রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর পরিবেশ কেমন হওয়া চাই? এককথায় বিশে^র উন্নত শহরের আদলে পরিবেশসম্মত মডেল সিটির প্রত্যাশা সবার। যখন প্রায় প্রতিদিনই গোটা বিশে^র দূষিত শহরের প্রথম অবস্থানে ঐতিহ্যবাহী এই শহরের নাম- ঠিক তখন ভবিষ্যতের সবুজ শহরের প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। নগরীকে ঘিরে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে বলাই চলে সামনের দিনগুলোতে একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন শহরের হয়তো দেখা মিলবে। তবে এজন্য কত সময় অপেক্ষা করতে হবে এ বিষয়ে নির্ধারিত কোন বার্তা নেই। প্রশ্ন হলো দূষণের তালিকায় সেরা থাকা এই শহর এখন কেমন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও এখনও নগরজুড়ে দৃষ্টিকটু কারবারের শেষ নেই। হ্যাঁ। সত্যিই তাই। একেবারেই দৃষ্টিকটু। অস্বস্তি ও মহাবিব্রতকর। আচ্ছা ভাবুন তো একটি শহরের উড়াল সড়ক মানেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর রক্ষণাবেক্ষণ বা সুন্দর রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন যেমন এড়াতে পারে না তেমনি নাগরিক দায়িত্বও আছে। যদি উড়াল সড়কের পিলার আড়াল করে মলমূত্র ত্যাগ করার কাজে লাগানো হয় তবে বিষয়টি কেমন দাঁড়ায়। সত্যি তাই হচ্ছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। হরহামেশাই এমন চিত্র নগরীর ফ্লাইওভারগুলোর নিচের অংশে। কান্ডজ্ঞানহীন এমন কায় কারবারে সচেতন নগরীর মানুষ তো বটেই বিদেশীদের কাছে বিষয়টি কতটা দৃষ্টিকটু হতে পারে। ভাবুন তো? অথচ একটু সতর্ক হলেই এরকম দৃশ্য দেখানো থেকে বিরত থাকা সম্ভব।
গোটা রাজধানী ঘুরলে হাতেগোনা কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাদবাকি সব সড়ক-ফুটপাথে মলমূত্রের ছড়াছড়ি। খোলা রাস্তাকে পাবলিক টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংসদ ভবন, উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ, রেলস্টেশন, উদ্যান, বিমানবন্দর এলাকা, বাস টার্মিনালসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের কারণে। যা সরাসরি নগরীর সার্বিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সংক্রমিত হচ্ছে রোগবালাই।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগের কারণে পরিবেশ দূষণ হয়। পাশাপাশি পানি ও ধুলোর সঙ্গে মলমূত্র মিশে মানবদেহে নানা ধরনের রোগ হয়ে থাকে। তবে ঢাকায় পাঁচটি রোগের অন্যতম কারণ মানব বর্জ্য। এ কারণে সারা বছরেই এসব রোগে আক্রান্তের সংখ্যায় কমতি নেই। তাই স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে যেখানে সেখানে মানব বর্জ্য ত্যাগ করা বন্ধ করার পরামর্শ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো, দেড় কোটির বেশি মানুষের এই শহরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টয়লেট নেই। যা একজন নাগরিকের পথচলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা। অথচ উন্নত শহরগুলোতে রাস্তায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্থায়ী এমনকি মোবাইল টয়লেট রাখা হয়। ভাসমান মানুষদের জন্য বিনামূল্যে টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে। রাজধানী শহরে এরকম সুবিধা পর্যাপ্ত না হওয়ায় মানব বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও সাধারণ মানুষ টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পান না। তাই খেয়াল খুশিমতো বর্জ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হাইকোর্ট-সুপ্রীমকোর্ট। অথচ এই স্থাপনার চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধ। ভাসমান মানুষের বসবাস- ফুটপাথ আর দেয়াল ঘেঁষে এমনকি মাজারের মাঠজুড়ে। ফুটপাথে মলমূত্র থাকলেও পরিষ্কারের কোন বালাই নেই। হাইকোর্টের মাজার থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত এই স্থাপনার ফুটপাথজুড়ে অবাধে মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায়। শিক্ষা ভবনের গেট সংলগ্ন ফুটপাথ দিয়ে চলা একেবারেই দায়। অথচ সিরডাপ মিলনায়তনের প্রবেশমুখে একটি ভ্রাম্যমাণ টয়লেট থাকলেও এটি পরিচালনার দায়িত্ব কার কেউ জানে না। এখানে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি।
একই চিত্র প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের ফুটপাথ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এলাকা, বুয়েটের কিছু রাস্তা, ঢাকেশ্বরী এলাকাতেও এমন দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের চারপাশ মলমূত্রে ভরা। যদিও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিসব উপলক্ষে এই এলাকাটি এখন নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। শহীদ মিনারে ঘুরতে আসা পর্যটকদের দাবি ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি দেখতে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসেন। তাই ভ্রাম্যমাণ টয়লেট দেয়া জরুরী। ঢাকা মেডিক্যালের বিপরীতে ফুটপাথের চিত্রও সুখকর নয়।
বাংলামোটর থেকে হেঁটে মৌচাক কিংবা শাজাহানপুর যাবেন। বেশি গেলে খিলগাঁও পর্যন্ত। পথচলা শুরুর পর আপনার ধারণা একেবারেই পাল্টে যাবে। বিব্রত হওয়ার পাশাপাশি মানুষের কাজকর্ম দেখে চোখ কপালে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইস্কাটন থেকে উড়াল সড়কের পিলারের নিচ থেকে বাতাসের সঙ্গে দুর্গন্ধ নাকে লাগবে। যত পথ এগুবে তত দুর্গন্ধ বাড়বে। পিলার আড়াল করে মূত্র ত্যাগ, রাস্তা গড়িয়ে যাচ্ছে! এটা হয় না। কিন্তু হচ্ছে তো। মৌচাক, মালিবাগ, খিলগাঁও, শাজাহানপুর যেখানেই যাবেন বিশুদ্ধ বাতাস নেয়া সম্ভব নয়।
রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মতিঝিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ও সামনের কিছু অংশে, সেনা কল্যাণ ভবনের দেয়ালের একপাশেও প্রকাশ্যে ভাসমান মানুষদের মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা গেছে। ফকিরাপুল পানির ট্যাংকি এলাকা, কমলাপুর, টিটিপাড়া, পীরজঙ্গী মাজারেও এ চিত্র। দেখলে মনে হবে এই স্থাপনার দেয়ালগুলো হয়তো এ কারণেই নির্মাণ হয়েছে!
টিটিপাড়া মোড় থেকে একদিকে শাজাহানপুর-খিলগাঁও চৌরাস্তাসহ সব মিলিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনের সীমানা। স্টেশনের ভেতরে ও বাইরের চিত্র প্রায় সমান। এই এলাকায় কয়েক কিলোমিটারের বাতাস স্বাভাবিক নয়। মলমূত্রের গন্ধে বাতাস সব সময় ভাড়ি থাকে। স্টেশনের ভেতরে আছে ভাসমান দুই শতাধিকের বেশি মানুষের উপদ্রব। যারা রাত দিন স্টেশনেই থাকে। এতের মধ্যে একটি অংশ থাকে প্লাটফর্মের ছাদে। অপর অংশটি থাকে নিচে শহরতলী প্লাটফর্ম ও আন্তঃজেলা প্লাটফর্মে। রাত ১০টার পর স্টেশনে গেলে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের কারণে হাঁটার জায়গা পাওয়া যাবে না। তবে স্টেশনে দুটি শৌচাগার থাকলেও ভাসমান মানুষ তা কমই ব্যবহার করে। খোলা জায়গাতে সারে প্রকৃতির কাজ। স্টেশনের ভেতর দিয়ে ফুটওভারব্রিজে ওঠার রাস্তাটি দিয়ে মূত্রের গন্ধে একেবারেই চলা দায়।
মহাখালী বাস টার্মিনালের ভেতরে একটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও তা বোঝার কোন উপায় নেই, আশপাশের রাস্তা ও টার্মিনালের ভেতরের পরিবেশ দেখে। টার্মিনালের বাইরে দেয়ালজুড়ে মলমূত্রের কারখানা। মানববর্জ্য গড়িয়ে রাস্তা পর্যন্ত আসছে। তাই অনেকে এখন আর ফুটপাথ ব্যবহার করেন না। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার অনেক সড়কে এমন চিত্র দেখা গেছে। ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার এলাকাতেও ভাসমান মানুষ আর অসচেতন পথচারীদের কারণে আছে বায়ুদূষণ। ফার্মগেট এলাকার পার্কসহ আশপাশের রাস্তাজুড়ে রাত দিন চলছে মলমূত্র ত্যাগ। খোদ সংসদ ভবনের খেজুরবাগান এলাকা যেন মল আর মূত্রের কেন্দ্রস্থল। রমনা পার্কের চারপাশের দেয়ালজুড়ে পথচারী ও ভাসমান মানুষের মলমূত্র ত্যাগের দৃশ্য চোখে না পড়ার কারণ নেই। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে মানববর্জ্য গন্ধে অস্থির পরিবেশ। তেমনি চন্দ্রিমা উদ্যানও।
আমিনবাজার থেকে টেকনিক্যাল সড়ক পর্যন্ত ফুটপাথজুড়ে প্রায় সব সময় মানুষের লাইন। তাদের কাজ একটাই যখনই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় তখনি দেয়াল আড়াল করে প্রস্রাব করতে দেখা যায়। এ কাজটি বেশিরভাগ করে থাকেন মোটরযান শ্রমিকরাই। টেকনিক্যাল মোডের বিপরীতের সড়কটির ফুটপাথের অবস্থা একই রকমের।
বলদা গার্ডেন, শাহবাগ, ফুলার রোড, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সীমানা প্রাচীর, এফ রহমান হলের পূর্ব পাশের দেয়াল, যাত্রাবাড়ী, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচ, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর ও পুরান ঢাকাসহ অনেক এলাকায় রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা ও ফুটপাথে মূত্র ত্যাগ নিত্যদিনের চিত্র। হাতিরঝিল লেকের বিভিন্ন অংশে অবাধে প্র¯্রাব করতে দেখা যায় সাধারণ মানুষসহ পর্যটকদের।
দুই সিটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যানুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২৮টি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩৭টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে নিয়োজিতরা বলছেন, নতুন পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হচ্ছে। পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা বাড়লে ফুটপাথে মলমূত্র ত্যাগের চিত্র কমে আসবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও হেলথ এন্ড হোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, মলমূত্রের মতো মানববর্জ্য হলো রোগ জীবাণুর আধার। খোলা বর্জ্য শুকিয়ে ধুলো অথবা খাবারের সঙ্গে কিংবা পানিতে মিশে মানবদেহে প্রবেশ করে। এতে টাইফয়েড, জন্ডিস, আমাশয়, ডায়রিয়া ও ক্রিমি রোগ হতে পারে। রাজধানীতে এসব রোডের প্রধান কারণ খোলা মানববর্জ্য। তিনি বলেন, খোলা মানববর্জ্যরে কারণে এসব রোগ রাজধানীর মানুষের সারা বছর লেগে থাকে। মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ প্রক্রিয়ায় না হওয়ায় দিন দিন সমস্যা বাড়ছে। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও। তাই পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সব রকমের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেখানে সেখানে বর্জ্য ত্যাগ করা যাবে না।
রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটার জায়গায় এসপিএম মিশে ২০০ মাইক্রোগ্রাম। এটা জাতীয় মানদন্ডের চেয়ে দ্বিগুণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। অপরদিকে বাংলাদেশ এ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে ২৪ ঘণ্টায় ১০০ কেজি সিসা, তিন হাজার ৫০০ কেজি এসপিএম, এক হাজার ৫০০ কেজি সালফার-ডাই অক্সাইড, ১৪ টন হাইড্রোজেন কোরাইড ও ৬০ টন কার্বন মনোক্সাইড মিশে। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানব স্বাস্থ্যের ভয়াবহ ক্ষতি করে যাচ্ছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ ঢাকার বাতাসে মিশছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি, কলকারখানা, ইটভাঁটিতে ইট পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং হাসপাতালের অনিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। এমনকি ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাচ্ছে অনিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের কারণেও।
বায়ুসহ পরিবেশদূষণের অন্যান্য কারণে রাজধানীসহ বাংলাদেশের মানুষ নানা ধরনের রোগে ভুগছে। এর মধ্যে কার্ডিওভাস্কুলার (হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি) রোগ, এ্যাজমা (হাঁপানি), বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া এবং আইকিউ হ্রাস পাওয়ার মতো নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগছে। মলমূত্র ও সার থেকে বায়ুবাহী ক্ষতিকর কণা তৈরি হচ্ছে এবং তা ফুসফুসে গিয়ে ক্ষতি করছে।
দায় ও দায়িত্ব
দৃষ্টিকটু সব কাজকাম, নগরজুড়ে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: