ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

একুশের মাস ও বইমেলা

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

একুশের মাস ও বইমেলা

ইংরেজী ক্যালেন্ডার মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ এপ্রিল বসন্ত কালের পরিসর। এই সময়ে দুটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস আমরা পালন করে থাকি, যার মধ্যে একটি হলো ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আর অপরটি হলো ২৬ মার্চ (১২ চৈত্র) স্বাধীনতা দিবস। এই দিবস দুটিতে জাতীয়ভাবে একুশে ও স্বাধীনতার পদক প্রদান করে সরকার শিল্প, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ অবদানকারীদের মাঝে, যা আমাদের মানবিক জগতকে আরও সংগঠিত করে ভবিষ্যতের কাজে মনোনিবেশ করতে। ২ ফেব্রুয়ারিতে, ২০২০ (১৯ মাঘ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ) বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের সরকার প্রধানের বক্তব্যে আরও উঠে এসেছে যে, এই গ্রন্থমেলা অনেক নবীন লেখককে তাদের সাহিত্য চর্চার কর্মফল প্রকাশের সুযোগ করে দেয় এবং নতুন পাঠক তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে নানা সংগ্রামের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সারা বিশ্বের মানুষের কাছেই এক মহাবিস্ময়কর ব্যাপার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আবেগময় এই ভাষণ থেকে বেরিয়ে আসে বাংলা ভাষাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম, যা ১৯৪৭ এর দেশ বিভক্তির পর থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত রূপ নেয়, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামসহ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাÑ মূল চার নীতি যথাক্রমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। একুশের ভাষা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা প্রতি বছর কালের বৈচিত্র্যে শীত-বসন্তে আমাদের কাছে উপস্থিত হয় বহুমাত্রিকতায়। যাকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রাণের মেলা, যা ২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ১২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৯টি ও সোহরাওয়র্দী উদ্যানে ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৭৩টি ইউনিট এবং ৩৪টি প্রকাশনীকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে বিভিন্ন খাতে যথা : কবিতায়, কথা সাহিত্য, প্রবন্ধে, গবেষণায়, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, ভ্রমণ কাহিনী, নাটক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও শিশু সাহিত্য। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতোই অনেক সাহিত্যিকই মনে করেন বইমেলা শুধু কেনা বেচা নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গণতন্ত্রের আন্দোলন, জাতীয়তাবাদীর চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িত আছে সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমি, বই প্রকাশক সংস্থা, বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থার বই স্টলে, লেখক ও অগণিত পাঠক। এই সকল অংশীদারের নিজস্ব একটা ব্যবসায়িক দিক রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে। বাংলা একাডেমি তাদের আয়োজনের অংশ হিসেবে যে স্টল বরাদ্দ দিয়ে থাকে, সেখান থেকে একটি মোটা অঙ্কের টাকা রাজস্ব আসে। আবার যারা স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের বই প্রদর্শনের আয়োজন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে, যার মধ্যে রয়েছে পূর্বে আলোচিত প্রকাশক, লেখক, ব্যবসায়ী, যাদেরও দিন শেষে আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাখতে হয় এই মেলাকে ঘিরে। এই বইমেলা নতুন কর্মসংন্থান সৃষ্টি করে, যার সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা জড়িত তথা বেকারত্বের অবসান ঘটায়। সেই হিসেবে একুশে বই মেলা বই বিক্রেতা, প্রকাশক, ছাপাখানা, বই বাইন্ডিং ইত্যাদি খাতের সঙ্গে জড়িতদেরও কর্মসংন্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এদিক থেকে ভাষার মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমনÑ বিজ্ঞাপন ব্যবসা, দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন নিউজ পোস্ট ও বইমেলা কেন্দ্রিক বুলেটিনে ছাপানো হয় কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় পণ্য হিসেবে বই ক্রেতার বহু শ্রেণীÑ যেমন কেউ ছাত্রছাত্রী, কেউ গবেষক, কেউ শৌখিন ক্রেতা, কেউ আবার কবি-সাহিত্যিক, কেউ আবার শিশু শ্রেণীর এবং কেউ আবার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি, যারা নিজের প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একটি তথ্যে দেখা যায় যে, ২০১৯ সালের বইমেলায় ৮০ কোটি টাকার ওপরে বই বিক্রি হয়েছিল এবং বর্তমান বছরে এই অঙ্কটি আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়, যা একটি সুখবর বিশেষত আমাদের মতো বই পাঠের চর্চবিমুখ মানুষের দেশে। বইগুলো বইপ্রেমিক মানুষের বাসার সৌন্দর্য বর্ধনের উপকরণও বটে, যা বইমেলারই অবদান। কারণ বইয়ের চেয়ে সুন্দর কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রতিটি সৃজনশীল সংস্কৃতিমনা মানুষই তা বোঝেন। তারা বছরের এই ক্ষণটির দিকে তাকিয়ে থাকেন কখন ফেব্রুয়ারি মাস আসবে আর প্রকাশনা সংস্থা তথা মুদ্রণ কর্মীরা তাদের বিনিদ্র রজনী কাটাবে মেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই নতুন বই মুদ্রণের প্রয়াসে, যা প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি আলোকিত দিক। প্রতিদিনই মেলায় নতুন বই আসছে, যা মেলার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রচার করা হয়ে থাকে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিশেষ ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে তাদের নির্ধারিত চ্যানেলগুলোতে সংবাদের অংশ হিসেবে প্রচার করছে প্রতিনিয়ত। এখন সাহিত্যের মানদ-ে আমরা যদি এই সময়টিকে ঘিরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টির বিষয়গুলোকে মূল্যায়ন করি, তা হলে দেখা যাবে কবিতা ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার আভাস অর্থাৎ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে এই শাখা দুটোতে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে যথাযথ সৃষ্টি কম, যদিও মানের কথা বিবেচনায় নাই আনি। আবার অন্যান্য শাখায় লেখক থাকলেও মানসম্মত লেখার স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। যারা সাহিত্য সমালোচক তারা বলছেন, মানসম্মত সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের সংখ্যা ক্রমঅবনতিশীল বিধায় আগ্রহে ও পেশায় দুটোতেই কেমন একটা স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয় সৃষ্টিশীল কাজে। বিষয়টি এমন যে, সাহিত্য সৃষ্টি বা সাহিত্যিক হওয়া একটা ব্যক্তিগত আগ্রহের ব্যাপার, যা একটি অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রস্ফুটিত হয়। এই জায়গাটিতেই সঙ্কট রয়েছে। কেউ যদি এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, তবে আর্থিক দৈন্যের সম্মুখীন হতে হবে, এটাই বাস্তব। বিশেষত: প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির যুগে, যেখানে জ্ঞান চর্চার ফসলের বাজার সংগঠিত নয়। আবার সামাজিক স্বীকৃতিও সহজেই ধরা দেয় না। যার ফলে ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। যারা চলে যাচ্ছে আর যারা আসছে তাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আকাশ-জমিন, যা শুধু সাহিত্য বা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফলে মনের খোরাকের জন্য যে সাহিত্য প্রয়োজন সে জায়গাটিতে প্রাপ্তির অভাব রয়েছে। বাজার ব্যবস্থা, বাণিজ্য, অধিক মুনাফার লোভ ইত্যাদি সব কিছুই কি আমাদের জীবন থেকে সংস্কৃতি বোধকে কেড়ে নিয়েছে! যার ফলে আমরা বুঝতে পারছি না, বসন্ত কখন আসে কখন যায়। আমাদের সামাজিক জীবনে ঋতুরাজের কিংবা ২১ ফেব্রুয়ারির (৮ ফাল্গুন) প্রভাবগুলোকে অনুশীলন করার সময় এসেছে। ফি বছর ৮ ফাল্গুন আসুক, মাসব্যাপী বইমেলা বসুক আর সাহিত্য-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হোক- এই আশায় বুক বেধে রইলাম। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা
×