ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিববর্ষ ও প্রাণিত একুশ

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 মুজিববর্ষ ও প্রাণিত একুশ

এটি সর্বজনবিদিত যে, প্রায় তিন হাজার বছর বাংলা নামক এই জনপদের সুপ্রাচীন সমাজ ইতিহাস শোষণ-বঞ্চনার জ্ঞাপিত আবরণ। আর্য-দ্রাবিড়-রাঢ়-মৌর্য-তুর্কী-পাঠান-মুঘল-ইংরেজ-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন ভিনদেশী শাসক-শোষকের দ্রোণাক্রান্ত যন্ত্রণায় ক্ষুভিত জনগোষ্ঠীর নীরব ক্রন্দন এই অঞ্চলের মাটিকে করেছে অশ্রুউর্বর। নিস্পন্দ পর্যাবৃত্ত কালক্রমে বহির্মুখ ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন ও দেশভাগান্তর সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নিষ্পেষণে বাঙালী জাতি পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের নতুন অনিপ্সিত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ পরিখায় পরাশ্রিত। এর বিরুদ্ধে ত্বরিত প্রতিবাদ ছিল ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সংবিধান সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম বজ্রকঠিন প্রক্ষিপ্ত প্রস্তাব। আগামী প্রজন্মের হৃদয় গভীরে দীপ্র করার মানসে বিষয়সমূহের পুনরুল্লেখ অনিবার্যভাবে নিবন্ধ উপস্থাপনায় প্রতিফলিত। মহাকালের মহানায়ক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তৎকালে শুধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি পরিকীর্তনে বলা যায়, উপরোল্লিখিত বৈঠকে পূর্ব-পশ্চিম উভয় অংশের মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের প্রাক্কালে কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবি উত্থাপন করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস আয়োজিত সর্বদলীয় যুক্তসভায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রয়াত হওয়ার আগেই ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সফরে এসে ঢাকায় ঘোড় দৌড় মাঠে অনুষ্ঠিত সভায় ঘোষণা দিলেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। পরবর্তী নির্যাতন-নিপীড়নের প্রেক্ষিতে অহিংস এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক কৌশলের ধারাবাহিকতায় সূচিত হলো রক্তস্নাত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি- বাঙালীর মাতৃভাষার অধিকার অর্জনে পুণ্যাকাক্সক্ষা। বাঙালীর জাতীয়তাবাদের উম্মেষে দ্রোহ ও আলো প্রজ্বলনের বিজনন। প্রচিত হলো গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক ও শোষণমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং চূড়ান্তভাবে সংঘটিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকাখচিত বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন মাতৃভূমি। আমরা সম্যক অবগত আছি; বাংলার সৌন্দর্য, মাটি ও মানুষের উর্বর মেধা, ফসল উৎপাদনে দেশজ ধূম্রনীল কৌশল সুপ্রাচীনকাল থেকে সর্বত্রই ছিল সমাদৃত। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থায় উন্নত কৃষিপণ্যের অপার বাণিজ্যিক সম্ভবনাকে নির্ভার নিয়ন্ত্রণ ও লুম্পেন লুণ্ঠনের শক্তির কাছে পরাভূত ছিল বলেই প্রাগ্রসরতার বিপরীতে পশ্চাদপদ আর্থ-সামাজিক অনুন্নয়নের উন্নয়ন বিবর্ধন ইতিহাসের অধ্যায়ে হয়েছে নিন্দিত ও উপদ্রুত। সতেরো শতকের এই বাংলা সম্পর্কে ফরাসী ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস বার্ণিয়ার বলেছিলেন, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মনোরম ও সুফলা দেশ হিসেবে মিসরকে বর্ণিত করা হলেও বিষয়টি আসলে প্রাপ্য ছিল এই বাংলার। বিদেশী বণিকদের আকৃষ্ট করার মতো এত বিচিত্র ও মূল্যবান পণ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে এই বাংলার অবস্থান ছিল অতুলনীয়। বিশ্ব ইতিহাসে ১৭৫০ (শিল্প বিপ্লব), ১৭৭৬ (আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জন), ১৭৮৯ (ফরাসী বিপ্লব) সাল অতিশয় নিবন্ধিত। ভারতবর্ষে ১৯৪০, ১৯৪৭ এবং বাংলাদেশে ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সাল ছিল বিরোচন সমার্থক সংযোজন। একই সঙ্গে নান্দনিক সম্বোধায় অভিসিক্ত ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। নতুন এক অধ্যায় রচনায় পবিত্র অহংবোধে ভাস্বর পুরো বাঙালী জাতি। জন্মশতবার্ষিকী অবগাহনে ক্ষণ গণনার পরিক্রমায় একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন সামষ্টিক ব্যসন ও দ্যোতনাকে করেছে দীপ্তোজ্জ্বল। অধিকতর নিদ্রোত্থিত প্রাভাতিক আলোয় অত্যুজ্জ্বল প্রাণিত হয়েছে অমর একুশ। ‘মাথা নত না করা’র ব্রতবার্তায় প্রাণোৎসর্গের প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশে অহিংস রাজনীতির প্রবর্তক চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ভালবাসায় মুজিববর্ষ নিবেদনে একুশের চেতনাও প্রাতিভাসিক ঋদ্ধতায় পরিপূর্ণ। আমাদের জানা আছে যে, ভাষাবিহীন কোন প্রাণী সংস্কৃতির বলয় তৈরিতে উচ্চকিত নয়। বনেদি সকল সংস্কৃতির বন্দনা রচিত হয়েছে একমাত্র ভাষার কারণে। এটি মানুষের সংস্কৃতিবান হওয়ার প্রযোজ্য অনুষঙ্গও বটে। বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মতে, এ উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ উপমহাদেশে দ্বিতীয় নবজাগৃতির সূচনা করেছে। মধ্যযুগে বাংলাভাষার স্বমহিমায় মর্যাদাসীন করার তাগিদে কবি আব্দুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণি’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন, ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণি, সে সব কাহার জনম নির্ণয় ন জানি।’ এটি নিছক একটি ব্যঙ্গার্থক কথপোকথন বা কোন রচনার পঙ্ক্তি ছিল তা নয়, তা ছিল দুঃসহ অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালী জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের অবিনাশী প্রকাশ। ‘আমার ধ্যানের ভারত’ শীর্ষক রচনায় ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) বলেছেন- ‘মাতৃভাষাকে স্থানচ্যুত করার পদ্ধতিকে ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় বলে বর্ণনা করা যেতে পারে’। ভারতের নবযুগের প্রণেতা জাতীয় ভাবধারার সম্পূরণ প্রতীক ঈশ্বরের এক ও অদ্বিতীয় ধর্মমতে বিশ্বাসী পবিত্র ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক রাজা রামমোহন রায় তাঁর চিন্তন ও আদর্শিক বোধের অধিকাংশ প্রকাশ করেছিলেন ‘আত্মীয় সভা’ সংঘ, বাংলায় ‘ব্রাহ্মণ পত্রিকা’ এবং বিশেষ করে ইংরেজীতে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটে’। গান্ধীজী সম্ভবত সেজন্যই বলেছিলেন, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ আরও বড় সংস্কারক এবং প-িত হতে পারতেন যদি তারা তাদের চিন্তাধারাকে ইংরেজীতে চিন্তা বা প্রকাশ না করে তাদের মাতৃভাষায় তার প্রকাশ ঘটাতেন। অবশ্যই উল্লেখ্য, গুণী ব্যক্তিরা ইংরেজী সাহিত্যের সুসমৃদ্ধ রতœভা-ারের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন, কিন্তু নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে না হওয়াতে এ জ্ঞান অর্জন কতটুকু জনকল্যাণ বিবিক্ত, তার তাৎপর্য নিগূঢ় বিবেচ্য। নিজের মাতৃভাষায় জ্ঞানের সমৃদ্ধিকরণকে অবহেলা করে গান্ধী মনে করতেন, একদল অনুবাদকের সৃষ্টি করে কোন জাতি মহৎ কিছু অর্জন করতে পারে না। মাতৃভাষায় চিন্তা, মত প্রকাশ এবং সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান অর্জন, সৃজন ও বিতরণের বিবক্ষা চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মান বা বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশসমূহে উন্নয়নের সফল ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে জাতির জনকের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনের পটভূমিতে ভাষা অন্দোলনসহ সকল আন্দোলন সংগ্রাম ছিল মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সংগ্রাম ও অসহযোগ আন্দোলনের দীক্ষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সত্য-সুন্দর-কল্যাণপূজারী, গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক ভারত প্রতিষ্ঠার এই মহান সাধককে যথার্থ অর্থেই মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ‘সবকো সুমতি দে ভগবান’ (স্রষ্টা যেন সবাইকে সুমতি দান করেন) শান্তি-সম্প্রীতি-ভালবাসা-শ্রদ্ধা-বিনয়-সৌহার্দ্যরে মেলবন্ধনের এই অমিয় ধ্যানবার্তা যথাযথ প্রবৃত্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্ম-জীবন-বাঙালী মুক্তির সংগ্রামে। মানবতার জিগীষায় পরিশুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক পাঠশালা। মাঙ্গলিক প্রকর্ষে তা ছিল বিশ্বশীর্ষ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, ধ্যাণ-ধারণা, মূল্যবোধ, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদির অপরিসীম উন্নয়ন মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে এবং এর যথাযথ মর্যাদা এবং সর্বক্ষেত্রেই এর সামগ্রিক প্রচলন যতটুকু না প্রভাব বিস্তারের কথা ছিল, তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আমাদের এখনও আদালত আশ্রয় এবং নির্দেশনা নির্ভর হতে হয়। বাঙালী জাতির জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা কী হতে পারে! সংস্কৃতির বিশ্বায়নে অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির প্রবাহ উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রগতিমননে শুধু মনোরঞ্জন নয়, সংকল্প-সোপান সুদৃঢ় করে টেকসই জীবনমান উন্নীতকরণে প্রায়োগিক প্রণোদনার নিরন্তর প্রত্যাশায় জাতি উদ্দীপ্ত। তবে অবশ্যই স্মরণে উপমিত হওয়া বাঞ্ছনীয় যে কোন উদ্ভাবনী পন্থা যেন আমাদের ইতিমনস্তত্ত্ব নির্মাণে প্রতিবন্ধক না হতে পারে। বিশ্বের অবারিত উৎকর্ষ চিন্তাশক্তির আবিষ্কার কোনভাবেই রূদ্ধ বা নষ্ট-ভ্রষ্টদের দখলে যেন তাড়িত না হয়। মহাত্মা গান্ধীর প্রণিধানযোগ্য সত্যনিষ্ঠ কর্মসূত্র ‘আমি আমার ঘরটিকে চারদিকে প্রাচীর বেষ্টিত ও আমার জানালাগুলো বন্ধ রাখতে চাই না। আমি চাই সকল দেশের সংস্কৃতি আমার ঘরের চারপাশে যত ইচ্ছা স্বাধীনভাবে এসে ভিড় করুক। কিন্তু তার কোনটি আমাকে স্থানচ্যুত করবে সেটি আমি হতে দেব না’Ñ বাঙালী জীবনেও কর্মসিদ্ধির পাথেয় এবং বৈশ্বিক গ্রামের এই মানচিত্রে বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন চিরপ্রকর্ষিত হোকÑ নান্দনিক মুজিববর্ষে এটি হোক আমাদের নিরন্তর প্রত্যাশা। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×