ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একুশের অর্জন ও বিরূপ বাস্তবতা

প্রকাশিত: ১২:১২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  একুশের অর্জন ও বিরূপ বাস্তবতা

একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এদেশের ছাত্র সমাজ রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে যে আন্দোলন সংঘটিত করে, তা ইতিহাসের অনিবার্য এক আলোকিত অধ্যায়ের উন্মোচন ঘটায়। বাংলা ভাষা তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। শুধু তাই নয় এদেশের জনগণের স্বাধিকার আদায় থেকে শুরু করে স্বাধীনতার যুদ্ধ পর্যন্ত একুশ প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম ও সঙ্কটে আলোকবর্তিকা হিসাবে পথ দেখায়। একুশের অর্জন আমাদের জাতীয় জীবনে ব্যাপক, বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব বহন করে। একুশের অর্জন কী এবং কীভাবে তা আমাদের জীবন, সমাজ, রাজনীতি ও শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে বা করছে, তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। একুশের অর্জন মানে একুশের চেতনা। এ চেতনার বিশ্লেষণে বলা যায়, একুশের চেতনা হলো চিরায়ত বাঙালিত্বের ধারাকে বহাল, বহমান ও অক্ষুণœ রাখা। আমাদের চিন্তা ও বোধে তা সমুন্নত রাখার শপথ, তা পালন, লালন ও পরিশুদ্ধকরণের প্রক্রিয়ায় আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধ থাকা। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তের বেগবান ধারা সে চেতনায় নতুন করে সবাইকে জাগ্রত করেছে। তাই একুশের চেতনা হলো বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি আমাদের ভালবাসা, মমত্ববোধ। ৫৫ হাজার বর্গমাইল জুড়ে যে জনগোষ্ঠী হাজার বছর ধরে যে জীবন যাপন পদ্ধতি, যে আবহাওয়া, প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠেছে তাকে কেন্দ্র করে নিয়ত পথ চলা। সব ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সম্প্রীতির পরিবেশে বসবাস। এর ব্যত্যয়, এর বিপরীতে যে অবস্থান, যে তৎপরতা তা যেভাবেই আসুক না কেন, তার প্রতিবাদ, প্রতিরোধের কাতারে সবার মিল হওয়া। এ চেতনার স্ফুরণই একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন। একুশের তাৎক্ষণিক বা প্রত্যক্ষ ও চিরায়ত বা স্থায়ী দুই ধরনের অর্জন আমরা লক্ষ্য করি। তাৎক্ষণিক অর্জন দীর্ঘ মেয়াদে চিরায়ত বা স্থায়ী অর্জনে পরিণত হয় । জাতি সত্তার মূলে তা উর্বর পলির আস্তরণ গড়ে তোলে। একুশে ফেব্রুয়ারির অর্জনসমূহ আলোচনা করলে দাঁড়ায়- এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জনগণের প্রথম বিজয় অর্জিত হয় বাংলা ভাষার রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে। তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকার করে নেয়া হয়। যা ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে সংযোজিত হয়। ভাষা আন্দোনলনের বীর শহীদদের প্রতি সম্মান জানানো ও তাদের স্মৃতিকে ধারণ করে গড়ে ওঠে ‘শহীদ মিনার’। এ শহীদ মিনার পরিণত হয় বাঙালী জনগোষ্ঠীর ঐক্য, সংহতি ও জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীকে। শপথ ও জাগরণের চিরন্তন আধারে। একুশের আন্দোলন মধ্য দিয়ে এদেশের জনগণের মনে এ ধারণায় বদ্ধমূল হয় যে, শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে কোন ন্যায়সঙ্গত দাবি-দফাই চরম আন্দোলন, সংগ্রাম ছাড়া আদায় করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনে জীবনের বিনিময়েও তা আদায় করে নিতে হবে। একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্য এ বোধের জাগরণ এদেশের জনগণকে এক ইস্পাত কঠিন ঐক্যের সূত্রে গ্রথিত করে। তা পরবর্তী সকল আন্দোলনের প্রেরণা শক্তি হিসাবে কাজ করে। এরই প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয়তাবাদ, মৃত্তিকা প্রেম, দাবি আদায়ের অনড় মনোভাব ১৯৭১ সােেলর মহান মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর সর্বাত্মক আস্থা স্থাপন করে। যার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এদেশের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে নব জাগরণের দ্বার উন্মুক্ত করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। বাংলা ভাষা, সাহিত্যের বিকাশ, উন্নয়নে এ একাডেমি পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একুশকে কেন্দ্র করে, এর চেতনাকে ধারণ করে রচিত হয় নতুন গান, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক। মুনীর চৌধুরী নাটক ‘কবর’, জহির রায়হানের উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ শামসুর রাহমানের কবিতা ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, এ লাশ আমরা রাখব কোথায়, আালাউদদীন আল আজাদের ‘স্মৃতির মিনার’ কবিতা, আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গাজীউল হকের ‘ভুলবো না ভুলবো না এ একুশে ফেব্রুয়ারি’, ফজল এ খোদার লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এর মতো কালজয়ী কবিতা ও গান রচিত হয়। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ একুশ কেন্দ্রিক লেখার সংকলন হিসাবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রতিবছর সংকলন প্রকাশ এরপর থেকে ঐতিহ্যে পরিণত হয়। দেশব্যাপী প্রকাশিত অসংখ্য সংকলনের লেখাসমূহে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও শহীদদের প্রতি বাঙালিত্ব, চেতনার বহির্প্রকাশ ঘটে। একুশের এ চেতনা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চিরায়ত ধারাকে নতুনভাবে বেগবান করে তোলে। একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন শুধু ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি কখনও। তা ক্রমশ স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রেরণা শক্তি হিসাবেও কাজ করেছে। একুশের আন্দোলন এদেশের মানুষের মননে এক অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন চেতনার শক্ত ভিত তৈরি করে। সকল স্তরের মানুষ সেদিনের আন্দোলন, সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন ভাষা ও দেশপ্রেমের টানে, অস্তিত্ব রক্ষার অন্তর্গত অতল তাগিদে। একুশের ফেব্রুয়ারির এ অর্জন আন্তর্জাতিক মহলে বাঙালী জাতির পরিচয় ও প্রসারের ক্ষেত্রকে করে সম্প্রসারিত। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি যোগায়। নিজ ভাষা, সংস্কৃতির জন্য বিশ্বে প্রথম রক্তদানকারী জনগোষ্ঠী হিসাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমীহ ও সম্মান লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বহুবিধ অর্জন নানা কারণে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শহীদদের আত্মত্যাগ ও স্বপ্নের পুরোপুরি বাস্তবায়ন সুদূর পরাহত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রে দেখা গেছে দীর্ঘসূত্রতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কোন কোন মহলের অনীহা। বিরূপ বাস্তবতার তিমিরে মহান একুশের চেতনা যেন পথ হারিয়ে ফেলছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ, বিশ্বায়নের এ যুগে জাগতিক জীবনের পরিধি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে অনাকাক্সিক্ষত অনেক কিছু। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রসার, আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার নিজ সংস্কৃতির বলয়ে আঘাত করছে নিয়ত। বিশ্ব সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার জন্য, প্রতিযোগিতায় প্রত্যয়দীপ্ত অংশগ্রহণ, টিকে থাকার প্রশ্নে আমাদের অবশ্যই আধুনিকতার অরিহার্য অনুষঙ্গসমূহ গ্রহণ করতে হবে। অন্য ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সৃজনশীল, মৌলিক বিষয়গুলো আহরণ, চর্চায় সচেষ্ট ও মনোযোগী হতে হবে। তবে আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতি, অপচর্চা হবে আত্মনিধনেরই নামান্তর। এ প্রবণতার প্রসার আজ আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দেয়ালে ফাটল তৈরি করছে। মহান একুশের অর্জন আজ এরূপ বিরূপ বাস্তবতার মুখোমুখি। ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ আরেক বাস্তব সমস্যার সৃষ্টি করছে। সাম্প্রদায়িক ও বিছিন্নতাবাদী মনোভাবকে উস্কে দিচ্ছে। কখনও কখনও রাজনীতির নামে অপরাজনীতি, ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতা চর্চার বাড়াবাড়ি এসব কিছই একুশের চেতনার বৈপরীত্ব। সামাজিক সংহতি, ঐক্য ও দেশপ্রেমের পরিপন্থী। এ থেকে উত্তরণে একুশের চেতনার জাগরণই হতে হবে প্রধান নিয়ামক শক্তি। জাতিসত্তার প্রেরণাদানকারী এ একুশের অর্জন, একুশের চেতনাকে ধারণ ও বাস্তবায়ন করেই আমাদের এগুতে হবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্যে, সংস্কৃতির বিকাশ, প্রসার, উন্নয়নে এর কোন বিকল্প নেই বলেই মনে হয়।
×