ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সম্পর্কে নতুন উচ্চতা ॥ মোদির আসন্ন ঢাকা সফর

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সম্পর্কে নতুন উচ্চতা ॥ মোদির আসন্ন ঢাকা  সফর

এম শাহজাহান ॥ মুজিববর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আগামী ১৬ মার্চ দুদিনের সফরে ঢাকা আসছেন বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার এই সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানে গঠন করা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘সিইওএস’ ফোরাম। এছাড়া দুদেশের সীমান্ত সম্পর্ক জোরদারে বর্ডার হাট সংক্রান্ত একটি চুক্তি করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। শুধু তাই নয়, মোদির এবারের সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন গতি সঞ্চার করবে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনীতি ও কূটনীতিতে দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন এক বিশেষ উচ্চতায় উন্নীত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখবেন নরেন্দ্র মোদি। তার এই সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৬ মার্চ ঢাকা আসবেন। ওই সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবার অনেক গুরুত্ব বহন করছে। কারণ সম্প্রতি ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন বিল এবং এনআরসি নিয়ে ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে কিছুটা টানপোড়েন তৈরি হয়। এই ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যেও এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির এবারের সফরের মধ্যদিয়ে ইতিবাচক ঘোষণা আসবে। এনআরসি ইস্যুতে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ রয়েছে তা প্রশমিত হবে। দুদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে যেসব বাধা রয়েছে তা দূর করার মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে উভয়দেশ। এছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগ যাতে আরও বৃদ্ধি পায় সে ব্যাপারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া শুষ্ক মৌসুম শুরু হচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এখনো করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য এক বড় সমস্যার নাম। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু এই ইস্যুতে ভারত এখনও বাংলাদেশের পক্ষে সেইভাবে সমর্থন দেয়নি। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শরীফা খান জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসছেন, এ বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার এই সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বাড়ানো এবং এক্ষেত্রে কি জাতীয় সমস্যা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। তিনি বলেন, দুদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকে বর্ডার হাট বিষয়টিও আসছে। শুধু তাই নয় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আশা করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির এবারের সফরে বেশকিছু ইতিবাচক ঘোষণা আসবে। জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিতে বেশ কিছু অন্তরায় রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-শুল্ক ও অশুল্কজনিত সমস্যা, কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। এছাড়া স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়া, কাস্টমস হাউসগুলোর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সঙ্কট, ভিসা প্রাপ্তির জটিলতা না কাটা, ব্যবসায়ীদের জন্য মাল্টিপল ভিসা প্রদান বন্ধ থাকা, সীমান্ত হাটগুলো পুরোমাত্রায় চালু না হওয়া, বিএসটিআই ও বিআরটিএ’র ল্যাবরেটরি টেস্টের স্বীকৃতি না দেয়া এবং ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপীর অব্যাহত দরপতনে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমছে না। তবে এসব বাধা দূর করতে পারলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া শুল্ক-অশুল্কজনিক সমস্যা একটি বড় বিষয় পোশাক রফতানিতে শূন্য শতাংশ শুল্ক বহাল থাকার পরও দেশটিতে সেইভাবে রফতানি বাড়ছে না। অথচ বাণিজ্য ঘাটতি দূর ও রফতানি বাড়াতে ভারতের মতো বড় বাজার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্দরের অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বরাবরই একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘সিইওএস’ ফোরামের তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু ভারত এ ব্যাপারে তেমন সাড়া দেয়নি। তবে মোদির এবারের সফরসূচী ঘিরে যে এজেন্ডা তৈরি করা হয়েছে সেখানে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সিইওএস ফোরাম গঠনের ব্যাপারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি করা হবে। এলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে। এদিকে, বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের তাগিদ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভারত সবসময় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধায় পোশাক রফতানি করা হচ্ছে। কিন্তু নানা ধরনের জটিলতায় সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না উদ্যোক্তারা। অথচ ভারতের মতো বড় বাজারে রফতানি বাড়ানো যেতে পারে। তিনি বলেন, এখানেই আলোচনা দরকার। উচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার জন্য সিইওএস ফোরাম গঠন করা যেতে পারে। এ ধরনের ফোরামের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা এগিয়ে নেয়া সম্ভব। প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫ সালের জুন মাসে শেষবার বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। সেই হিসেবে প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তিনি আবার বাংলাদেশে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান গভীরভাবে এদেশের মানুষ স্মরণ করে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব সময়ই ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে জোর দিয়েছিলেন। তার সেই ধারা তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহাল রেখেছেন। ভারতের সঙ্গে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর আগে গত অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। জানা গেছে, ভারত ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশকে মোট ৭৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ২০০ কোটি ডলার এবং গত বছর ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের ঋণের ৫০ কোটি ডলার সামরিক খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদিকে, এলওসি চুক্তির আওতায় ভারতের সঙ্গে যেসব প্রকল্পে ঋণ দেয়ার জন্য নতুন করে চুক্তি করা হবে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে-রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত অন্য স্থানে নেয়ার অবকাঠামো উন্নয়ন, বুড়িগঙ্গা রিভার রেস্টুরেশন প্রজেক্ট, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেনার টার্মিনাল নির্মাণ, পায়রা বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নত করা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করা, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত সড়ক চারলেনে উন্নীত করা, মিরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ, ঈশ্বরদীতে রেল ও সড়কপথের জন্য আইসিডি নির্মাণ, মংলায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য শোধনাগারের যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চারলেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। অন্যদিকে শেষ বা তৃতীয় এলওসির জন্য বাংলাদেশের তরফে ১৭ প্রকল্প বাছাই করা হয়েছে।
×