ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সড়কে উন্মুক্ত ময়লার ভাগাড় কেন

প্রকাশিত: ১০:৩২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 সড়কে উন্মুক্ত ময়লার ভাগাড় কেন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নগরীর ব্যস্ততম এলাকা মৌচাক। ছোট-বড় দশটি মার্কেট অল্প জায়গার মধ্যেই। আছে ফুটপাথ জুড়ে ব্যবসা। খাবার হোটেল, ব্যাংক, কোচিং সেন্টারসহ ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় সব সময় মানুষের ভিড়। কিন্তু বিড়ম্বনা অন্যখানে। ফরচুন শপিংমলের সামনের সড়কে কয়েকটি ময়লার কন্টেনার দিনের পর দিন উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। প্রায় এক মাস ধরেই দুটি কন্টেনারে ময়লা কমাতে নিয়মিত আগুন দেয়া হয়। ফলে ময়লার যত গন্ধ তার চেয়ে বেশি পোড়া ময়লার দুর্গন্ধ। এলাকার মানুষ ময়লাপোড়া গন্ধে রীতিমতো অস্থির। নাকে রুমাল বা কাপড় দিয়ে চলতে হয় সবাইকে। এর ঠিক একশ’ গজের মধ্যে কর্ণফুলী মিডিয়া সেন্টারের পাশের ভবনের গলির মুখেই ছয়টি ময়লার কন্টেনার রাখা। কাছাকাছি এ রকম ময়লার ভাগাড়ে বিশুদ্ধ বাতাস নেয়ার কোন সুযোগ নেই মৌচাক এলাকায়। ঢাকা উত্তর সিটির চেয়ে দক্ষিণের জনবহুল রাস্তায় ময়লার কন্টেনার বেশি দেখা যায়। অথচ নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ^জুড়ে উন্নত ও বড় শহরে ময়লা অপসারণ কাজে পরিবর্তন এসেছে। ময়লা কোথাও উন্মুক্ত রাখা হয় না। কিন্তু ঢাকাকে যখন উন্নত শহরের আদলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা, ঠিক তখন শহরজুড়ে ময়লার বিড়ম্বনা। এজন্য নাগরিকের খুব একটা দায় নেই। দায় নগরপিতার। কিন্তু এর কোন বিকল্প নেই! রাতদিন উন্মুক্ত ময়লা আবর্জনার কর্মযজ্ঞ কবে শেষ হবে- প্রশ্ন নগরীর প্রতিটি মানুষের। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত নিউ ইস্কাটন। আবাসিক বাণিজ্যিক মিলিয়ে পুরোটাই এখন ঘনবসতি। এখানকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গেটের সামনে উন্মুক্ত ময়লার সারি সারি কন্টেনার। অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে এখানে রাতদিনের কর্মব্যস্ততা। অথচ এর উল্টো পাশেই অকুনোভা হাসপাতাল, মিনা বাজার, ব্যাংকসহ অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। কন্টেনার ডিপো ঘেঁষে উন্মুক্ত খাবারের দোকান, হোটেল, জাতীয় চার্চ পরিষদ ও এজি চার্চ স্কুল, স্যাকিড হার্ট স্কুল, ওয়াকফ ভবনসহ প্রতিষ্ঠানের কমতি নেই। মঙ্গলবার একঘণ্টা দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সব ময়লা আবর্জনা ভ্যানে করে রাস্তায় ফেলা হচ্ছে। আরেক দল পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাস্তা ময়লা কন্টেনারে তোলার চেষ্টা করছে। তবে ময়লা থেকে কাগজ, বোতলসহ বিক্রিযোগ্য জিনিসপত্র আলাদা করতে সময় বেশি লাগে। সবচেয়ে বড় সমস্যা দুর্গন্ধ। স্থানীয়রা জানালেন, এই ডাস্টবিনের কারণে এলাকার বাতাস আরও দূষিত হয়ে গেছে, সারাক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ায় ময়লা পচা দুর্গন্ধ। মগবাজার মোড় থেকে আমু ভাইয়ের গলি পর্যন্ত রয়েছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হাজার শিশুর দিনভর আনাগোনা এই সড়কে। অথচ এ নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। তবে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজনের দাবি দ্রুত এসব ডাস্টবিন সরিয়ে নেয়া হোক। মালিবাগ খিলগাঁও রেলগেট, মগবাজার ওয়্যারলেস, বাসাবো মোড়, কমলাপুর, অতীশ দীপঙ্কর রোড, মতিঝিল, ফকিরাপুল বাজার, মুগদা, রামপুরা, পরিবাগসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রাস্তায় উন্মুক্ত ময়লার কন্টেনার রাখার এ চিত্র দেখা যায়। ক্লিন সিটি করার ঘোষণা যখন দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে তখন রাস্তায় রাস্তায় এমন দৃশ্য কেন? উন্নত শহরের আদলে রাজধানী গড়ার স্বপ্ন যখন বাস্তবায়ন শুরু তখন উন্মুক্ত ময়লার কন্টেনার কী বার্তা দেয়। তবে নগরবাসীর আশা এবারের সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের থেকে সবচেয়ে বেশি গ্রীন ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি এসেছে। তাই নির্বাচিত মেয়ররা দায়িত্ব গ্রহণ শেষে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন এ আশা কেউ ছাড়তে চাইছেন না। সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ময়লা রাখার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে কিছু ঘর নির্মাণও হয়েছে। বাসা বাড়ি থেকে সংগৃহীত ময়লা ভ্যানে করে এসব ঘরে জমা করা হয়। তারপর ময়লার গাড়ি করে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে ফেলা হচ্ছে। কন্টেনার, গাড়ি, ভ্যান, ময়লা, পরিচ্ছন্ন কর্মী থেকে শুরু করে এ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম আবদ্ধ অবস্থায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পুুরোপুরি অপসারণ সম্ভব হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়লা আবর্জনা ও দুর্গন্ধে মানবদেহে নানা রকম রোগব্যাধি আক্রমণ করতে পারে। বর্জের দূষণ থকে পেটের পীড়া, চর্মরোগ, ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট, আলসার, গ্যাস্ট্রিক এমনকি লিভার ও কিডনি নষ্ট হতে পারে। হেলথ এ্যান্ড হোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, নানা দূষণের কবলে ঢাকার মানুষ। এর মধ্যে বর্জ্যরে দুর্গন্ধ একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা নগরবাসীর জন্য নতুন না হলেও সময়ের পালাবদলে এখন কমার কথা। দৃশ্যত তা কমছে না। সড়কে ময়লার কন্টেনারগুলোও উন্মুক্ত রাখায় মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সম্প্রতি উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, যে দেশে বঙ্গবন্ধুর জন্ম সে দেশের রাজধানী এত অপরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে এসেছি। আমাদের কাজ করতে হবে। মানুষ ড্রেনে ময়লা-আবর্জনা ফেলে, এটা হতে দেয়া যায় না। প্রতিটি দোকানে ডিএনসিসি নির্ধারিত ডিজাইনের ওয়েস্ট বিন এবং দুটি করে ফুল বা গাছের চারা রাখা বাধ্যতামূলক করা হবে, অন্যথায় ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহর, ইতালির বিভিন্ন শহরে ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলা হয় না। এটি একদিকে যেমন আইনত দন্ডনীয়, অপরদিকে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা অধিবাসীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এখানে বসবাসরত প্রবাসীরাও এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এশিয়ার অন্যতম বড় শহর ইরানের রাজধানী তেহরান। তেহরানের অধিকাংশ অংশই ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর। ৭৩০ বর্গকিমির এই শহর একটি সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত। জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। কখনও তেহরান শহরে বৃষ্টির পানি জমেছে এমন নজির নেই। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাও এতটা উন্নত যে দুর্গন্ধযুক্ত পানি কখনও নগরবাসীকে দেখতে হয় না। ঘরের ময়লা আবর্জনা তেহরানবাসীর রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হয়। রাত বারোটার পর সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি ওসব স্থান থেকে ময়লা ভোরের আগেই অপসারণ করে। যদি কোন নাগরিক ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে না রাখে তাহলে তাকে গুনতে হয় বড় জরিমানা। আবার সিটি কর্পোরেশনও যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে তাহলে জেল ও চাকরিচ্যুত হতে হয়। তেহরানে প্রতিটি রাস্তা বা গলির পাশে কয়েক বাড়ি পর পর ময়লা ফেলার জন্য প্লাস্টিকের বড় ডাস্টবিন রয়েছে। সবাই এসব ডাস্টবিনে ময়লা ফেলেন। উন্নত বিশ্বে এমন নির্দিষ্ট নিয়মে ময়লা ফেলা হলেও বাংলাদেশে যত্রতত্র ময়লা ফেলে কেন? আসলে অভাবটা কিসের- শিক্ষার, নাকি সচেতনতা? এসব নিয়ে কড়াকড়ি আইন কেন হয় না। এমন প্রশ্ন গুটিকয়েক সচেতন নাগরিকের। সর্বশেষ জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই শহরে এখন প্রতি বর্গকিমিতে সাড়ে ৪৪ হাজার লাখ মানুষের বাস। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে ইউএন হ্যাবিটেট। ঘনবসতির দিক দিয়ে এক নম্বরে ঢাকা, দ্বিতীয় ভারতের মুম্বাই, তৃতীয় কলম্বিয়ার মেডেলিন, আর চতুর্থ অবস্থানে ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা। বাংলাদেশের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বর্তমানে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ বাস করছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপ সংস্থার মতে, বিশ্বের বসবাসের উপযোগিতার বিবেচনায় সবচেয়ে অযোগ্য শহর ঢাকা। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য সুবিধা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোসহ ত্রিশটি মানদন্ড বিবেচনায় ঢাকার স্থান তলানিতে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকার অবস্থা আর কত খারাপ হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে?
×