোটি টাকা গচ্ছা যাক। যে চেতনা থেকে একুশের বইমেলায় শুরু হয়েছিল সে চেতনা বজায় থাকুক মেলায়, তৈরি হোক কালজয়ী লেখক, সমাজ বদলের কবি, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গবেষক, বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক। এ প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মিল খুঁজে ফিরি প্রতিটি বইমেলায়। লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×