ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

হরফ

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

হরফ

বদরুল মিয়া ওরফে বদু মিয়া ঘেমে একাকার হয়ে গোয়ালপুর বাজারের পশ্চিম পাশে মেহেগনি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। জামার বুকের বোতামটি খুলে একটু নাড়া দিয়ে শরীরে বাতাস দেয়। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখে গাছের পাতা নড়ছে কিনা। না, গাছের পাতা অনড়, একটু বাতাসের লেশমাত্র নেই। হারগিলে চেহারার বিশোর্ধ বদু মিয়া ছন্নছাড়া, ভবঘুরে। কোথা থেকে কোথায় যায় কেউ বলতে পারে না। এই বাজারে এসেছে পাঁচ বছর পর। বৈশাখের প্রচন্ড খরতাপে পায়ের নিচের মাটি মুড়ি ভাজার বালির মতো তপ্ত। মাথার উপরে সূর্য, রোদের জেল্লায় আগুনের হল্কা ঠিকরে পড়ছে। লু হাওয়া আর দাবদাহে প্রায় জনহীন জনপদে কখনো দু-এককজন মানুষ দেখা যায় গাছের ছায়ায় বসে গামছা দিয়ে বাতাস করে হাঁফফাঁস করছে। এই সময়টিতে গোয়ালপুর বাজারে এমনিতেই মানুষের আনাগোনা খুব কম, তার উপরে এমন প্রচ- দাবদাহের কারণে বাজারে মানুষজন নেই বললেই চলে। দোকানিরা গদিতে বসে ঝিমুচ্ছে। এক সময়য়ের জমজমাট গোয়ালপুর বাজারটি এখন জৌলুশ হারিয়েছে। আগে রবিবার আর বৃহস্পতিবারে হাট বসত, বিশ গ্রামের মানুষ আসত দুপুর থেকে, মাঝ রাত অবধি হাট থাকত রমরমা, মানুষের কলকাকলিতে গমগম করত। হাটবার ছাড়াও অন্যবারেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কম বেচাকেনা হতো না। চায়ের স্টলগুলো গমগম করত। এখন আশপাশে, বলতে গেলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সকালে-বিকেলে বাজার বসে, ফেরিওয়ালারা কাঁচাবাজার নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়; গ্রামের মানুষ হয়েছে আয়েশি—সেই রকম হাটও বসে না, দিনের বেলায়ও আগের মতো বেচাকেনা নেই। কঙ্কালের মতো বাজারে কয়েকটি বড় বড় দোকানে কিছু মানুষ এসে প্রয়োজনীয় সওদা করে, তাও হাতেগোনা। বাজারে আশপাশের কিছু মানুষ আসে চা খায়, আড্ডা দেয়, রাজনীতির তথ্য ঝাড়ে, ঝড় তোলে চায়ের কাপে। আজকে সেরকম আড্ডাও চোখে পড়ছে না। রহমত আলির নতুন চায়ের স্টলটি বাজারের মাঝখানে, সুধীরের মিষ্টির দোকানের পাশে। এক সময় সুধীরের মিষ্টির দোকানের নাম বিশ গ্রামের মানুষে জানত, সেই দোকানের ব্যবসাও এখন তলানিতে। রহমত আলির চায়ের স্টলটি এক বছর আগে দিয়েছে। কাস্টমার আকৃষ্ট করার জন্য টিনের বেড়ায় সিনেমার পোস্টার, নায়িকার খোলা নাভি, মোচড় দেওয়া কোমর, বক্ষবন্ধীতে পুরুষ্ট যুগলচাঁদের ছবি সাঁটিয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে একটি চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি লাগিয়েছে যেখানে সারাক্ষণ হিন্দি সিনেমা চলে। আর ঈশানকোণে আরবি অথবা উর্দু হরফের পত্রিকার কয়েকটি পাতা খুব যত্ন করে সেঁটেছে। এভাবে আলাদা করে পত্রিকা সাঁটানোর রহস্য কী তা কেবল রহমত আলিই জানে। এসব পত্রিকার লেখা বা হরফ কারও চোখে পড়েছে কিনা অথবা কেউ পড়ে কিনা কে জানে? সুধীরের দোকানে দুটি গজা খেয়ে দু গ্লাস পানি ঢক ঢক করে গিলে বিল চুকিয়ে রহমত আলির দোকানে ঈশান কোনে বসে চায়ের অর্ডার দেয় বদু মিয়া। চা শেষ করে পান মুখে গুঁজে সিগারেট জ্বালিয়ে পিছনে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে দম দেয়ার সময়ই চোখে পড়ে বিশেষ কায়দায় সাঁটানো ঈশান কোনের পত্রিকার পাতাগুলো। একটু চোখ বুলিয়ে মুখ বিকৃত করে বিতৃষ্ণা উগরে দিয়ে একটি পত্রিকা ছিঁড়ে ঘৃণাভরে মেঝেতে ছোড়ে বিরক্তিসহ বলল, হুম। দুটি ক্রিয়া একই সময়ে সম্পন্ন হয়: পত্রিকা ছেঁড়া ও মাটিতে ছোড়ে ফেলা আর হুম্মত আলির চায়ের স্টলে প্রবেশ। শক্ত কাঠামো ও পেশির গাট্টাগোট্টা হুম্মত আলি এই বাজারের নানা কাজের লোক বলে অনেক খ্যাতি রয়েছে তার। বাজার পরিষ্কার করা, হাটবারে ইজারা তোলা, ব্যবসায়ীদের ফুটফরমায়েশ খাটা, মালামাল টানাটানি করা, ঢোল পিটানো ছাড়াও ব্যবসায়ীদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া। পত্রিকা ছেঁড়া ও ছুড়ে ফেলার দৃশ্যটি হুম্মত আলির নজরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘হায় হায়, কুরানের হরফ ছিইড়া মাডিত ফালাইছে। শালা কাফের।’ কথাগুলো বলতে বলতেই চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্রগতিতে বদু মিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টেনে হিঁচড়ে দোকান থেকে বের করে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে ধরাশায়ী করে নিরক্ষর হুম্মত আলি। পত্রিকার পাতার লেখা আরবি, ফার্সী না উর্দু হরফের তা বোঝার শুধু হুম্মতের নয়, এই বাজারের কারোই নেই। সবারই ধারণা এসব লেখা কুরআনের হরফের, এর বেশি কিছু ভাবার বা বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। এক বছর আগে কোন এক কবিরাজের দেয়ার কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলাতে রহমত আলিও আক্রোশে ফেটে পড়ে, ক্রোধের আগুন চোখ থেকে ঠিকরে পড়ে, লোকটির প্রতি তার প্রবল ঘিন্নাও হয়। কিন্তু অত্যন্ত ভিরু ও নরম মনের মানুষ হওয়ায় বদুকে সে মারতে আসেনি। নিজের জায়গাতেই ওঠবস করতে করতে গজগজ করতে, কী করল, কী করল? সর্বনাশ করল। ওর হাঁটু কাঁপছে, শরীর থেকে ঘাম ঝরছে, তালপাতার পাখায় বাতাস করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বড় পাপের ফলে বড় ক্ষতি করে ফেলেছে বলে উষ্মা ও আক্রোশ প্রকাশ করছে। একবার সে গদিতে বসে আরেকবার উঠে দাঁড়ায়। তার অস্থিরতা দেখে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দু-একজনও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। বদু মিয়াকে কিল, ঘুষি, লাথি মারার সময় হুম্মতের আক্রোশের চিৎকার আর বদু মিয়ার আর্ত-চিৎকার শুনে বাজারের গলিঘুপচিতে বিশ্রামরত মানুষরা ছোটাছুটি করে আসতে শুরু করে রহমত আলির দোকানে। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বদু মিয়াকে প্রথমে চ্যাঙদোলা করে তুলে নিয়ে যায় বটতলা এবং সেখানে বাঁশের খুঁটিতে হাটের গরুর মতো শক্ত করে বাঁধে হুম্মত আলি। ক্রমে হুম্মতের কথায় পাখায় গজায়। দোকান থেকে দোকানে। সেখান থেকে আশপাশে চাউর হয় ‘কুরানের হরফ পাও দিয়া পাড়াইছে এক কাফের। তার চোখ তুইল্যা তারফরে কতল করা অইবো।’ বাজারের মানুষের সরগোল এবং হুম্মতের কথা বাজার কমিটির সদস্যদের কাছে পৌঁছানোর পর তারাও ক্ষোভে তেতে ওঠে। সবাই মিলে জরুরী মিটিং করার জন্য বসে সভাপতির ধানের গুদামের পেছনের একটি নীরব কোটায়। বদু মিয়াকে কতল করা হবে এই খবরটি বাজারের পাশের এলাকায় চাউর হওয়ার পরেই আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে আসে এবং ক্রমে জোয়ারের মতো মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে বটতলায়। এত মানুষকে দেখে বাজার কমিটির লোকজনের চাঁদি গরম হয়ে ওঠে। এত মানুষকে সামলাবে কী করে? কমিটির সহ-সভাপতি আগেই বলেছিল, ভুঁড়ি ফাইর‌্যা লা। এত সোমায় দেয়ার দরহার কী? কুরানের হরফের অপমান, সইহ্য করা যায়? এখন লোকের ভিড় সামলাতে তাড়াহুড়ো করে বদু মিয়াকে ঘিরে একটি বাঁশের বেড়া দেয়া হয়। মানুষজন বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, বদু মিয়ার বৃত্তের মাঝখানে খুঁটিতে বাঁধা হেলেপড়া মাথাটি নিয়ে কোনক্রমে বসে আছে নিস্তেজ হয়ে। মাথাটা কোনভাবেই সোজা রাখতে পারে না সে। ন্যুব্জ মাথাটি ঋজু করার জন্য বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আধমরা বদু মিয়ার পূর্ণ মৃত্যুর দায়িত্বটুকুও নিয়েছে হুম্মত আলি। তাকে হত্যা করার জন্য একটি কিরিচ একখন্ড বাঁশে উপর কড়কড়ে বালি দিয়ে ঘষে ঘষে শান দেয়ার পর্ব শেষ করে সে হুকুমের অপেক্ষায় বসে বিড়ি ফুঁকছে বটতলায় একটি ইটের উপর বসে। আজকের খুনের আসরে জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তাকে নায়ক হিসেবে দর্শনার্থীরা সমীহের চোখে দেখছে। হুম্মতের চোখেমুখেও ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী গাজির গাম্ভীর্য ভর করেছে। তা তো হওয়ারই কথা। কেননা, হুম্মতের চোখেই প্রথম ধরা পড়েছিল বদু মিয়ার হরফ ছিঁড়ে মাটিতে ফেলার ঘটনা। আর মারতে মারতে আধমরা করে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা পর্যন্ত পুরো কীর্তিটুকু বলতে গেলে তার একারই পাওনা। আর বাজারে দু-একজন সামান্য হাতপা লাগিয়েছে যা ধর্তব্য নয়। কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে তার চোখেমুখে গাম্ভীর্য ফুটে ওঠারই কথা। প্রথমাবস্থায় বদু কাফেরকে হত্যার বিষয়টি সুরাহা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ক্রমে ক্রোধ কিছুটা শিথিল হলে বাজার কমিটির সদস্যদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত মতামত দেখা দেয়াতে বদু মিয়ার কতলের সময়টুকু দীর্ঘতর হয়। আবার ফ্যাসাদ বাঁধে কীভাবে কতল করা হবে সেই প্রশ্নেও। কঠিন শাস্তি ছাড়া তো সহজে মরতে দেয়া যায় না। আরও দু-একটি অমীমাংসিত প্রশ্নে বাজার কমিটির সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত। একদল, যে দলের পক্ষে সদস্যের সংখ্যা কম তারা বলছে, এত বড় অপরাধ করে, কুরানের পাতা ছিঁড়ে যে পাপ করল এই পাপ শুধু ওর একার নয়, এই পাপ পুরো এলাকার মানুষের। তাকে কতল করলেই কেবল পাপমুক্তি হতে পারে। আবার অন্যপক্ষ শান্ত, কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত। তারা ভাবছে একদিকে পরকালের জন্য তাকে কতল করা একান্ত প্রয়োজন হলেও থানা পুলিশ সামলাবে কে? পরকালের মুক্তির কথা যেমন ভাবছে ঠিক তেমনি খুঁজছে পুলিশের ঝামেলা থেকে বাঁচার যুক্তিও। তাই দ্বিতীয় পক্ষের অবস্থান নড়বড়ে। জনতার হাতে ধৃত ও মৃত, অর্থাৎ গণপিটুনির হত্যার দায় কারও উপর বর্তায় না কিংবা মাস দু-এক পালিয়ে থাকলে এ ধরনের মামলা থিতিয়ে পানি হয় এমন জ্ঞান সবার আছে। তারপর বদু, সে কোথাকার মোনাফেক, কোথাকার নাস্তিক যে নাস্তিককে হত্যা করলে মামলা করার জন্য বাদী কোথায় পাবে? কে দেবে সাক্ষ্য? বড়জোর হতে পারে পুলিশ কেস। পুলিশ কেসের কোন মা-বাপ আছে? সাক্ষ্য দেয়ার মতো মানুষ কি পাবে? যদিও কাউকে পাওয়া যায় কিছু টাকা পয়সা দিলে কচ্ছপের মতো গর্তে লুকোবে। এমন এলোমেলো আলোচনা বাজার কমিটির সভাপতি আসগরের গুদামের পেছনের ফাঁকা রুমটিতে চলতে থাকে। বাজার কমিটির নবীন সদস্য নিয়াজ হুঙ্কার দিয়ে বলল, এই কাফেরের বাড়ি কই? এর একটু খুজটুজ নেওনও তো দরহার, নাকি? কাফেরের মিত্যুদ- জায়েজ, কিন্তু তথ্যতালাশ না লইয়া মারলে এই খুনের দায় কেডা লইব? নিয়াজের কথাটি মনে ধরে সভাপতির। নাকের ডগায় চশমা নামিয়ে তাকে দেখে বিভ্রান্তও হয়। হেদিনের পোলা অইল বাজার কমিটির মেম্বার, কী বুঝে? তবে নিয়াজের ভূমিকা-প্রথমে দুর্বিনীত হুঙ্কার, ঠিক পরক্ষণেই কথার চাল মারল তথ্যতালাশ করার, এই দ্বৈতদ্যোতনা কমিটির অন্য সদস্যরা বুঝতে না পারলেও সভাপতির মনে কাঁটা বিঁধিয়ে দেয়। অনুচ্চারে বলল, এই পোলার কথার মধ্যে পুলিটিক্স আছে। এই কাফের ছোকড়াকে কেউ এ তল্লাটে দেখেছে বলে মনে হয় না। যদি হতো তাহলে কেউ না কেউ আসত উদ্ধার করার জন্য, সভাপতি এমন ভাব প্রকাশ করলেন। তিনি আরও গম্ভীর হয়ে নিয়াজকে শুধোলেন, কথাডা মিয়া খারাপ কও নাই। দ্যাহো এই ফোলার সাকিন কই? কতল করার সোমায় তো আর চইল্যা যাইতাছে না। বহুত সোময় আছে। নিয়াজ গুদামঘর থেকে বের হয়ে বটতলায় এসে সিগারেটে দম দিয়ে দাঁড়ায়। বদু মিয়ার অবস্থা যেনতেন। যখন তখন বিদায় হতে পারে। হুম্মত আয়েশে বিড়িতে দম দিয়ে ঝিম ধরে বসে আছে শান দেয়া কিরিচ হাতে। শুধু হুকুম পেলেই বদু মিয়ার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করবে। হুম্মত নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে বাজার কমিটির কোন হুকুমনামা এসেছে কিনা। নিয়াজকে ঠান্ডা মনে হওয়াতে হম্মত নড়েচড়ে বসে। ভাবে, আরও হয়ত দেরি হতে পারে। ঝিঝিধরা পায়ে টান দিয়ে দুইঞ্চি পরিমাণ একটি কাঠি মাটি থেকে কুড়িয়ে কানের উপরে গুঁজে দেয়। কানের উপরে কাঠি গুঁজে দিলে পায়ের ঝিঁঝি কমে যায়, এ-রকম বিশ্বাস এই জনপদের মানুষের রয়েছে। নিয়াজ বিভিন্ন কৌশলে শেষ পর্যন্ত চারজনকে খুঁজে পায় যারা বদুকে চিনে বলে জানায়। তাদের সঙ্গে নিয়ে কমিটির সদস্যদের সামনে হাজির হয় নিয়াজ। সভাপতির আদেশে চারজনের বয়ান শুরু হয়- প্রথম ব্যক্তি : আমার সাকিন দুসকাইন। আমি হেরে চিনি। ওর বাড়ি ভাডি এলাহায়। বাপমা নাই। এতিম মানুষ। লজিং থাইক্যা ফড়তো কান্দাইলের মাদরাসাত। দ্বিতীয় ব্যক্তি : আমার বাড়ি কান্দাইল। মানুষডা খুব দুইক্যা। লেহাফড়ায় খুব ভালা আছিলো। তয় চরিত্র খারাপ। গান গাইত। বাঁশি বাজাইত রাইতে। হাওড়ের মাঝখানে রাইতে চইলা যাইত বাঁশি বাজানোর লাইগ্যা। তারফরে একদিন চান্নি রাইতে হেরে আসামনের পরি ধইর‌্যা লইয়া গেল গা। কেউ কয় জিনে ধইর‌্যা লইয়া গেছে। চান্নি রাইতে একলা একলা বাঁশি বাজাইলে জিন-পরি ধরে, হগলেই জানুইন। এই ফোলাডারে পরি ধইরলো। জেরেবাদে মেলাদিন ফরে ফাওয়া গেল যাত্রাগানের দলে। আর লেহাফড়া করল না। সভাপতির জেরা : চরিত্র খারাপ আছিল এই কতার মানে কী? দ্বিতীয় ব্যক্তি : এই যে কইলাম না? গান গাইত। বাঁশি বাজাইত। নিয়াজের জেরা : গান গাইলে আর বাঁশি বাজাইলে কি চরিত্র খারাপ অয়? দ্বিতীয় ব্যক্তি : হে হে হে। তয় অয় না? মুসলমানের ফোলা অইয়া ক্যামনে গান করে? তৃতীয় ব্যক্তি : আমার সাকিন উরদাইল। এই লুকের নাম বদরুল মিয়া। আমরা ডাকতাম ‘বদু মিয়া’। খুব ভালা ছাত্র আছিল। তয় খুব দুইক্যা মানুষ। মাবাপ মরছিল নৌকা ডুইব্যা। ছাত্রজীবনে মাঝে মাঝে কই যাইত কেউ জানত না। তারফরে মেলা দিন ফরে হিরেবার ফিইর‌্যা আইত। একমাস দুই মাস থাকত নিরুদ্দেশ। মাইনষে কইত, দুইক্ক্যা মনিস্যির মতিগতির ঠিক নাই। বে-ঠাওর। তয় হে কাফের কিনা তা জানি না। চতুর্থ ব্যক্তি : এই লোকটি ছোড থাইক্যাই বড় ত্যান্দর। কিছুদিন উর্দু কিতাব ফড়ার ফরে হে জেদ ধরল উর্দু কিতাব ফড়ত না। একদিন দেওয়াডির হুজুর কাঁচা কইঞ্চা দিয়া ফিডাইয়া রক্ত বাইর করল। এরফরেই হে নিরুদ্দেশ। বহুদিন ফরে আইজই দেখলাম হেরে। নিয়াজ নীরব ও একনিষ্ঠ শ্রোতা মুখ তুলে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, উর্দু কিতাব ফড়তো না ক্যান? চতুর্থ ব্যক্তি : ত্যান্দর ফোলা, তহন বয়স দশ বারো অইবো, কইতো উর্দু পাকিস্তানীদের ভাষা, আমি এই কিতাব ফড়তাম না। অহনও দেককোয়াইন, মুহে দাড়ি নাই, ফাঞ্জাবি নাই, আছে শাট, লুঙ্গি নাই, প্যান্ট লাগাইছে। কেমন ত্যান্দর অহন বুঝুইন। সহ-সভাপতিও এতক্ষণ নীরব ও একনিষ্ঠ শ্রোতা থাকলেও এখন মনে হলো পেটের ভেতরে হাসিটা আর চাপা রাখতে পারেননি, হো হো হো করে হেসে পেট খোলাসা করে বলল, দেশপ্রেম। বাহ্! তাজ্জব ব্যাপার। উর্দু কিতাব ফড়তো না। উপস্থিত সকল সদস্যের মনোজগতে এখন নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে। দুইক্কা মানুষডার লগে যদি সত্যি সত্যি জিন-পরি কিছু থাহে? ভালা ছাত্র আছিল, আহা! মাদরাসায় পড়ত, ক্যামনে কাফের অইলো? উর্দু কিতাব পড়তো না ক্যান? উর্দু কিতাব ছাড়া কি মাদরাসাত পড়ন যায়? এসব ভাবসঞ্জাত প্রশ্নাবলি কেবল তাদের মনের ভেতরেই উত্থিত হতে থাকে, কারো মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়নি। একটা অকাট্য জমাট স্তব্ধতার গহিনে এই ঘরের মানুষগুলো তলিয়ে যায়। মাঝে মাঝে দু-একটি মৃদু নিঃশ^াসের শব্দ না হলে হয়তো হিমলাশঘরই বলা যেত। কিছুক্ষণ স্তব্ধতায় ডুবে থেকে সভাপতি মাথা তুলে ব্যক্তিবর্গকে জিজ্ঞেস করেন, তার সায়সাকিন কই তোমরা কি জানো? প্রায় সমস্বরেই উত্তর : জি না, আমরার জানা নাই। ভাডি এলাহার মানুষ। চার ব্যক্তি গুদাম ছেড়ে পুনরায় বদু হত্যার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য বাঁশের বেড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হত্যাকান্ডের দেরি, বা অনিশ্চয়তা দেখে জরুরী কাজের মানুষগুলো ক্রমে বটতলা ছেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আর দুর্বলচিত্তের মানুষেরা, যারা মানুষ খুনের দৃশ্য দেখার জন্য বুকে সুরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারাও ক্রমে সটকে পড়ে। এখন সব মিলিয়ে শ’খানেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে একটি কাফেরের হত্যার দৃশ্য দেখার জন্য। এ পৃথিবীতে মানুষ খুনের দৃশ্য দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয় এমন মানুষ যেমন আছে আবার প্রত্যক্ষ করে উল্লাস করার মতো মানুষের অভাব নেই। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন আছে এর আগে এক চোরকে পিটিয়ে হত্যার সময় প্রত্যক্ষ করেছে। সেই দশ বছর আগের হত্যার ঘটনাটি এখনও নিখুঁতভাবে বর্ণনা করে, চোরের কাতরানি, করুণ আর্তনাদ যখন অভিনয় করে দেখায় তখন নিষ্ঠুরতাই প্রকাশ পায়। তাদের সেই অভিনয় দেখে দুর্বলচিত্তের মানুষদের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়, নালত দেয়; পাষাণ চিত্তের মানুষেরা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। হুম্মত মাঝে মাঝে কিরিচের শান পরখ করতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে স্পর্শ করে, তখনই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দৃষ্টি বিপুল উৎসাহে সেদিকেই আছড়ে পড়ে। আজকের এই খুনের যজ্ঞের মহানায়ক হুম্মত। তার সাহসের তারিফও করে তারা। বাজার কমিটির সভাপতি বললেন, আর বিলম্ব করা ঠিক নয়। যদি ওরে কতলকরণই লাগে তাড়াতাড়ি কর। আর যদি ছাড়নই লাগে তাও তাড়াতাড়ি করো। বেইল ফইরা গেছে। বড় ভুক লাগছে। সহ-সভাপতির রক্ত টববগিয়ে ওঠে। দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, কাফেরকে আবার ছাড়াছাড়ি কী? কুরানের হরফের অপমান মুসলমান অইয়া মাইনা নিবা তোমরা? মুসলমানের দেশে কাফের বাইচ্যা থাকব? তা অইবো না। নিয়াজ গা-ঝাড়া দিয়ে বলল, খুনের দায়িত্ব তাইলে আফনের নেওন লাগব। থানা-পুলিশের দায়িত্বও আফনে নিবাইন। সাপের ফণার মতো সহ-সভাপতি ঔদ্ধত্যে যেন লাঠির টোকা পড়ে, ফণা নামালেও ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, হ, যাও মিয়া। একটা কাফেররে পক্ষ লইলা তোমরা। তোমরার পরকাল নাই মিয়ারা? ফুলসেরাত পার অওন লাগব না? বিষয়টি অমীমাংসিত থাকার চেয়ে একটি ফয়সালার দিকে যাওয়া ভাল মনে করে নিয়াজ বলল, আসলে যে লেখাটা ছিঁড়ল এর মধ্যে কী আছে, এর মানে কী? এইডা কি কুরানের লেখা কিনা আফনেরা কেউ কি জানুইন? সবাইকে নিরুত্তর দেখে সে আবার বলল, আগে জানন দরহার এই লেহায় কী আছে? এর অর্থ কী? বেহুদা একটা মানুষকে মাডার করা ঠিক না। গুদামঘরে গুঞ্জন ওঠে, কথা ঠিক। কথা ঠিক। এই হরফে কি লেহা আছে তা জানা দরহার। নিয়াজ বলল, আমি বড় হুজুররে লইয়া আইতাছি। আফনেরা হগলে এইহানে থাকবাইন। যৌতুকের মোটর সাইকেলটি ছাড়া নিয়াজ এক দন্ড চলতে পারে না। পাড়ার মানুষেরা তো ব্যঙ্গ করেই বলে, অহন লেপটিনে গেলেও হুন্টা লইয়া যায়। যুগির ফোলা সাব অইছে। দশ মাইল দূরের বড় মাদরাসার বড় হুজুর যিনি আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষার পন্ডিত বলে খ্যাতি আছে, তাঁকে নিয়ে নিয়াজ দ্রুতই ফিরে আসে। কীভাবে কী হলো ভাবতে পারছে না রহমত আলি। হঠাৎ তার চা-স্টলকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। কেন সে এই কাজ করতে গিয়েছিল? বেচাকেনা মন্দাভাব দেখে রহমত আলি একদিন এক কবিরাজের কাছে গিয়েছিল তাবিজের জন্য যাতে দোকানে বেচাকেনা ভাল হয়। সেই কবিরাজ রসে রসিক আবার রহমত আলির দূর সম্পর্কে খালাত ভাই। কবিরাজি বলতে কিছুই জানে না। কবজে নানা রকম কাগজ দিয়ে টাকা রোজগার করাই তার এক প্রকার ব্যবসা। একবার ঢাকায় এসেছিল বেড়াতে। তারই এক আত্মীয়ের ভাঙালীর দোকানে একদিন উর্দু লেখার একটি ছেঁড়া বই পেয়ে সে বগলদাবা করে নিয়ে এসেছিল। এই বইয়ের কাগজ সে এখন তাবিজ হিসেবে মানুষকে দেয়। সেই কবিরাজই রহমত আলিকে সেই বইয়ের দুটি কাগজ দিয়ে বলেছিল, ঈশান কোনে টিনের বেড়ায় লাগায়া রাখবা। ঈশান কোণ চিনো মিয়া ভাই? না। অনুচ্চারে কবিরাজ বলে, চিনবা কেমনে? মূর্খ না হলে তো তাবিজ নিতে আসতে না। তারপর ঈশান কোণ দেখিয়ে ও বুঝিয়ে বলে কীভাবে দোকানে কাগজ লাগাতে হবে। এই কোণ। বুঝছো মিয়া ভাই? হ, বুঝছি। ওজু গোসল করে পাকপবিত্র হইয়া কাগজ লাগাইবা। কাগজ লাগানোর সময় নিঃশ^াস বন্ধ রাখবা। নিঃশ্বাস পড়লে ভবিষ্যতে বিপদ হইতে পারে। এসব হরফের কোন অপমান যেন না হয়। রহমত আলি সেই দুটি পাতা পরম শ্রদ্ধায় ও যত্নে এনে বেড়ায় লাগিয়েছিল। বেড়ায় সাঁটানোর সময় হুম্মতও সঙ্গে ছিল। হুম্মতের সঙ্গে রহমতের বাড়তি খাতির-আত্তিও আছে। খাতিরটা আছে কারণ, রহমত আলি বিনে পয়সা মাঝে মাঝে চা খাওয়ায়, আর কোনো কারণে নয়। আজকে বদুর ঘটনার পর থেকে রহমত দোকান থেকে বের হয়নি ভয়ে। সে চিন্তামগ্ন, ভাবছে কাগজ সাঁটানোর সময় নিঃশ^াস পড়েছিল কিনা। কী হতে কী হয়ে যায় কে জানে? তাকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। তার অন্তরাত্মা কাঁপছে। যদি সত্যি সত্যি মানুষটারে খুন করে ফেলে? চায়ের চুলো বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু বদুর পরিণতি দেখার অপেক্ষায় মুখ গোমড়া করে, কপালে ভাঁজ মেরে বসে আছে স্টলে। না-হয় এতক্ষণে বাড়ি চলে যেত। বড় হুজুরকে নিয়ে রহমতের দোকানে ঢোকে নিয়াজ। বাজার কমিটির সবাই এসে হাজির। নিয়াজ অবশ্যই বড় হুজুরকে আগেই এখানকার যাবতীয় ঘটনা সবিস্তারে বলেছিল। তাই সরাসরি রহমত আলির দোকানে ঢুকে জানতে চান, কী ছিঁড়ছিল? কোথায় আনো দেখি। সেই ছেঁড়া পত্রিকার কাগজটুকু খুঁজে না পেয়ে হুজুর ঈশান কোনে বসে টিনের বেড়ায় সাঁটানো উর্দু ভাষার লেখা পত্রিকা পড়েই নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ বলে দোকান থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন, এসব কাগজে ছিঁড়ো মিয়ারা। ছি, ছি। ওই মিয়ারা এসব ছিঁইড়া আইনা এগুলোর উপরে দাঁড়ায়া পেশাব করো। ক্রোধে হুজুরের চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। হুজুরের ক্রোধের মাত্রা যত বাড়ে বদু কাফেরকে হত্যা করার জন্য যারা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল তাদের ক্রোধের মাত্রা তত কমে। দীর্ঘক্ষণ পর সকলের ক্রোধ শিথিল হয়। রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। প্রকৃত সত্য হলো, টিনের বেড়ায় সাঁটানো দুটি পাতায় ছিল উর্দু ভাষায় রচিত সরেস যৌনতার গল্প।
×