ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বছর পেরিয়ে যাচ্ছে চুড়িহাট্টা বিভীষিকার

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  বছর পেরিয়ে যাচ্ছে চুড়িহাট্টা বিভীষিকার

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে কাল। সর্বনাশা আগুন ৭১ তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শম্বুকগতিতে এগিয়ে চলছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এখনও মেলেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই বিভীষিকাময় মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন নয়টি তারিখ পার হয়েছে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে প্রতিবেদনের জন্য। এছাড়া মামলার বাদী ও সাক্ষীদের জবানবন্দীও নেয়া হয়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবীর হোসেন জানান, সবগুলো মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। সেটি এখনও হাতে পাইনি। তবে মামলার বাদী মোঃ আসিফ জানিয়েছেন, তদন্তের এই শম্বুকগতিতে হতাশ, মামলার তদন্তের অগ্রগতির কোন খবর তার কাছে নেই। তার সঙ্গে তদন্ত কর্তৃপক্ষ যোগাযোগও করছে না। আমরা চাই দ্রুত তদন্ত শেষ হোক। আমরা এর দ্রুত বিচার চাই। চুড়িহাট্টার আগুনে তার বাবা মোঃ জুম্মনকে (৫২) হারিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টা মোড়ের কাছে একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনসহ পাঁচটি ভবনে আগুন ধরে যায়। ওই ভবন এবং আশপাশের দোকানে থাকা রাসায়নিক আর প্লাস্টিক-পারফিউমের গুদাম আগুনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ ইউনিট দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের পোড়া লাশ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে। এদের মধ্যে চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে যান তাদের স্বজনরা। এ ঘটনায় পরের দিন ‘অবহেলার কারণে সংঘটিত অগ্নিকা-ের ফলে মৃত্যুসহ ভয়াবহ ক্ষতিসাধনের’ অপরাধে চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৩২/৩৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মোঃ আসিফ চকবাজার মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় যা বলা আছে মামলায় বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মোঃ হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ রাখতেন। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসা ভাড়া দেন তারা। এ মামলার আসামির তালিকায় রয়েছেন শহীদ ও হাসানসহ অজ্ঞাত পরিচয় ১০-১২ জন। মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, গত বছরের ১৬ এগ্রিল এজাহারভুক্ত আসামি দুই ভাই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। এর আগে রিমান্ডে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাদের। মোঃ হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ গত বছরের ৮ আগস্ট হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। এরপর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এই জামিনের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য বাড়িয়ে দেন বিচারপতি আবদুল হাফিজ এবং মোঃ ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ মোরাদুল ইসলাম। তিনি বদলি হওয়ায় এখন তদন্ত করছেন পরিদর্শক কবীর হোসেন। এ ব্যাপারে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক কবীর হোসেন জানান, ৭১ জন মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত শেষ করতে পারেননি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্ত বিভাগের চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ। অবহেলার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আরও ৫/৬ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের বর্তমান বা স্থায়ী কোন ঠিকানাই পাওয়া যাচ্ছে না। যে ঠিকানা অনুসন্ধানে পাওয়া গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দেখি তারা সেখানে থাকেন না। সেটি তাদের সঠিক ঠিকানাও নয়। আশপাশের কেউ ঠিকানা দিতেও পারছে না। তাছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তো এখনও রেডি হয়নি। আগে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছিল, নিয়মিত মামলা হওয়ার পর ওই মামলা শেষ হয়ে গেছে। এখন একটিই মামলা রয়েছে। আমি এখনও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাইনি। হয়তো একসঙ্গে আমাকে সরবরাহ করবেন চিকিৎসক। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার। আদালত আমার কাছে এখনও তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চায়নি, কোন তাগিদও দেয়নি। নিহতের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রসঙ্গে লালবাগ ডিভিশনের ডিসি মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, আমরা এখনও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাইনি। সব সময় চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। তারা বলছেন, রিপোর্ট দিতে একটু দেরি হবে। মরদেহের কিছু পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলেই দেব। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, ইতোমধ্যে ৭/৮টি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষ করেছি। বাকিগুলোর করা হচ্ছে। তিনি জানান, আশাকরি আজ বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সোহেল মাহমুদ জানান, মরদেহের ডিএনএ রিপোর্ট এক সপ্তাহ আগে আমরা হাতে পেয়েছি। তাছাড়া আমাদের এক চিকিৎসক বদলি হওয়ার কারণে একটু দেরি হয়েছে। আশাকরি বুধবার ৬৭টি মরদেহের মধ্যে অধিকাংশ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পুলিশের কাছে দেয়া হবে। এছাড়া বদলি চিকিৎসকের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সই নেয়া হয়নি। ঢাকার জেলা প্রশাসনের অফিস সহকারী মোঃ জামাল উদ্দিন জানান, চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ৭১ জন মৃত্যুর কথা নথিবদ্ধ। ঘটনাস্থলে পুড়ে মারা যায় ৬৭ জন। এছাড়া দগ্ধ ছিল ১৫ জন। এদের মধ্যে ৪ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ৭১টি মরদেহের মধ্যে চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া পুলিশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে। কারণ এই চারটি মরদেহ সহজেই শনাক্ত হয়েছিল।
×