ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষা আমাদের অহঙ্কার

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  বাংলা ভাষা আমাদের অহঙ্কার

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ জন্য আমরা গর্ববোধ করি কেননা বাঙালীই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। জীবনের বিনিময়ে মাতৃভাষা অর্জন করতে হয়েছে বাঙালী বাদে অন্য কোন জাতির এই নজির নেই। বর্তমান পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৮ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলা ভাষার স্থান বর্তমানে পঞ্চম। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ওপর পড়েছিল কালো হাত। শত সংগ্রাম, আন্দোলন ও ত্যাগের পর আমরা ফিরে পেয়েছি হাজার বছরের গৌরবময় প্রাণের বাংলা ভাষা। আর এ জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন সালাম, বরকত, জব্বার, সফিউরসহ বাংলার নাম না জানা অনেক অকুতোভয় বীর সন্তানরা। ভাষা আন্দোলন যে বাঙালী জাতির জন্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা সমগ্র বিশ্ব অনুভব করতে পেরেছে। তার স্বীকৃতিস্বরূপ মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বে একযোগে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যা বাঙালী হিসেবে আমাদের জন্য অনেক গর্বের। ভাষা আন্দোলন আমাদের জন্য গৌরবের হলেও এর পেছনে লুকিয়ে আছে নানা সংগ্রাম ও ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ : ১. পূর্ব পাকিস্তান ২. পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি- বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ অনেকে। এ ছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং শোভাযাত্রা সহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশী হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। যা সারা বিশ্বে প্রতিবছর গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। বাংলা ভাষা আমাদের গৌরব ও অহঙ্কারের। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে ধারণ করে সর্বক্ষেত্রে শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে তাহলে প্রিয় বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×