ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কটে গার্মেন্টস ॥ করোনার বিরূপ প্রভাব

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সঙ্কটে গার্মেন্টস ॥ করোনার বিরূপ  প্রভাব

রহিম শেখ ॥ নানা রকম নিত্যপণ্যসহ তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য চীনের প্রতি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। করোনাভাইরাসে চীনের ‘একঘরে’ হয়ে পড়া নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। এ দেশের তৈরি পোশাক খাতে যে কাঁচামাল আসে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করা। নিটওয়্যার খাতেও প্রায় ১৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। কাপড়, পলি, জিপার, কার্টন, লেস, হ্যাঙ্গার, বোতাম; রং ও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং আরও অনেক এক্সেসরিজই আমদানি করা হয় চীন থেকে। করোনার কারণে বর্তমান অচলাবস্থার ফলে কারখানাগুলো চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে চীন থেকে যে সব কাঁচামাল আমদানি হতো, সেগুলোর দাম দেশের বাজারে ইতোমধ্যেই ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চীন থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের রফতানি খাতেও নেমে আসছে বিপর্যয়। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এই সঙ্কটে আর্থিক ক্ষতি কত হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। শীঘ্রই ‘করোনা’র প্রভাব স্বাভাবিক হয়ে না আসলে বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর সর্বাধিক নির্ভরশীল বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে শুধু চীন থেকেই আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকার পণ্য। অর্থাৎ মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি হয়েছে চীন থেকে। দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ এবং রফতানি কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। চীনের এ সঙ্কটের কারণে আমদানি-রফতানি আরও কমবে। এতে দেশের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দেবে। চীন থেকে মূলত পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, সরকারী প্রকল্পের সরঞ্জামাদি, আদা-রসুন, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য আসে চীন থেকে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল ফেব্রিকস, রাসায়নিক পদার্থ, কারখানার যন্ত্রপাতির প্রধান উৎস চীন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে অনেকটাই ‘একঘরে’ হয়ে পড়েছে চীন। যার প্রভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। জানা যায়, চীনা নববর্ষ উপলক্ষে ছুটি শেষে ২ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে কলকারখানা ফের চালুর কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ছুটি আরও ১০ দিন বাড়ানো হয়। চীন সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত কলকারখানা ও অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। এ ছুটি আরও বাড়বে কিনা, তা নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্পর্শকাতর এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই বন্ধ থাকবে চীনের সব প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানা। বাংলাদেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোয় সর্বোচ্চ এক মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। আর বড় কারখানাগুলোয় বড় জোর দুই থেকে আড়াই মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি বন্ধ থাকলেও এতদিন ধরে উৎপাদন চলায় অনেক কারখানারই মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে এলসি খুললেও চীন থেকে সময় মতো কাঁচামাল পাচ্ছেন না তৈরি পোশাক মালিকরা। এতে ইউরোপ-আমেরিকার অর্ডার হাতছাড়া হওয়ার পাশাপাশি কারখানা বন্ধ হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। চীনের কাঁচামাল ব্যবহারকারী ওভেন পোশাক কারখানার উদ্যোক্তা অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, কাঁচামাল আনার এলসি দেয়া আছে, কিন্তু পণ্য আসছে না। আমদানি বন্ধ। তার কারখানার জন্য ৩০ জানুয়ারি পণ্য আসার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে পণ্য আর আসেনি। সাদমা ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক মোঃ নাসির উদ্দিন বলেন, প্রত্যেক মাসেই বিশেষ করে মাসের শেষ সপ্তাহে চীন থেকে পণ্য আসে। জানুয়ারির শেষ দিকেও আসার কথা ছিল, আসেনি। আর চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও আসার সম্ভাবনা দেখছি না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। বড় কারখারখানাগুলোও বেশি দিন টিকতে পারবে না। এদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ এ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, দেশীয় বাজারে কাঁচামালের দাম ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে। সবাই উদ্বিগ্ন। ওভেন পোশাকের ২০-৩০ শতাংশ দেশীয় বাজারে উৎপাদন হয়, ৭০-৮০ শতাংশই চীন থেকে আসে। এ বিশাল পরিমাণ কাঁচামাল আপাতত বাংলাদেশে উৎপাদন করা সম্ভব না। এ ছাড়া চীনের পণ্যের দাম দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দামের চেয়ে অনেক কম পড়ে। তিনি বলেন, চীনা নববর্ষের আগে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল দেশটি থেকে পণ্য আমদানির, সেগুলোর বিপরীতে অনেক পণ্য আসেনি। যেসব পণ্য এসেছে, তা বন্দরে আটকা পড়ে আছে। চীনের কোম্পানিগুলো ছুটির পর ডকুমেন্ট পাঠানোর কথা। কিন্তু অফিস বন্ধ থাকায় ডকুমেন্টস পাঠাতে পারছে না। ফলে বন্দরে ডকুমেন্ট দেখাতে না পারায় পণ্য খালাস হচ্ছে না। ব্যাংকেও ডকুমেন্টস জমা দিতে পারছে না। পাশাপাশি এলসি খোলার আগে যে প্রাথমিক নথিপত্র দিতে হয়, তাও চীনে পাঠানো যাচ্ছে না। মোটকথা, পুরো চেইনটাই ভেঙ্গে পড়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক জনকণ্ঠকে জানান, চীনের কারোনাভাইরাস আতঙ্কে বাংলাদেশের পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওভেন পোশাকের কাঁচামালের বড় একটি অংশ আমদানি হয় চীন থেকে। বর্তমানে চীনের শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় কাঁচামাল আসতে পারছে না। সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘খাতটি চরম সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। একদিকে ব্রেক্সিট ইস্যু, ডলারের দাম সমন্বয় না করা, বিশ্ববাজারে চাহিদা কমায় পণ্যের দাম কমে যাওয়া, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে রীতিমতো সারভাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস ইস্যু।’ তিনি জানান, ওভেন কাপড়ের ৩০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। বেশির ভাগই আসে চীন থেকে। ডেনিমেরও একটি অংশ আসে চীন থেকে। স্যুয়েটারের আসে ৬০ শতাংশ। ইনটিমেট প্রডাক্টের ৭০ শতাংশ আসে চীন থেকে। এসব পণ্যের কাঁচামালের একটি বড় নির্ভরতা চীন। এখন দেশটিতে করোনার প্রভাবে কারখানায় ছুটি চলছে। এতে যাদের পণ্য আসার কথা ছিল, তা ঝুলে গেল। এতে ক্রেতাদের অর্ডার শিপমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি অর্ডার বাতিলও হতে পারে। অন্যত্র চলে যেতে পারে অর্ডার। কারণ ক্রেতা তো তার শেলফ খালি রাখবে না। আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এমনিতেই তিন মাসের কম সময়ে পণ্য রফতানি করতে পারি না। এর মধ্যে কয়েকদিন পর যখন পণ্য আসবে, তা যদি দুই দিনের মধ্যে খালাস না করা যায় তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। তার মানে আমাদের এখন টাইম ম্যানেজমেন্ট করা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। বলতে পারেন পোশাক খাত এখন সবচেয়ে ভালনেরেবল অবস্থায় আছে।’ এদিকে চীন থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের রফতানি খাতেও নেমে আসছে বিপর্যয়। অচিরেই বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন রফতানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পুরো রফতানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি। তিনি বলেন, পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের পণ্য আমদানি বন্ধ। এ কারণে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। সময় মতো ক্রেতাদের চাহিদা তো পণ্য রফতানি করা যাবে না। রফতানিও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের বাজারে ডায়িং-প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার্য কাঁচামাল যেমন- রং, রাসায়নিক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তবে এমন পরিস্থিতিতেও কিছু আশার দিকও দেখছেন মোহাম্মদ হাতেম। এ উদ্যোক্তা বলেন, অনেক বায়ার চীনের অর্ডার বাতিল করেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার কথা ভাবছেন; যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু অর্ডার পেলেই বা কী হবে? পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে সরবরাহ করা তো সম্ভব নয়। পণ্য তৈরির কাঁচামালই তো বন্ধ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) এক হাজার ৯০৬ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫.৭১ শতাংশ কম। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩.৮১ শতাংশ। ইপিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সাত মাসে নিট পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৯৬২ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০১৮-১৯) একই সময়ের তুলনায় ৫.১৩ শতাংশ কম। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা কমেছে ১১.৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে ওভেন পোশাক রফতানিতে আয় হয়েছে ৯৪৪ কোটি ৩২ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.২৯ শতাংশ কম।
×