ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চসিক নির্বাচন

আওয়ামী লীগে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহের আলামত

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 আওয়ামী লীগে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহের আলামত

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতায় মেয়র পদ ছাড়াও পরিবর্তন এসেছে বেশকিছু কাউন্সিলর পদে। বাদ পড়েছেন বর্তমান ১৪ কাউন্সিলর। মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী পরিবর্তন দলের একটি অংশকে আহত করলেও শেষ পর্যন্ত সকলেই মেনে নিয়েছেন কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। কিন্তু কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহের আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। সংগ্রহ করেছেন নির্বাচন কমিশনের মনোনয়নপত্র। এদিকে, কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে দল থেকে বহিষ্কারের মত কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন দলটির নেতারা। তবে কয়েকটি পদে পরিবর্তন আসার আভাসও রয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনকে অত্যন্ত মর্যাদার লড়াই হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কেননা, এ চট্টগ্রামেই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্য নগরী এবং অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে বিবেচিত। মেয়র পদে যেন কোন ধরনের বিদ্রোহের সুযোগ না থাকে সেজন্য আগেভাগেই চূড়ান্ত করা হয়েছে প্রার্থী। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে বাদ দিয়ে রেজাউল করিম চৌধুরীকে নৌকার টিকেট দেয়ায় দলের একাংশে হতাশা দেখা দিলেও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেনি। শেষ পর্যন্ত মেয়র আ জ ম নাছিরসহ সকল নেতাই কেন্দ্রঘোষিত প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু কাউন্সিলর পদে বড় ধরনের রদবদলের বিষয়টি অনেকেই মানতে চাইছেন না। মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা ও তাদের অনুসারীদের অভিযোগ এমন অনেকেই দলীয় সমর্থন পেয়েছেন যারা আওয়ামী লীগ কিংবা সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবিতে নেই। এ প্রার্থীরা কেন্দ্রের কাছে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছেন বলে জানান তারা। বিশেষ করে বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে যারা বাদ পড়েছেন তাদের মধ্যে বেশ কজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাধারণত সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয় মেয়র পদের নির্বাচন। কেননা, কেন্দ্রে ভোটার আনার কাজটি মূলত কাউন্সিলর পর্যায়েই হয়ে থাকে। অনেক ভোটার রয়েছেন, যারা কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিতে এসে মেয়র পদেও ভোট দেন। কাউন্সিলর প্রার্থিতায় এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ ভাবিয়ে তুলেছে মেয়র প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের। সোমবার পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে অন্তত ১০টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র থাকা আলামত অনেকটাই স্পষ্ট। ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ দিদারুল আলম মাসুমকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়েছে দলের একাংশ। সোমবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিক আহমেদ এ দাবি জানিয়ে বলেন, প্রায় ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছেন মাসুম। তাকে মনোনয়ন না দেয়া দুঃখজনক। সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ এ ওয়ার্ডে প্রার্থী পরিবর্তন করার জোর দাবি জানান। কর্পোরেশনের ১১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর মোরশেদ আকতার চৌধুরী। সেখানে প্রার্থিতার জোরালো দাবিদার মোঃ ইসমাইল। বিগত সময়ে বিভিন্ন কর্মকা-ে মোরশেদ আকতারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। সেখানে মোঃ ইসমাইলের পক্ষে নেমেছেন তার অনুসারীরা। ১৩ নম্বর ফিরিঙ্গীবাজার ওয়ার্ডে বাদ পড়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন। এতে করে বিপ্লব অনুসারীরা ক্ষুব্ধ। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে বাদ পড়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিম। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন মোঃ আবদুস সালাম। ক্ষুব্ধ তারেক সোলায়মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন তার অনুসারীরা। ২৪ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী করা হয়েছে আবদুস সবুর লিটনকে। সেখানে বাদ পড়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর এরশাদ উল্লাহ। তিনিও নির্বাচনের প্রস্ততি নিচ্ছেন বলে জানা যায়। ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এ ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আবছার মিয়া। কিন্তু জসিম স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে চান। ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ সাইফুকে আবারও মনোনয়ন দেয়ায় ক্ষুব্ধ দলের একটি অংশ। কারণ তার বিরুদ্ধে এলাকায় নানাভাবে আধিপত্য বিস্তারসহ বিস্তর অভিযোগ। সেখানে প্রার্থিতায় পরিবর্তনের দাবি বেশ জোরালো। জামালখান ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন বলে অভিযোগ একাংশের। তারা বলছেন, বর্তমানে তিনি দলের কোন পদে নেই। তবে এক্ষেত্রে তার বক্তব্য হলো তিনি এবং তার পরিবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দীর্ঘকাল ধরে। কেন্দ্র সবকিছু অবগত হয়েই মনোনয়ন দিয়েছেন। ক্ষুব্ধ নেতাদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। কারণ সমালোচনা থাকলেও এলাকায় রয়েছে তাদের প্রভাব বলয়। এদিকে, কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন নেতারা। গত রবিবার রাতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের আয়োজনে হোটেল পেনিনসুলায় দলের মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৪ ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার এই সভায় নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রঘোষিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের জেতাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। মূলত নির্বাচনী কৌশল ঠিক করে তৃণমূল পর্যায়ে নির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যেই এই বৈঠক। সেখানে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী প্রার্থীদের চিরতরে বহিষ্কারের প্রস্তাব আসে। পাশাপাশি যারা যোগ্য প্রার্থী কিন্তু মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন তাদের দলীয় পদ-পদবিতে মূল্যায়ন করার প্রস্তাবও উঠে আসে। সভায় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কাউন্সিলর নিয়ে অভিযোগ আসার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, মনোনয়ন দেয়া হলেও যে সব কাউন্সিলরের বিষয়ে অভিযোগ বেশি তাদের বিষয়ে কেন্দ্রে আলোচনা করা হবে। সভায় উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, দলের কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান এমপি, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, এম এ লতিফ এমপি, নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, মাহফুজুর রহমান মিতা এমপি, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এমপি, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম এ সালাম এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা।
×