ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আমাদের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এবং আমাদের ভাবনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। পক্ষান্তরে, সমগ্র পাকিস্তানের উর্দুভাষীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ ভাগ। সে হিসেবে দেখা যায়, বাংলাভাষাই ছিল পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠের ভাষা। কিন্তু তারপরও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলাকে উপেক্ষা করতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলার জনগণ রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছিল মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসে ‘তমদ্দুন মজলিশ’। তমদ্দুন মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ প্রকাশ করে। পাকিস্তানের তৎকালীন গবর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন, ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। উভয় স্থানেই উপস্থিত ছাত্র জনতা জিন্নাহর এ উক্তির বিরুদ্ধে ‘নো, নো’ বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ এ উক্তি পুনর্ব্যক্ত করলে উপস্থিত ছাত্র-জনতাও এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এ বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। এ সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহম্মদ রাজবন্দীদের মুক্তি ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করলে তা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু প্রাদেশিক নূরুল আমিন সরকার ওই ধর্মঘটের দিনে ১৪৪ ধারা জারি করে সকল সভা, সমাবেশ এবং মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সকালে মিছিল বের করলে পুলিশের বাধার মুখে মিছিল পন্ড হয়ে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে (পুনঃ) মিছিল বের হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে পৌঁছলে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। পুলিশের এ নির্বিচার গুলির ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ কয়েকজন নিহত হয়। এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনতা আন্দোলন ও ধর্মঘট চালাতে থাকে। সরকার প্রায় অচল হয়ে পড়ে। অবশেষে, বাংলাভাষা ও বাঙালীর কাছে সরকার নতিস্বীকার করে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কানাডার প্রবাসী বহুভাষী জনের সংগঠন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ প্রথম ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর পেছনে যে দুজন প্রবাসী বাঙালীর অবদান রয়েছে তারা হচ্ছেনÑ আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম। বহুভাষাভাষী প্রেমিক ওই সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আনানকে একটি চিঠি লেখা হয়। কোফি আনান ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ জানালে ইউনেস্কোতে একটি আবেদনপত্র পাঠানো হয়। ইউনেস্কোর শিক্ষা বিভাগের প্রোগ্রাম বিশেষজ্ঞ বেসরকারী উদ্যোগে কোন প্রস্তাব গ্রহণের অপারগতার কথা জানান। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়। ২৭টি দেশ এ প্রস্তাবকে সমর্থন করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পায়। যে দিবসটি শুধু ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হতো আজ তা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস; যা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রায় ১৯৪টি রাষ্ট্র একযোগে পালন করে থাকে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর সর্বসম্মত গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হলোÑ প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোন ভাষার ওপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা। এ দিবসে প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালবাসবে তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। মহান ২১ ফেব্রুয়ারির মর্মবাণী গ্রহণ করে মাতৃভাষাকে ভালবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ। তাই পরিশেষে বলতে পারি যে, ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতির চরম ত্যাগ, অসীম সাহসিকতা ও পরম প্রাপ্তির ইতিহাস। এর প্রেরণার কোন শেষ নেই। লেখক : প্রাবন্ধিক
×