ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও আজকের কথা

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভাষা আন্দোলন ও আজকের কথা

পূর্ব বাংলার বাঙালীর তাবৎ পরিচিতি, তাবৎ গৌরব, তাবৎ সাফল্য-সব কিছুই এসেছে ১৯৪৮ ও ১৯৫২র ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের হাত ধরে। বাঙালীর যত কিছু অর্জন, তারও মূলে ঐ রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনই। ১৯৪৭ এর মধ্য আগস্টে সাম্প্রদায়িক ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম হলো। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান তুলে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশ ঘটল। যে উগ্র সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, আজ তা কল্পনা করলে শিউরে উঠতে হয়। যাঁরা ঐদিনগুলো এবং তৎকালীন রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব সে যুগের সেই ভয়াবহ আতঙ্কময় পরিবেশ সঠিকভাবে তুলে ধরা, অন্য কারও পক্ষে নয়। ভাই এ ভাই এ ছুরি চালাচালি, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী অপহরণ, নারীর সম্ভ্রমহানির ঐ বর্বর ঘটনাগুলোকে স্মরণে আনা বা বর্ণনা করাও তাঁদের পক্ষেই সম্ভব। ঐ বিষাক্ত পরিবেশ বাংলা ও উর্দু সাহিত্যে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাসে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আজ সে যুগের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা যেমন নিদারুণভাবে কমে গেছে, বাজারে ঐ ঐতিহাসিক ঘটনা-বিষয়ক সে সময়কার প্রকাশিত বই-পুস্তকও আর তেমন পাওয়া যায় না। ফলে, নতুন প্রজন্মের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের পক্ষে তদানীন্তন ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়ে কোন কিছু সঠিকভাবে জানবার সুযোগ ঘটছে না। বস্তুত প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন ছুটে চলেছে ইতিহাস থেকে দূরে, অনেক দুরে। ১৯৪৮ এর মার্চে করাচীতে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে ঐ সংসদের সদস্য জননেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত যখন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন, খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খান (পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) এবং মুসলিম লীগ নেতারা ধীরেন দত্তের ঐ ন্যায়সঙ্গত দাবির বিরোধিতাই শুধু করেননি, বাংলা ভাষা সংক্রান্ত দাবি উত্থাপনের জন্য তাঁকে ‘ভারতের দালাল’, ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমন’ প্রভৃতি বলেও আখ্যায়িত করতে পরোয়া করেননি। প্রতিবাদে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধিবেশন ত্যাগ করে বিমানযোগে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররা ঢাকা বিমানবন্দরে ধীরেন দত্তকে সশ্রদ্ধ সম্বর্ধনা জানান এবং তাঁকে বীরোচিত মর্যাদায় স্বাগত জানান। করাচীর ঘটনাবলী জানার পর সেদিনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল, বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী তরুণ ছাত্রনেতারা ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করে পূর্ব বাংলার সর্বত্র হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, সভা-সমবেশ অনুষ্ঠানের জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানালে প্রদেশের অনেক জেলাতেইÑযেমন রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও আরও কতিপয় জেলায় বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের উদ্যোগে অত্যন্ত সফল কর্মসূচী পালিত হয়। এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক ধরপাকড়ও শুরু হয়। অনেক জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং বেশ কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হরতাল, মিছিল প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনার বর্ণনা অত্যন্ত সহজ। কিন্তু তৎকালীন বাঙালী মুসলিম মানসের কথা চিন্তায় আনলে, সাম্প্রদায়িকতা ও তার তত্ত্ব দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পটভূমির কথা ভাবলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলা কত কঠিন ছিল। সদ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে না হতেই বাঙালী যুব সমাজ উর্দু নয়, আরবী নয়, ইংরেজী নয়Ñবাংলা ভাষার উচ্চ মর্যাদার দাবিতে যে আন্দোলনটি গড়ে তুললেন, তা যে কোন বিবেচনায়ই অসাধ্য সাধন। অনেক ক্ষেত্রে মোল্লা-মৌলভীরাও ইসলামের দোহাই দিয়ে এবং বাংলা ভাষা ‘মুসলমানের ভাষা নয়,’ ‘হিন্দুর ভাষা’, ‘ভারতের ভাষা’ এবং সে কারণে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন, তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, পাকিস্তানের দুশমন ও ভারতের দালাল বলে চিহ্নিত করে ‘নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি সহকারে লাঠি, ফালা, সড়কিসহ নানাবিধ অস্ত্র সহকারে এসে প্রকাশ্য রাজপথে বহু ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতায় (প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে) হামলা করে মিছিলকারীদের অনেকের মাথা ফাটিয়ে দিতে বা তাঁদের শরীরের রক্ত ঝরাতেও কোন দ্বিধা বা সংকোচ বোধ করেনি। খোদ পাবনা শহরে আহলে হাদিস নামক তৎকালীন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান জনৈক মওলানার নেতৃত্বে একইভাবে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে হামলা হয়েছিল। এই একই মহল নাটকের অভিনয়, সঙ্গীত-নৃত্যানুষ্ঠান, আল্পনা আঁকাসহ সকল সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক কর্মকা-ের প্রকাশ্য বিরোধিতা করতÑ সেগুলোকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে। কিন্তু তাদের সশস্ত্র আক্রমণকারীদের কাউকেই তখন পুলিশ গ্রেফতার করেনি বা কোন মোকদ্দমাও দায়ের করেনি, বরং দুধ-কলা দিয়ে পুষেছে। ভাষা আন্দোলন দমন করার জন্য অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ ও অসংখ্য শিক্ষক-ছাত্রকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করা হয়। আবদুল মতিন, গাজীউল হক, শেখ মুজিবসহ আন্দোলনের বহু নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করতে পূর্ববাংলার কোথাও বিলম্ব করা হয়নি-সংবাদপত্রে সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতেও দেয়া হয়নি। যত্রতত্র ১৪৪ ধারা জারি করে ভাষা আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সভা-সমিতি মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। তৎকালীন সমগ্র ইতিহাসের প্রতি চোখ বোলালে, ঘটনাবলী স্মরণে আনলে এই সত্য উদঘাটিত হয় যে, ধর্মকে ধর্মের জায়গায় এবং রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় পৃথকভাবে স্থান না দিতে পারলে দেশ ও জনগণের সমূহ ক্ষতি হয় এবং এই ক্ষতির মাশুল আজও বাঙালী জাতিকে দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে কেন পাকিস্তানের তদানীন্তন শাসক গোষ্ঠী মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি বাঙালী তরুণ-তরুণীদের। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া যে শিক্ষিত হওয়া যাবে না, অশিক্ষিত মূর্খ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে, চাকরির বাজারে ঠাঁই না পেয়ে বেকারত্বের ভয়াবহতাই জীবনের সম্বল হয়ে দাঁড়াবে, জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যসমূহ যে হারিয়ে গিয়ে গৌরবহীন ঐতিহ্যবর্জিত ভবিষ্যতের এক দিশাহীন জাতি হিসেবে বাঙালীকে গড়ে উঠতে হবে, বাঙালী সংস্কৃতি, বাঙালীর অর্জন সবই যে অবলুপ্তির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে, তা দিব্যি উপলব্ধি করেছিলেন দেশপ্রেমিক শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সমাজ। তাই ঐ আন্দোলন ধর্মান্ধ শক্তিগুলোর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও, সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালিত তাবৎ অপপ্রচার এবং দননীতির প্রয়োগ সত্ত্বেও অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ধর্মান্ধ শক্তিগুলো ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করার ফলে স্পষ্টভাবে সকলে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল যে, ঐ শক্তিগুলো হলো শুধু বাংলা ভাষারই নয়, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস, বাংলার শিল্পকলা, বাংলার সঙ্গীত-নৃত্য প্রভৃতিরও চরম শত্রু। তাই সেদিন জাতি তাদের কাছে মাথা নোয়ায়নি। ঐ অপশক্তিগুলো তাদের কর্মকা- ভাষা আন্দোলন, বাংলার ভাষা সংস্কৃতির বিরোধিতাই শুধু করেনি, বাহান্ন পরবর্তী বাঙালীর সকল আন্দোলন-সংগ্রাম, গণতন্ত্রের দাবি, যুক্তফ্রন্ট গঠন, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, বাঙালীর স্বায়ত্তশাসন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, সম্মিলিত ছাত্র সমাজের ১১ দফা, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৫৪ ও ১৯৭০ এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রবল বিরোধিতাও তারা সক্রিয়ভাবে করেছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে ঐ অপশক্তিগুলোই তাদের গণবিরোধিতা, বাঙালী-বিরোধিতা নগ্নভাবেই প্রকাশ করে বাঙালী জাতিকে নিঃশেষ করার অপচেষ্টায় ‘পাকিস্তান’ ও ‘ইসলাম’ রক্ষার নামে অবতীর্ণ হয়েছিল। সে ইতিহাস সারা বিশ্বের কাছেই পরিচিত। যা হোক, ভাষা আন্দোলন যে বাঙালীর পরবর্তী সকল আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধানতম উৎস, তা নিয়ে দ্বিমত নেই-দ্বিমত নেই। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ অসম্ভব হতো যদি ভাষা আন্দোলন না হতো। দ্বিজাতিতত্ত্বের উগ্র ধর্মান্ধ চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে যদি না অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা বাঙালীর মননের গভীরে স্থান করে নিতে পারতো, তবে পাকিস্তান ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো না। বাঙালী জাতি জীবনমুখী। জীবনকে ভালবাসে। তাই নিজের ও জাতির জীবনকে রক্ষা করতে সকল প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে, সকল অত্যাচার নির্য্যাতন সহ্য করেও মাতৃভাষার মর্যাদাকে উর্ধে তুলে ধরেছে। জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেও সাফল্যম-িত করেছে। এত ঐতিহ্যম-িত, গৌরবোজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যম-িত ভাষা আন্দোলনের মাসে যখন দেখি তার প্রধান দাবি, ‘জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন চাই,’ আজও অবহেলিত, যখন দেখি আরবী, ইংরেজীও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে, যখন মাদ্রাসা শিক্ষা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দাপটের সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের (এবং মুক্তিযুদ্ধের) প্রত্যক্ষ ও আদর্শিক দুশমন জামায়াতে ইসলামী এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে, যখন দেখি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক শত্রু হেফাজতে ইসলাম রাষ্ট্রের উপদেষ্টার ভূমিকায় কার্যত অবতীর্ণ হতে পেরেছে এবং সর্বোপরি যখন দেখি, ভাষা সংগ্রামীদের একটি তালিকা পর্যন্ত তৈরি করে তা সরকারী গেজেটে প্রকাশ করে তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র কিছুতেই এগিয়ে আসছে নাÑতখন একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবতে হয় ভাষা আন্দোলন নতুন উদ্যমে আবারও শুরু করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতা এবং তার আদর্শিক বিপর্যয় প্রতিরোধে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই। বাঙালীর অমূল্য সম্পদ বাউলদের আজ স্থান হচ্ছে কারাগারে। তারা চিহ্নিত হচ্ছেন ধর্মদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। যেমন তাঁরা হতেন একাত্তর পূর্ববর্তী অন্ধকার দিনগুলোতে, তখন ভাবি আবারও যুদ্ধ চাই, আবারও চাই একাত্তর। ব্যাপকতম ঐক্য চাই জাতির। নইলে সকল অর্জনই ব্যর্থ হবে। নতুন অর্জনের পথও হবে রুদ্ধ। লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত [email protected]
×