ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইনিংসে জয়ের সম্ভাবনা বাংলাদেশের

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  ইনিংসে জয়ের  সম্ভাবনা  বাংলাদেশের

মিথুন আশরাফ ॥ দ্বিশতক হতেই মুশফিকুর রহীম আকাশের দিকে লাফিয়ে, শূন্যে ভেসে উল্লাস করার পরই দুই হাত দিয়ে বাঘের থাবার মতো ভঙ্গি করেন। একের পর এক ম্যাচে শতক না পাওয়ার হতাশা যে ভালভাবেই দূর হয়েছে, সেই ইঙ্গিত দিয়ে দেন। মুশফিকের (২০৩*) এই অসাধারণ ইনিংসের সঙ্গে অধিনায়ক মুমিনুল হকের (১৩২) দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে জয়ের পথে তো হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি ইনিংস জয়ের সুবাসও পাচ্ছে। আজই সেই জয় মিলেও যেতে পারে। তৃতীয় দিন শেষে প্রথম ইনিংসে ২৮৬ রানে এগিয়ে থাকাতেই সেই আশা দেখা হচ্ছে। এই রান করার আগেই জিম্বাবুইয়ের হাতে থাকা ৮ উইকেট তুলে নেয়া গেলেই তো হয়ে গেল। ইনিংস ব্যবধানে জয় মিলে যাবে। দুপুর হতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে! আকাশ কালো হয়ে আসে। বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবার বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে তো জয়ের আশা তৈরি করা জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে একমাত্র টেস্ট ড্র হয়ে যাবে। এত সুন্দর ব্যাটিং করার পরও যদি এমন হয়, তাহলে হতাশাই যুক্ত হবে। কিন্তু আকাশ কালো করে এলেও সোমবার বৃষ্টি আর আসেনি। খানিক অন্ধকার হলেও কৃত্রিম আলোয় খেলা চালানো হয়। তাতে মুমিনুলের পর মুশফিক দলকে রানের পাহাড় গড়ার দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। মুশফিকের দ্বিশতক হওয়ার পর ৬ উইকেট হারিয়ে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫৬০ রান গড়ে ইনিংস ঘোষণা করে দেয় বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ে প্রথম ইনিংসে ২৬৫ রান করায় প্রথম ইনিংসেই ২৯৫ রানে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। মুশফিক ও মুমিনুল জোড়া সেঞ্চুরি করার সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে ২২২ রানের জুটিও গড়েন। তাতে বড় স্কোরই দাঁড় হয়। এরপর জিম্বাবুইয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে ২ উইকেট হারিয়ে ৯ রান করায় তৃতীয়দিন শেষে বাংলাদেশ ২৮৬ রানে এগিয়ে রয়েছে। আর তাতে করে জয়ের সম্ভাবনাই উজ্জ্বল হয়ে গেছে। নাঈম হাসান (২/৪) যেভাবে প্রথম ওভারেই টানা দুই বলে ২ উইকেট নিয়ে ফেলেন, তাতে আজই জিম্বাবুইয়ে অলআউট হয়ে যেতে পারে। তা ২৮৬ রান করার আগেই। এমনটি হলেই তো বাংলাদেশ ইনিংস ব্যবধানে জিতে যাবে। যদি কোনভাবে পিছিয়ে থাকা ২৮৬ রান করেও ফেলে জিম্বাবুইয়ে, তাহলেও খুব বেশি রান যে বাংলাদেশকে টার্গেট দিতে পারবে না, তা প্রথম ইনিংসে তাদের ব্যাটিং থেকেই বোঝা গেছে। এই টেস্টে বাংলাদেশই যে জিততে যাচ্ছে, তা নিশ্চিতই বলা যায়। প্রথমদিন থেকেই আসলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাটিং নির্ভর উইকেট। বাংলাদেশ বোলাররা ভাল বোলিং করার পরও যখন জিম্বাবুইয়ে অধিনায়ক ক্রেইগ আরভিন ১০৭ রান করতে পেরেছেন, তখনই বোঝা যায়, ব্যাটসম্যান ভুল না করলে আউট করা কঠিন। দ্বিতীয়দিন নাজমুল হোসেন শান্তর (৭১) পর মুমিনুল ও মুশফিক মিলে দিন শেষ করেন। মুমিনুল সেঞ্চুরি থেকে ২১ রানে দূরে থাকে ও মুশফিক ৩২ রানে অপরাজিত ছিলেন। দলও দুই সেশনের বেশি ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে ২৪০ রান করে ফেলেছিল। জিম্বাবুইয়ের চেয়ে ২৫ রানে পিছিয়ে থেকে তৃতীয়দিন ব্যাটিং শুরু করেন মুমিনুল ও মুশফিক। দুইজন মিলে অনায়াসেই প্রথম সেশন শেষ করেন। জিম্বাবুইয়ে বোলারদের কোন সুযোগই দেননি। সাবলীলভাবে ব্যাটিং করতে থাকেন। জিম্বাবুইয়ের প্রথম ইনিংসে গড়া রান দ্রুতই অতিক্রম করে ফেলে বাংলাদেশ। এরপর শুরু হয় বড় রান সংগ্রহ করার পালা। সেই পথে মুমিনুল-মুশফিক জুটি এগিয়েও যেতে থাকে। দেখতে দেখতে দলের রান ৩০০ হয়। দুইজনের জুটি থেকে শতরান এসে পড়ে। মুমিনুল এরমধ্যে নিজের ক্যারিয়ারের নবম টেস্ট সেঞ্চুরিও করে ফেলেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওপেনার তামিম ইকবালই শুধু দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৯ সেঞ্চুরি করতে পেরেছিলেন। এবার ১৫৬ বলে সেঞ্চুরি করে মুমিনুলও সেই আসনে আসীন হন। মধ্যাহ্ন বিরতির আগেই মুমিনুল সেঞ্চুরি করে ফেলেন। টেস্ট শুরুর আগে বলেছিলেন, ‘কথা দিলাম সেঞ্চুরি হবে।’ মুমিনুল সেই কথা রাখেনও। ২০১৮ সালের নবেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সর্বশেষ সেঞ্চুরি করেছিলেন মুমিনুল। এর আগ পর্যন্ত মুমিনুলের সময়টি খুব ভালই যাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে দল যেমন ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যায়, মুমিনুলও একই পথের পথিক হন। আবার সাকিব আল হাসান ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ থাকায় মুমিনুলের কাঁধে নেতৃত্বের ভার পড়ে। এই ভার যেন নিতে পারছেন না মুমিনুল। এমন কথাও উঠে। কিন্তু মুমিনুল সবকিছুকে পেছনে ফেলে আবার নিজের ধারায় ফিরলেন। টেস্ট স্প্যাশালিস্ট ব্যাটসম্যান ধরা হয় মুমিনুলকে। তিনি টেস্ট মেজাজে ব্যাটিং করেই আবার এক বছর পর সেঞ্চুরির দেখা পেলেন। সেই সেঞ্চুরি আসল আবার বলে কয়ে। করবেন বলেছেন। করেও দেখিয়েছেন। মুশফিকও একই তালে ব্যাটিং করতে থাকেন। হাফসেঞ্চুরি করার পর প্রথম সেশনেই সেঞ্চুরি করার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু ১ রানের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। তবে দ্বিতীয় সেশনে নামতেই ক্যারিয়ারের সপ্তম টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলেন। ২০১৮ সালের নবেম্বরে মিরপুরে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে দেশের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ অপরাজিত ২১৯ রান করার এক বছর পর সেঞ্চুরি করলেন মুশফিক। সেই ম্যাচটিতেও জিতে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচেও মুমিনুলের শতকের পর মুশফিক দ্বিশতক হাঁকান। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৫২২ রান করেছিল। মুমিনুল-মুশফিক মিলে জিম্বাবুইয়ে বোলারদের এবারও ভোগাতে থাকেন। সেই ভোগান্তি জিম্বাবুইয়ের বাড়তেই থাকে। দ্বিতীয় সেশনে গিয়ে ৪০০ রানও স্কোরবোর্ডে যোগ হয়ে যায়। ৩৭২ রান যখন হয়, তখনই দুইজনের জুটিতে ২০০ রান হয়ে যায়। তাতে একটি রেকর্ডও হয়। এর আগে তামিম-ইমরুল ও মুশফিক-মুমিনুল জুটি দুইবার করে ২০০ রানের জুটি গড়েন। এবার মুশফিক-মুমিনুল মিলে তৃতীয়বারের মতো ২০০ রানের জুটি গড়ে দেশের সব জুটিকেই ছাপিয়ে যান। তবে দলের রান ৪০০ হওয়ার আগেই মুমিনুল সাজঘরে ফিরেন। দলের ৩৯৪ রান হতেই মুমিনুল (২৩৪ বলে ১৩২ রান) আউট হয়ে যান। আগের দিনের সঙ্গে আরও ৫৩ রান যোগ করে আউট হন মুমিনুল। তাতে মুমিনুল-মুশফিকের ২২২ রানের জুটি ভেঙ্গে যায়। এরপর মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে মুশফিক ৪০০ রানে যান। মিঠুন অবশ্য বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি। দলের ৪২১ রান হতেই আউট হন মিঠুন (১৭)। ব্যাটিং উইকেটে নিজের ব্যাটিং দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হন মিঠুন। রিভিউ নিয়েও উইকেটরক্ষকের হাতে ক্যাচ আউট হওয়া থেকে বাঁচতে পারেননি মিঠুন। মুশফিক অবশ্য থেমে থাকেননি। নিজ গতিতে ব্যাটিং করতে থাকেন। এবার লিটন কুমার দাসকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে থাকেন। লিটন দারুণভাবে মুশফিককে সঙ্গ দেনও। তাতে করে দলের স্কোর তৃতীয়দিনের শেষ সেশনের এক ঘণ্টা বাকি থাকতেই ৫০০ রানে চলে যায়। জিম্বাবুইয়েকে পেয়েই জ্বলে উঠেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা। মুশফিক ১৫০ রান করার পর ২০০ রানের দিকেও যেতে থাকেন। লিটনও হাফসেঞ্চুরি করে ফেলেন। দুইজন মিলে ষষ্ঠ উইকেটে শতরানের জুটিও গড়ে ফেলেন। এরপর আর লিটন বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। নিজের ৫৩ রান হতেই লিটন আউট হয়ে যান। তাতে মুশফিক-লিটন জুটি ১১১ রানেই ভেঙ্গে যায়। তবে এই শতরানের জুটিতে এক ইনিংসে দুটি শতরানের জুটি দেখার মিলে। তাইজুল ইসলাম ব্যাট হাতে নেমে উইকেট আঁকড়ে থাকার কাজটি করতে থাকেন। আর মুশফিক নিজের তৃতীয় দ্বিশতক করার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ৩১৫ বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়েই দ্বিশতক করেন মুশফিক। তার শতক হতেই যে ইনিংস ঘোষণা করে দেবে বাংলাদেশ, তা বোঝাই যায়। তাই করে বাংলাদেশ। যখন দলের রান ৫৬০ হয়, মুশফিকের রান ৩১৮ বলে ২৮ চারে অপরাজিত ২০৩ রান হয়, তাইজুল ১৪ রানে অপরাজিত থাকেন, তখন ১৫৪ ওভার শেষ হয়। ইনিংস ঘোষণা করে দেয় বাংলাদেশ। আগের দিনের ৩২ রানের সঙ্গে আরও ১৭১ রান যোগ করেন মুশকিক। দেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেস্টে সর্বাধিক ৪৪১৩ রানও করে ফেলেন মুশফিক। প্রথম ইনিংস শেষে ২৯৫ রানে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। আগের দিনের ২৪০ রানের সঙ্গে তৃতীয়দিন আরও ৩২০ রান যোগ করে বাংলাদেশ। সারাদিন খেলে। দিনের শেষ ৫ ওভার আগে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। যেন জিম্বাবুইয়ের দুই একটি উইকেট তুলে নিয়ে চাপে রাখা যায়। তাতেও সাফল্য মিলে। যে রানে এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ, তাতেই জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। জিম্বাবুইয়ের দুই ব্যাটসম্যান যখন প্রথম ওভারেই রানের খাতা খোলার আগেই নাঈম হাসানের টানা দুই বলে আউট হয়ে যান, তখনই টালমাটাল হয়ে পড়ে সফরকারীরা। এরপর কোনভাবে দিনের শেষ ৫ ওভারে ৯ রান করে দিন শেষ করে জিম্বাবুইয়ে। উইকেটে কেভিন কাসুজা (৮*) ও ব্রেন্ডন টেইলর (১*) আছেন। তারা আজ চতুর্থদিনে ব্যাট করতে নামবেন। দলকে বাঁচাতে নামবেন। আগে তৃতীয়দিন শেষে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে থাকা ২৮৬ রান করতে নামবেন। কাসুজা ও টেইলরের পর নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রেইগ আরভিন, টিমিসেন মারুমা, সিকান্দার রাজা ও রাগিস চাকাভা রয়েছেন। এ ব্যাটসম্যানদের দ্রুত আউট করা গেলেই ইনিংস জয়ের যে হাতছানি দিচ্ছে, সেই জয় পেয়েও যাবে বাংলাদেশ।
×