ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনে ছাত্রী ও নারীদেরও ছিল সাহসী ভূমিকা

প্রকাশিত: ১২:০৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভাষা আন্দোলনে ছাত্রী ও নারীদেরও ছিল সাহসী ভূমিকা

ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই সংঘটিত ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অবিস্মরণীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এ আন্দোলন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণীর বাঙালীবিরোধী বৈষম্যমূলক ভূমিকার বিরুদ্ধে সাহসী এক সংগ্রাম। এর অন্যতম মূল কারিগর শ্রেণী ছাত্রছাত্রী এবং যুব সমাজের প্রগতিশীল অংশ। তাই মোটা দাগে ভাষা আন্দোলনের চরিত্র বিচারে একে ছাত্রছাত্রীদের অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই সঙ্গে যুবাদেরও আন্দোলন। তবে এক কথায় বলা হয় ‘ছাত্র আন্দোলন’ অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। আর সেই সূত্রে রাজনৈতিক বিচারে, এর চরিত্র রূপান্তরের বিচারে বলা হয়ে থাকে : ‘ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হলো।’ এ কথার বিশদ তাৎপর্য হলো ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন জনসাধারণ এবং কোথাও কোথাও শ্রমজীবী মানুষের সক্রিয় সমর্থনে এবং অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে পরিণত। এ ঘটনা ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এবং এর পরে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র- জেলা-মহকুমা-থানাসহ গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে। এভাবে ভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে একুশের আন্দোলন পূর্ববঙ্গ প্রদেশে সর্বজনীন আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, অসাধারণ এ আন্দোলন। ॥ দুই ॥ ভাষা আন্দোলনের জেন্ডার বিশেষণে অর্থাৎ নারীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির চরিত্র বিচার গুরুত্বপূর্ণ। রাভালি মুসলমান সমাজ পাকিস্তান পর্বেও যথেষ্ট পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল ঘেরাটোপে বাধা, পরিবারে অভিভাবক এবং শিক্ষায়তনে প্রশাসকদের কড়া নজরদারিতে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ- সে এক দুরূহ ঘটনা। এমন এক পরিস্থিতিতে ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ মার্চ এবং ১৯৫২ ফেব্রুয়ারির আবির্ভাব। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এমন এক বাধাবন্ধ পরিবেশে ছাত্রীদের পক্ষে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়া কতটা কঠিন ছিল। অসাধারণ ঘটনা যে সেই প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে বিভিন্ন বয়সী ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তখনকার রক্ষণশীল অবস্থার চরিত্র বুঝতে ১৯৫৪ সালে কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলনে একটি বলিষ্ঠ আহ্বানের উল্লেখই আমার মনে হয় যথেষ্ট। ওই সম্মেলনে নারী নেত্রী লায়লা সামাদের বক্তৃতা প্রসঙ্গে একটি বলিষ্ঠ আহ্বান এখনও মনে পড়ে : ‘ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এস নারী।’ তখন যুক্তফ্রন্ট তথা ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রিসভা, অনেকটা মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ- তখনকার ওই আহ্বান নারীদের পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয়। তবু প্রাদেশিক রাজধানী শহর ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের শহরগুলোতে, শিক্ষায়তনে ছাত্রীরা সাহসে ভর করে বাধা অতিক্রম করে পথে নেমেছে, সভায় যোগ দিয়েছে, প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়ে পথ হেঁটেছে, স্লোগান তুলেছে; ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে ঢাকার ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ছিল অগ্রচারীর ভূমিকা। শাফিয়া খাতুনের নেতৃত্বে অন্যান্য সিনিয়র, জুনিয়র, রাজনীতিমনস্ক বা নিছক মাতৃভাষাপ্রেমী ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এদের সর্বোত্তম ভূমিকা একুশের আন্দোলনে। সভায়, সমাবেশে, মিছিলে। কখনও ছাত্রীদের একক মিছিলের পদচারণাও দেখা গেছে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে হালিমা খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, সুফিয়া আহমেদ, শামসুন্নাহার, খোরশেদা খানম প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ইডেনের নেত্রী স্থানীয় ছাত্রী রওশন আরা বেগম ছাড়াও শরিফা খাতুন, লুৎফুন্নেছা বেগম, ফরিদা বারী, সুফিয়া করিম, মাহবুবা খাতুন (সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য) প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই ছিল ইডেনের ছাত্রীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা। পূর্বোক্ত বাধাধরা অবস্থার মধ্যে কামরুননেসা গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল বয়স বিচারে যেমন সাহসী, তেমনি রাজনৈতিক বিচারে অসাধারণ। এদের বড় একটি অংশ একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে আমতলার সভায় উপস্থিত ছিল। কী সাহসে যে দূর এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা প্রাঙ্গণে হেঁটে হাজির হয়েছিল ওরা ভাবলে অবাক হতে হয়। এদের মধ্যে নেত্রীস্থানীয় কাজী খালেদা খাতুন (পরবর্তীকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার হিসেবে আমার বিশেষ পরিচিত), জুলেখা হক, রওশন আহমদ প্রমুখ ছাত্রীদের সংগঠিত করে আর্টস বিল্ডিং প্রাঙ্গণে নিয়ে আসে। কামরুননেসার দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের অনেকে আন্দোলনে অংশ নেয়, অনেকেই আমতলার সভায় উপস্থিত থাকে। একুশের ভাষা আন্দোলনে মিটফোর্ড ছাত্রীদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এরা আবার প্রগতিশীল ঘরানার। কচিৎ দু’-একজন গণতন্ত্রী ধারার। যেমন নেত্রীস্থানীয় ছাত্রী হালিমা খাতুন। এ ছাড়া বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়ে ছাত্রীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ফাতেমা চৌধুরী, নার্গিস আদ্যতার, বীথি প্রমুখ ছাত্রীদের। এদের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে আমার যোগাযোগ ছিল। শুধু ছাত্রীরা নয়, বয়সী মহিলারাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাষিক প্রেরণায় একুশের ভাষা আন্দোলনে শুধু সমর্থনই জানাননি, সেই সঙ্গে আদর্শ ও কর্মসূচীর ক্ষেত্রেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। যেমন ২৬ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ১২ নম্বর অভয় দাস লেনে মহিলাদের বড়সড় এক সমাবেশে অনেক মহিলা দূর থেকে এসে যোগ দেন। এতে সভাপতিত্ব করেন সুফিয়া কামাল। উপস্থিত ছিলেন ছাত্রী সনজিদা খাতুন। এ ছাড়া আজিমপুর কলোনির মহিলারাও সংঘবদ্ধভাবে ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ সমর্থনের মাধ্যমে সেকালের পরিবেশে ইতিহাস রচনা করেছিলেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ১৯৪৮-এর বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫২ ফেব্রুয়ারির তথা একুশের আন্দোলনে পুরান ঢাকার তরুণ ও যুবারা যেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি ঢাকাই মহিলারা আন্তরিক সমর্থন জানিয়েছেন। বোরখা পরিহিত মহিলাদের কাছে থেকে আন্তরিক সহযোগিতা অবিস্মরণীয়। তেমনি ঢাকাই তরুণীদের অনুরূপ সহানুভূতির প্রকাশ- আরমানিটোলা ময়দানের আশপাশে জমায়েত ভাষাপ্রেমী, নবাবপুর রোডে চলমান মিছিলে পাশের দালানের ছাদ থেকে আগ্রহী দৃষ্টিপাত, কখনও পুষ্পবৃষ্টি হিসেবে মেলে না। তবু এ সত্য অস্বীকার করা চলে না। ॥ তিন ॥ মাঝে মাঝে বিস্ময় নিয়ে ভাবি, একুশের আন্দোলনে কী জাদুকাঠির স্পর্শ ছিল যে রক্ষণশীল ঢাকাই তরুণ-তরুণীরা এ আন্দোলনে যথাক্রমে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন ও সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিল, এমনকি বোরখাবৃতা অন্তঃপুরিকারা। আর দাপুটে ঢাকাই মুরব্বি বা সর্দারদের কেউ কেউ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ভাষা সংগ্রামী রাজবন্দীদের জন্য বিরিয়ানি, কেক, রুটি, বিস্কুট পাঠিয়েছিলেন হৃদয়ের সহানুভূতির টানে। শুধু ঢাকাতেই নয়, ছাত্ররা বিভিন্ন শহরের শিক্ষায়তন থেকে বের হয়ে এসে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আন্দোলন শুরু করেছে। তাতে অংশ নিয়েছে ছাত্রীরা। নেতৃস্থানীয় ছাত্রীরা সংগঠিত করেছে সাধারণ ছাত্রীদের- জেলা শহর থেকে মহকুমা শহর পর্যন্ত কলেজ ও স্কুলছাত্রীরা এ মহতী সংগ্রামে অংশ নিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। যেমন হরগঙ্গা কলেজের স্মৃতিকণা গুহ, রাজশাহীতে জাহানারা বেগম, মনোয়ারা রহমান, মোহসেনা বেগমসহ বেশকিছু ছাত্রী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লক্ষণীয় যে প্রায় প্রতিটি জেলাশহর ও মহকুমা শহরে ছাত্রী নেতৃত্বও গড়ে উঠেছিল কলেজ বা স্কুলের ছাত্রীদের আন্দোলনে সংগঠিত করতে, যাদের কারও কারও নাম ইতোপূর্বে উল্লিখিত। যেমন বগুড়ায় রহিমা খাতুন ও সালেহা খাতুন, পাবনায় জাহানারা প্রধান, সুফিয়া বেগম, নূরজাহান বেগম, হালিমা খাতুন, রাবেয়া প্রমুখের ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। পিছিয়ে ছিল না সিরাজগঞ্জের ছাত্রীরা। মেহের নিগার, নূর এলাহি, বিজলি প্রমুখ স্কুল ছাত্রীরা একুশের আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে ১৯৪৮ থেকেই সিলেটের সংগ্রামী নারীদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা- যেমন জোবেদা খাতুন, শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, সৈয়দ নজিবুন্নেচ্ছা খাতুন, বারেয়া খাতুন, হাজেরা মাহমুদ, তেভাগাখ্যাত নড়াইলের কৃষক নেতা নূরুজালালের কন্যা রিজিয়া খাতুনের নেতৃত্বে সেখানকার ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। তবে সবচেয়ে বিস্ফোরক ঘটনা নারায়ণগঞ্জে মর্গান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের ভাষা আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকা, সেখানকার ছাত্রীদের সংগঠিত কর নারায়ণগঞ্জ অগ্নিগর্ভ করে তোলেন। পরিণামে তার পারিবারিক জীবন বিনষ্ট, এক ট্রাজিক জীবনযাপন। স্বাধীন বাংলাদেশও তাকে যথাযথ মর্যাদা দেয়নি। শেষ কথা- তখনকার সামাজিক পরিবেশের তুলনায় ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা গর্ব ও অহঙ্কারের।
×