ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রন্থমেলা প্রতিদিন

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০; আপডেট: ১২:১২, ২৯ অক্টোবর ২০২৩

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মনোয়ার হোসেন ॥ কিছু মানুষের ক্ষুধার যেন শেষ নেই। সেই আগ্রাসী ক্ষুধায় হারিয়ে যায় ভূমি থেকে বনভূমি, জমি থেকে নদ-নদী। এবার সেই দখলবাজ ক্ষুধার্তদের নদী দখলের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে অভিযান। প্রভাবশালী নদীখেকোদের চোখ রাঙ্গানিকে উপেক্ষা করে ঢাকার চারপাশের নদী দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলছে বিআইডব্লিউটিএ পরিচালিত নদীকে দখলমুক্ত করার অভিযান। দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযানে তুরাগ নদকে দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। সরকারের এই তৎপরতায় স্বস্তি বইছে শহরবাসীর মনে। তাদের প্রত্যাশা, সরকারের অনড় অবস্থানে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীর বুক থেকে সরে যাবে জঞ্জাল। বছরজুড়ে নদীতে থাকবে পানির প্রবাহ। আর নাব্য ফিরে পেলে নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখবে নদী। এবার আসি অমর একুশে গ্রন্থমেলার কথায়। এখন শহরের সংস্কৃতিবান মানুষের তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে এই মেলা। বই প্রেমীদের পাশাপাশি যারা পড়ে না বা সংগ্রহ করে না তাদের কাছেও এই মেলাটি নির্মল আনন্দের উৎস। তবে ভাষা শহীদদের নিবেদিত একুশের বইমেলা মানেই শুধু বইয়ের বিকিকিনি নয়। মনন বিকাশের এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চেতনার স্রোতধারা। যেখানে মুক্তচিন্তার চর্চাটি এগুবে তার আপন পথ রেখায়। কিন্তু এই মুক্তচিন্তার বুকে অনেক আগেই আঘাত হেনেছে মৌলবাদ। সেই সূত্রে সংকুচিত হয়েছে ধর্মীয় গোড়ামিকে উপেক্ষা করে মুক্তমনা লেখকের ভাবনার প্রকাশ। তাই তো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ভয়ে বইমেলায় পাওয়া যায় না বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বই। বিশ্বাসের ভাইরাস ও অবিশ্বাসের দর্শন নামের বই লিখে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে জঙ্গীদের চাপাতির কোপে প্রাণ হারিয়েছিলেন এই লেখক। অন্যদিকে মৌলবাদীদের হুমকি সত্ত্বেও বই তুলে না নেয়ায় একইভাবে খুন হন প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। বইমেলায় জাগৃতির স্টলে ঠাঁইপ্রাপ্ত গালে হাত রাখা দীপনের সাদা-কালো ছবিটি একইসঙ্গে মৌলবাদের নিষ্ঠুরতা ও বেদনার আখ্যান হয়ে ধরা দেয়। তবে দীপনের দেখা মিললেও প্রকাশনা সংস্থাটি থেকে হারিয়ে গেছে অভিজিতের বই। বৃহস্পতিবার এক পাঠক খুঁজছিলেন অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। বইটি না পেয়ে হতাশ হয়ে এই পাঠক চলে যান অন্য স্টলে। অনুসন্ধানে স্টলটির বিপণনকর্মী অতন্দ্রিলা জানান, মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে বইটি স্টলে রাখা হয় না। শুধু তাই নয়, অভিজিৎ রায়ের দুটি বইয়ের সব কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বইয়ের সঙ্গে পুড়েছে মুক্ত মনন। প্রাণের মেলা বলা হলেও জঙ্গীবাদের নিষ্ঠুরতার শিকার তরুণ লেখক অভিজিৎ ও প্রকাশক দীপনের কথা যেন বেমালুম ভুলে গেছে সবাই। তাদের স্মরণ বা শ্রদ্ধা জানিয়ে কখনোই কোন আয়োজন করেনি গ্রন্থমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। একইভাবে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিসহ কোন প্রকাশনা সংস্থাই কখনো স্মরণ করেনি এই দুজনকে। তাহলে অভিজিৎ ও দীপন কী বই লিখে এবং প্রকাশ করে অপরাধ করেছিল? মৌলবাদের কাছে কী পরাস্থ হচ্ছে মুক্তচিন্তার প্রতীক বইমেলা? কেন তাদের স্মরণ করা হয় না- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, আমি নিজেই এই বইমেলাতে জঙ্গীদের হামলার শিকার লেখক হুমায়ুন আজাদের মামলার সাক্ষ্য দিয়েছি। তাই অভিজিৎ ও দীপনকে নিয়ে ভবিষ্যতে সৃষ্টিশীল কিছু করতে চাই আমরা। নীরবতা পালন বা তাদের নামাঙ্কিত চত্বরের পরিবর্তে আমরা তাদের জন্য সর্বজনীন কিছু করতে চাই। অভিজিৎ ও দীপনের কাজের মূল্যায়ন করে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ বা তাদের নিয়ে সেমিনার আয়োজনের মতো কোন উদ্যোগ গ্রহণ করব। দীপন ও অভিজিতের পূর্বে ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ নামের উপন্যাস লিখে হামলার শিকার প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে জঙ্গীদের চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন লেখক। সে বছরের ১১ আগস্ট জার্মানির মিনউনিখে অবস্থানকালে তিনি মারা যান। এই লেখকের বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা আগামী প্রকাশনীর পক্ষ থেকে প্রতিবছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় স্মরণ করা হয় লেখককে। আগামীর প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, অভিজিৎ ও দীপন স্মরণে বাংলা একাডেমি এবং প্রকাশনা সংস্থাসমূহের অবশ্যই কিছু করা উচিত। বৃহস্পতিবার ছিল গ্রন্থমেলার উনিশতম দিন। নবীন বসন্তে সুন্দরতম রূপ পেয়েছে বইমেলা। দেখাদেখির পর্ব পেরিয়ে পাঠকরা এখন সংগ্রহ করছেন বই। শুক্রবার মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই আগের দিন বৃহস্পতিবার কিছু পাঠক ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বই সংগ্রহ করেছেন। মেলায় বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টল ঘুরে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক কয়েকটি নতুন বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে এম আবদুল আলীম রচিত ‘ভাষা-আন্দোলন-কোষ’ (প্রথম খন্ড) এবং ড. এম আবদুল আলীম রচিত ‘ভাষা সংগ্রামী এম এ ওয়াদুদ’। নালন্দা প্রকাশ করেছে সোহেল মল্লিক সম্পাদিত গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলনের নির্বাচিত ৫০ কিশোর গল্প’। আফসার ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে সাঈফ আবেদীনের ‘শিশু-কিশোরদের একুশের গল্প’। অন্বেষা প্রকাশ থেকে বেরিয়েছে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন স্মারকভূমির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বই ‘একুশের স্মৃতি’। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে বিশ^জিৎ ঘোষ রচিত ‘ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা’ গ্রন্থটি। এছাড়া বৃহস্পতিবার গ্রন্থমেলায় মোহাম্মদ হাননান রচিত ‘শতাব্দীর বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। উপস্থিত ছিলেন আগামীর প্রকাশক ওসমান গনি। হুইল চেয়ার হস্তান্তর ॥ গ্রন্থমেলায় শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষের প্রবেশের সুবিধার্থে বেক্সিমকো ফার্মার পক্ষ থেকে ১৫টি হুইল চেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে। দুপুরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাছে বেক্সিমকো ফার্মার পক্ষে হুইল চেয়ারসমূহ হস্তান্তর করেন ডাঃ মোহাইমিনুল ইসলাম কৌশিক। নতুন বইয়ের খবর ॥ বৃহস্পতিবার বইমেলায় নতুন বই প্রকাশ হয়েছে ১৪৩টি। এর মধ্যে কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে মুস্তাফিজ শফির কিশোর উপন্যাস ‘মাথাকাটা ভূতবাহিনী’। পুথিনিলয় থেকে বেরিয়েছে ইমদাদুল হক মিলনের শিশুতোষ বই ‘বাবান ও তার কুকুরছানা’। অনন্যা এনেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘উপন্যাস সমগ্র’ ও ফরিদুর রেজা সাগরের প্রবন্ধ ‘মানুষের মুখ-১০’। বাংলা প্রকাশ এনেছে সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ‘একাত্তরের গল্প’। মিজান পাবলিশার্স এনেছে আনিসুল হকের গোয়েন্দা গল্পের বই ‘চার কিশোর গোয়েন্দা’। মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আবুল কাসেম রচিত বঙ্গবন্ধু ও চা শিল্প শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দীপংকর মোহান্ত। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মেসবাহ কামাল ও মোকারম হোসেন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। আলোচকবৃন্দ বলেন, চা শিল্প ও বঙ্গবন্ধু গ্রন্থে শ্রমিকদের সঙ্গে জাতীয় নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেই প্রেক্ষাপট বিশদভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি অবহেলিত চা জনগোষ্ঠীর প্রতি যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন- তা আজ জাতীয় ইতিহাসের গৌরবজনক অংশ। অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের চা শিল্পের বিকাশে এবং চা শ্রমিকদের জীবনমানোন্নয়নে তার অবদান কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়। এদিন ছড়াপাঠের আসরে ছড়াপাঠ করেন ছড়াকার আখতার হুসেন, ফারুক নওয়াজ, সুজন বড়ুয়া, খালেক বিন-জয়েনউদ্দিন, মাহমুদউল্লাহ ও সৈয়দ আল ফারুক। লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মাসুদুজ্জামান, রঞ্জনা বিশ্বাস, মাজুল হাসান ও মঈনুল হাসান। আজকের মেলা ॥ শুক্রবার শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলার দ্বার খুলবে সকাল ৮টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকবে শিশুপ্রহর। সকাল সাড়ে সাতটায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর। সভাপতিত্ব করবেন কবি রুবী রহমান। বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে অমর একুশে বক্তৃতা ২০২০। স্বাগত বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা করবেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

×