ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাংবাদিকদের মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সাংবাদিকদের  মুখোমুখি  বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিবুর  রহমান

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর নেতা শেখ মুজিব। মহান নেতাকে আবিষ্কারের অযুত প্রয়াস। নানা উৎস থেকে প্রতিনিয়ত খুঁজে নেয়া হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি এবং নিয়মিতভাবে তিনি উপস্থাপিত হয়েছেন গণমাধ্যমে। খবরের শিরোনামে ছিলেন সব সময়। ‘সাংবাদিকদের মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইটি সেসব খবর সাক্ষাতকার ভাষণ বিবৃতির সমৃদ্ধ সংকলন বলা যায়। বিশেষ এ গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন মোশারফ হোসেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত বই অমর একুশে গ্রন্থমেলার একেবারে শুরুর দিন থেকে স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। বইতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অবিচল নীতি অনেকটা রোজনামচার মতো তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে ওঠে এসেছে বাঙালীর অধিকার আদায়ের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও অর্জনের ইতিহাস। উত্তাল সময়ের গরম গরম খবর হাত ধরে যেন পেছনের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। পড়তে গিয়ে এখনও ভেতরে একটা রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। বইতে সরাসরি পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুকে। অনতিবিলম্বে পাওয়া যায়। যারা খুব ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন, বই পাঠে তারাও নিজেদের চিন্তাগুলোকে ঝালিয়ে নিতে পারবেন। বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, সংগ্রামেরই আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সারাজীবন লড়াই করেছেন। এভাবে নিজের কালে সংবাদের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁকে সব সময় ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। দেশে তো বটেই, বিদেশের মাটিতেও তাঁকে ঘিরে ছিল অন্যরকম আগ্রহ। মুজিবের একান্ত সাক্ষাতকার পৃথিবীর বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ছাপিয়েছে। টেলিভিশনে রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে বিশেষ সাক্ষাতকার। আন্দোলন সংগ্রামের নানা পর্যায়ে অসংখ্য বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। এসবের ভিত্তিতে ছাপা হওয়া সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন মোশারফ হোসেন। গবেষণার মন নিয়ে কাজ করেছেন। দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলা, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, বাংলার বাণী, দৈনিক সংবাদসহ বেশকিছু পত্রপত্রিকা থেকে বইয়ের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। সম্পাদিত গ্রন্থের প্রথমাংশে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের খবর। দ্বিতীয় অংশে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে দীর্ঘ সাক্ষাতকার। তৃতীয় অংশে জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন ও রেডিওতে দেয়া ভাষণ। শুধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের যা বলেছেন, তাও আলাদা করা হয়েছে। আছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতিও। সব মিলিয়ে সময়টাকে এক মলাটে বন্দী করার প্রয়াস। মোটামুটি পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু। ১৯৭৫ সালে এসে শেষ হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে ঘটনার ঘনঘটা। শেখ মুজিব কখনও শক্তিশালী ও তুমুল জনপ্রিয় বিরোধী দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, কখনও সাধারণ সম্পাদক, কখনও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার তরুণ মন্ত্রী হিসেবে, কখনও দলের সভাপতি হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে এসেছেন। পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। চলমান সব ইস্যুতে কথা বলতে হয়েছে তাকেই। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে মুহূর্তগুলো কিছুটা হলেও কল্পনা করা যায়। বইয়ের তথ্য প্রমাণ বলছে, বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন ১৯৫৬ সালের ২০ নবেম্বর। প্রাদেশিক সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের মন্ত্রী হিসেবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা নিয়ে নিত্যদিন কথা বলেছেন। ’৬৯ এর গণআন্দোলনের সময়ও গণমাধ্যম ছুটেছে শেখ মুজিবের পিছু। ’৭০ এর নির্বাচনের আগে ও পরে মুজিব নিজের রাজনৈতিক কর্মসূচী জনগণের সামনে তুলে ধরতে সংবাদপত্র রেডিওর সহায়তা নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করেই একাত্তরের মার্চে সংঘটিত গণহত্যার খবর প্রকাশ করে বিশ্বগণমাধ্যম। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রকাশ করা হয় বিদেশী পত্রিকাগুলোতে। সাক্ষাতকারও দিয়েছেন প্রচুর। বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন দেশের স্থপতি হিসেবে পৃথিবীর নামীদামী পত্রিকা টিভিতে গর্বিত বাঙালী হিসেবে কথা বলেছেন তিনি। আজকের দিনেও যেসব আলোচনা চলমান আছে, সেসব আলোচনার উৎসমূলে নিয়ে যায় এ বই। আর তখন দেখা যায়, বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি অপবাদ দেয়ার বিপরীতে আমেরিকান মন্ত্রী কিসিঞ্জারকে এক হাত নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গিয়ে নিউজউইক পত্রিকাকে নাতিদীর্ঘ সাক্ষাতকার দেন তিনি। তখন বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি শূন্য ঝুড়ি নয়। বাংলাদেশ ধনধান্য পরিপূর্ণ ছিল। দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ ও ২৫ বছরের পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে তা নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সম্পদ রয়েছে তার উর্ভর জমিতে। আমাদের পাট আছে, চা আছে, মাছ আছে, আর আছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা। আমাদের উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরের তলদেশে তেল আছে বলে আমরা আশা করছি। মধু থাকলে মৌমাছি সেখানে আসবেই। সংগঠিত করতে সময় লাগবেই। কিসিঞ্জারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ভুলে যাবেন না যে আমরা স্বাধীনতাই পেয়েছি মাত্র ৩৪ মাস হলো।’ বই পাঠে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান জানা যায়। এতে ১৯৭২ সালের ১৫ মে মার্কিন ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনকে (এবিসি) বঙ্গবন্ধুর দেয়া একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা বলেন, ‘আমি সেটা করব। এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এরা যে ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছে, গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে, এমতাবস্থায় কোন দেশ কী এদের ছেড়ে দিতে পারত?’ একই সাক্ষাতকারে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দেয়া না দেয়া প্রশ্নে দারুণ এক জাবাব দেন তিনি। বলেন, ‘আমি পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেই কি না, তাও তো প্রশ্ন। কারণ জনাব ভুট্টো আর পাকিস্তান নাম দাবি করতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি যে তাঁর সচেতন চেষ্টা ছিল তাও বই থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়। এক সাক্ষাতকারে বিষয়টি স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘যে বাংলা ভাষার জন্য ঢাকার ছাত্ররা বুকের রক্ত দিয়েছে জাতিসংঘে এবার সেই বাংলা ভাষাতেই বক্তৃতা হয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের পক্ষে জাতিসংঘে আমি স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করার চেষ্টা করেছি।’ স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে তাঁর সরকারের নেয়া পরিকল্পনা, দূর্নীতিবিরোধী নীতি, বাকশাল গঠন, রক্ষীবাহিনীর কর্মকান্ডসহ প্রায় সব বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে পত্রপত্রিকাগুলো। সংবাদ সাক্ষাতকার বিবৃতি সুবিন্নস্ত আকারে পুনরায় প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি মতামত জানার সুযোগ করে দিয়েছে বইটি। অপেক্ষাকৃত নতুন কিছু প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে। যারা ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন তারা বইটি পড়ে নিজের চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবেন। আরও একটু গভীরে যেতে পারবেন। আর নতুন প্রজন্মের যারা গবেষণায় আগ্রহী তারা বিশেষ উপকৃত হবেন। ‘সাংবাদিকদের মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। ৪০০ পৃষ্ঠার বইয়ের মূল্য ১০০০ টাকা।
×