ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রন্থমেলার নির্বাচিত বই

নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে- ধ্রুপদী জীবনের আখ্যান

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে- ধ্রুপদী  জীবনের আখ্যান

মোরসালিন মিজান ॥ নভেরাকে নিয়ে মস্তবড় বই। ধ্রুপদী প্রকাশনা। হাতে নিয়ে শুধু ছুঁয়ে দেখতেও ভাললাগে। আর ভেতরে? আধুনিক ভাস্কর্য চর্চার প্রতিকৃৎ শিল্পীকে আবিষ্কারের জোরালো চেষ্টা। খুব কাছে থেকে দেখার বিরল স্মৃতি। আন্তরিকভাবে মেশার গল্প। তবে শুধু গল্প বা স্মৃতিকথা নয়, নভেরাকে ঘিরে যত রহস্য, তার জট খোলার সচেতন প্রয়াস। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত এ বইয়ের শিরোনাম ‘নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে।’ লেখক আনা ইসলাম। নিজের কালের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে আগেও বই লেখা হয়েছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে শিল্পীকে। তবে আনা ইসলাম সরাসরি নভেরার সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। দেড় দু’ মাস বা এক বছরের সম্পর্ক নয়, লম্বা সময় ধরে এ যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। দুজনের মধ্যকার প্রতিদিনের সম্পর্ক, নৈকট্য বইটির মূল বৈশিষ্ট্য গড়ে দিয়েছে। এখানেই অন্য বই থেকে ব্যতিক্রম। পাশাপাশি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে। বইটিকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে শত চেষ্টা সহজেই অনুমান করা যায়। শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, প্রদর্শনীর ক্যাটালগ ইত্যাদিও যুক্ত করা হয়েছে বইতে। নভেরার আলোকচিত্রের শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ হয়ে ওঠেছে এ গ্রন্থ। আনা ইসলামের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। দেশে নভেরা যখন চির রহস্যের নাম, কৌতূহলের কেন্দ্রে, তখন প্যারিসে তার ছায়ায় মায়ায় নিজেকে চমৎকার জড়িয়ে নিয়েছিলেন আনা। ১৯৮৬ সাল থেকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাস করছেন তিনি। দেশেও নিয়মিত আসা যাওয়া। এর ফলেই হয়তো তিনি জানতেন, নভেরার প্রতি এ দেশের মানুষের ভালবাসা অগাধ। ভাস্করের কাজ এবং প্রতিদিনের জীবন সম্পর্কে জানার কৌতূহল বাড়ছে বৈ কমছে না। বই পাঠে জানা যাচ্ছে, অভিন্ন বোধ থেকে নব্বইয়ের দশকে নোভেরাকে খুঁজে বের করেন লেখিকা। ক্রমে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ পর্যায়ে জানিয়ে রাখা প্রাসঙ্গিক হবে যে, আনা ইসলাম দেশের বরেণ্য শিল্পী শাহাবুদ্দিনের সহধর্মিণী। দুই শিল্পী পরিবারের মধ্যে সহজেই বন্ধুতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের লেখক শিল্পী সাহিত্যিকরাও এ সম্পর্কের কথা বহুদিন ধরে জেনে এসেছেন। তবে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত বইটি আরও বিস্তৃত পরিসরে জানার দুর্লভ সুযোগ করে দিয়েছে। সম্পর্কের সুযোগে নভেরাকে আবিষ্কারের, তুলে ধরার আন্তরিক চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় বইতে। অজানা, অল্প জানা, ভুল জানা থেকে মুক্তি দেয়ার তাগিদ চোখে পড়ে। বই পাঠে কিংবদন্তি শিল্পীর প্রবাসজীবন, পরিবার, পরিভ্রমণ ও শিল্পচর্চার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়। তেমনই ফ্ল্যাশব্যাকে উঠে আসে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বইয়ের সূচনায় নভেরার সঙ্গে লেখিকার যোগাযোগ স্থাপনের তীব্র আকাক্সক্ষার কথা জানা যায়। ক্রমে সম্পর্কটি গভীর থেকে গভীরতর হয়। সম্পর্কের এ গভীরতা বই রচনার রসদ যুগিয়েছে। প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে, প্রবাস জীবনে এত লম্বা সময় কী নিয়ে ছিলেন নভেরা? কোন পরিবেশে কাদের সঙ্গে কাটিয়েছেন? বইয়ের আলোচনা তথ্য প্রমাণ বলছে, নিজের সৃষ্টির জগতেই বুঁদ হয়ে ছিলেন শিল্পী। ভাস্কর্য গড়ার কাজে বিশেষ মগ্ন ছিলেন। কংক্রিটে নয় শুধু, বিচিত্র মাধ্যমে নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। অপেক্ষাকৃত নতুন তথ্য : নভেরা ছবিও এঁকেছেন দেদার। তার শিল্পকর্ম নিয়ে বিদেশে একক প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়েছে। স্বামী গ্রেগোয়ার কথাও জানা যাচ্ছে বই থেকে। এ মানুষটি প্রিয়তমা স্ত্রী নভেরাকে সারাজীবন বড় ভালবেসে আগলে রেখেছিলেন। শিল্পের ঘরবাড়ি দুজনে মিলে সুন্দর সাজিয়ে নিয়েছিলেন তারা! লিখে দুর্লভ ছবি প্রকাশ করে এ সংক্রান্ত কৌতূহলের কিছুটা হলেও দূর করেছেন আনা ইসলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয়কে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বইতে। এই যেমন, নভেরার দেশে ফেরা না ফেরার গল্পটি কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে বর্ণনা করেছেন লেখিকা। গল্পটি করতে গিয়ে তিনি যে সত্য সামনে আনেন তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। বইটি পাঠে জানা যাচ্ছে, যে নভেরাকে নিয়ে দেশের মানুষের এত কৌতূহল, এত প্রেম, সেই নভেরা তার সামান্যই আশা করেছিলেন। নভেরা আহমেদকে অভিমানী হিসেবেও জানেন অনেকে। অজানা অভিমান নিয়ে তিনি দেশ ছেড়েছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে। বইয়ে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা না হলেও, কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লেখিকা উল্লেখ করেন, ১৯৯৭ সালে নভেরাকে একুশে পদকে সম্মানিত করে রাষ্ট্র। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সে পদক গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। তবে হৃদয়ে বাংলাদেশকেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নভেরা। সে কথা জানিয়ে আনা ইসলাম লিখেছেন, ‘ইচ্ছে করেই আবার গাইলাম, মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে/সেদিন ভরা সাঁঝে...। নভেরা সহ্য করতে পারছিলেন না। গানের কথার অন্তর্নিহিত ভাবের বেদনায় ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন।’ দেশ নিয়ে এত আবেগ সত্ত্বেও দেশে ফেরা হয়নি শিল্পীর। দেশের সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল তা এতকাল পর গোছানো যাবে কিনা, মনে হয়েছে, তিনি সন্দিহান ছিলেন এ ব্যাপারে। হয়ত তাই লেখিকাকে ভাস্কর বলেছিলেন, দেশে আমার তো কেউ নেই। কার কাছে যাব? দেশে এলে হোটেলে ওঠার ইচ্ছের কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি বোঝা যায়, কাউকে বিরক্ত না করে, হৈ হুল্লোড় এড়িয়ে নিজের মতো করে নিভৃতে কাটাতেই পছন্দ করতেন তিনি। দেশেও সেভাবেই আসতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নভেরার সাক্ষাতের বিষয়টিও বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী প্রধানমন্ত্রীর নিজের আগ্রহেই ভাস্করকে খুঁজে নিয়েছিলেন। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আলাপে ভাস্কর প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, দেশে ফিরে একাত্তরে নির্যাতিত নিহত মায়েদের বোনেদের বেদনার ইতিহাস তুলে ধরতে বিশাল ভাস্কর্য গড়তে চান তিনি। শহীদ মিনারের সামনে হুইল চেয়ারে বসে ছবি আঁকার ইচ্ছার কথাও জানিয়েছিলেন। নভেরাকে দেশে ফেরানোর কিছু চেষ্টার কথাও বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শিল্পী শাহাবুদ্দিন নভেরাকে দেশে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণপত্রও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে শরীর ভেঙ্গে গেছে, অসুস্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে ব্যর্থ হন নভেরা। তবে বই পাঠে ধারণা করা যায়, বয়সজনিত জটিলতা ছাড়া নভেরার বিশেষ কোন জটিল ব্যাধি ছিল না। বয়সের ভার বহন করা ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছিল। নভেরার শেষ জীবনের একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা। লিখেছেন, ‘পাখির মতো ছোট্ট শরীর, অবসন্ন, নিস্তেজ। কখনো ইশারায়, কখনো ঠোঁট নেড়ে জানান অসুবিধার কথা।’ বইয়ে নভেরার চির বিদায়ের মুহূর্তটি গভীর আবেগের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। নীরবে বিদেশের মাটিতেই দেহত্যাগ করেছিলেন নভেরা। রাতে ঘুমের মধ্যেই চিরবিদায় নেন তিনি। লেখিকার বর্ণনাটি এরকম: ‘শোবার ঘরে দুটো সিঙ্গেল খাট দুপাশে। একটিতে নভেরার চাদরে ঢাকা দেহ। মুখটি অনাবৃত। দেখে মনে হলো প্রশান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। গভীর নিদ্রামগ্ন।’ অন্য অংশে তিনি লিখেছেন, ‘ভোরের শিশিরের মতো চলে গেলেন। পরিচিত ঘরে তার চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ব্যবহৃত জিনিস। বিশাল কাঁচের জানালর পাশে ইজিচেয়ার, অজ¯্র ওষুধপত্র, আলমারিতে কাপড়জামাÑ নভেরার স্মৃতি হয়ে ঘুরে ঘুরে কথা বলছে।’ শিল্পীরা একটু এলোমেলা স্বভাবের হন। অগোছালো জীবনযাপন। নভেরার বেলায় তেমনটি ঘটেনি। পুরনো ছবিতে হাল্কা সাজে রূপবতী নারী হিসেবে দেখা গেছে তাকে। লেখিকাও অভিন্ন তথ্য দিয়ে লিখেছেন, ‘সাজতে খুব ভালবাসতেন। খুব কড়া প্রসাধন নয়। হাল্কা ¯িœগ্ধ ছিল তার প্রসাধনের প্রলেপ। সব সময় পরিপাটি। এমনকি শরীর যখন খারাপ তখনো আমরা দেখতে যাব শুনে রেবতীকে (গৃহকর্মী) বলেছেন, মুখটা সুন্দর করে দিতে। ভ্রুতে পেনসিল এঁকে দিতে।’ আনা লিখেছেন, ‘আমাদের শ্রদ্ধা জানানো শেষ হলে বন্ধ করা হবে কফিনের ঢাকনা। রেবতী আই ভ্রু পেনসিল দিয়ে তাঁর ভ্রু দুটো আঁকেন। হঠাৎ মনে হলো, টিপ পরতে ভালবাসতেন যিনি, তাঁকে টিপ দিয়ে দিই।...গ্রেগোয়ার বললেন, গোল টিপ পরাতে। চিরনিদ্রামগ্ন উজ্জ্বল কমলা-কালো ছাপা জামা পরা ভাস্করের ঠা-া কপালে কালো গোল টিপ এঁকে দিই।’ বই থেকে জানা যায়, শেষ যাত্রায় তার সঙ্গী হয়েছিল বাগানের উজ্জ্বল হলুদ গোলাপ, একই দিন মারা যাওয়া প্রিয় পাখি। বুকের ওপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর একটি ক্যাটালগও দেয়া হয়েছিল। শহীদ মিনারের শিল্পী হিসেবে নভেরার স্বীকৃতিও চাওয়া হয়েছে বইতে। পুরনো আলোচনা বিতর্ক সামনে এনে লেখিকার মন্তব্যÑ ‘শহীদ মিনার তারই সৃষ্টি।’ বইয়ে দ্বিতীয় অংশে আছে নভেরার দুর্লভ সব আলোকচিত্র। বাংলাদেশের শিল্পপ্রেমীরা মহান ভাস্করকে ছবিতেই দেখে আসছেন এতকাল। হাতেগোনা কয়েকটি ছবি প্রায় সবার মনে গেঁথে আছে। নভেরা নামটি শোনামাত্রই চোখের সামনে ছবিগুলো ভেসে ওঠে। কিন্তু এ বই অদেখা ছবির বিশাল এবং যারপরনাই সমৃদ্ধ এ্যালবাম। এত এত ছবি, দুর্লভ মুহূর্ত প্রথমবারের মতো সামনে এলো। বইতে নভেরার গড়া ভাস্কর্যের ছবি আছে। প্যারিসে অবস্থান কালে ভাস্কর্য নিয়ে কী ধরনের কাজ করেছেন তিনি, ছবি দেখে অনুমান করা যায়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শিল্পছোঁয়া স্পষ্ট। প্যারিসে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীর ক্যাটালগ বইতে যুক্ত করা হয়েছে। আছে বেশি কিছু চিত্রকর্ম। ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার একক প্রর্শনী। সেই প্রদর্শনীর পুরো ক্যাটালগ বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে। শিল্পীর কাজ দেখে তার সে সময়ের শিল্পভাবনা, চিন্তার বৈশিষ্ট্য জানা যায়। ষাটের দশকের ছবি দেখে মনে হয়, নভেরা নিজেই প্রকৃতির অনন্য সুন্দর এক শিল্পকর্ম। অসম্ভব রূপবতী, সুতীক্ষম্ন দৃষ্টি। বার্ধক্য তাকে ছুঁয়ে দিতে থাকে ২০০০ সালের পর। ভাস্কর হিসেবে পরিচিত হলেও, প্রচুর ছবি এঁকেছেন। সেসব ছবি এ বইতেই হয়ত প্রথম প্রকাশিত হলো। ১৯৭৩ সালের একটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি লাল-সবুজের পতাকা আঁকছেন। কিছু ছবি আবার অসমাপ্ত। কিন্তু হায় জীবন ফুরিয়ে গেছে! নভেরা আর নেই। সেই শোককে জাগিয়ে দেয় ‘নভেরা বিভুঁইয়ে স্বভূমে।’ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান ও অন্যপ্রকাশ। ৩১২ পৃষ্ঠার বই। মূল্য ১৫০০ টাকা।
×