ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাষা আন্দোলন ॥ প্রেক্ষাপট পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 ভাষা আন্দোলন ॥ প্রেক্ষাপট পটুয়াখালী

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের প্রতিটি জেলা, মহকুমা, থানা এবং গ্রাম পর্যায়ে। এর থেকে পিছিয়ে ছিল না সাগরপাড়ের দ্বীপ জেলা পটুয়াখালী। দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় পটুয়াখালীর সর্বস্তরের মানুষ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে সমানতালে অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে এখানকার সংগ্রামী ছাত্র যুব জনতা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এজন্য তাদের সইতে হয়েছে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর জেল জুলুম আর অবর্ণনীয় নির্যাতন। যা আজ ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের সে সময়কার শীর্ষস্থানীয় সৈনিকদের এখন আর তেমন কেউই জীবিত নেই। এমনকি তাঁদের অনেকের তেমন কোন স্মৃতিচিহ্নও নেই। কিন্তু রয়ে গেছে ভাষা সৈনিকদের বীরত্বগাথা। যদিও বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই তা অজানা। ক্রমে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনে উত্তাল পটুয়াখালীর সেই সময়কার গৌরবময় ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সে ইতিহাস তুলে ধরা আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ ভাষাসৈনিকদের সে ইতিহাসই পারে বর্তমান প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাতে। সে সময়ে পটুয়াখালী ছিল বরিশাল জেলার আওতাধীন একটি মহকুমা। ১৯৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পর বরিশাল জেলা যুবলীগ সভাপতি হন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার রামপুরা গ্রামের কৃতীসন্তান আলী আশরাফ ও সাধারণ সম্পাদক হন তৎকালীন গলাচিপা থানার এবং বর্তমানে রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামের আরেক কৃতীসন্তান আবদুল করিম মিয়া। পরবর্তীতে তারা দুজনই ভাসানী ন্যাপের সঙ্গে জড়িত হন। একই সময়ে যুবলীগের পটুয়াখালী মহকুমা কমিটিও গঠন করা হয়। এ কমিটিতেও বরিশালের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি আবদুল করিম মিয়াকে সভাপতি করা হয়। কবি খন্দকার আবদুল খালেক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা সকলেই তখন ওই সময়ে সংগ্রামী মুখ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এভাবে যুবলীগ পটুয়াখালী মহকুমা শাখার কমিটি গঠন করা হয়। মহান ভাষা আন্দোলনে যুবলীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ঢাকায় ভাষা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে ১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর পটুয়াখালী শহরের নতুনবাজার সদর রোডে অবস্থিত আজাদ ফার্মেসির পূর্ব পাশে কাদের হাওলাদারের বাসায় গোপন বৈঠকে যুবলীগ কমিটির পাশাপাশি আবদুল করিম মিয়াকে সভাপতি ও কবি খন্দকার আবদুল খালেককে সম্পাদক নতুন করে গঠন করা হয় ‘পটুয়াখালী মহকুমা ভাষা আন্দোলন আহ্বায়ক কমিটি’। পরে এ কমিটির নামকরণ করা হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে সাযুয্য রেখেই এ নামকরণ। বরিশাল যুবলীগের সভাপতি আলী আশরাফ, সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম মিয়া এবং বরিশাল জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবুল হাশেম মিয়া সকলেই ছিলেন পটুয়াখালীর বাসিন্দা। এঁদের মধ্যে আবুল হাশেম মিয়া ছিলেন গলাচিপা থানার চরচন্দ্রাইল গ্রামের কৃতীসন্তান। তাঁর নামের সঙ্গে গ্রামের নামটিও মিশে গিয়েছিল। বরিশালের সর্বত্র তিনি ‘চন্দ্রাইলের হাশেম’ নামে পরিচিত ছিলেন। বরিশালের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা পটুয়াখালীর সন্তান হওয়ায় বাড়তি একটি সুবিধা ছিল যে, তাঁরা খুব দ্রুতগতিতে পটুয়াখালীর সর্বত্র ভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হন। ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কাদের হাওলাদারের বাসায় দ্বিতীয় গোপন বৈঠকে কবি খন্দকার আবদুল খালেককে আহ্বায়ক ও জালালউদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ‘পটুয়াখালী মহকুমা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন গাজী আজাহার উদ্দিন, আবুল হোসেন আবু মিয়া, এ্যাডভোকেট গোলাম আহাদ চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন শিকদার, এটিএম ওবায়দুলাহ, রাখাল ব্যানার্জী, আবদুল খালেক, বীরেশ্বর বসু, শিক্ষক অতুল চন্দ্র দাস, ধ্রুবজ্যোতি দত্ত, মজিবুর রহমান, নয়া মিয়া, শাহাদত উলাহ, কাজল আহমেদ, দেবী দাস, এ্যাডভোকেট আবদুল মতলেব, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, জালালউদ্দিন আহমেদ, দলিল উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। কমিটির মধ্যে না থেকেও সঙ্কটকালীন সময়ে ভাষা আন্দোলনকে আরও বেগবান ও সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে অন্যদের মধ্যে সাহসী ভূমিকা রাখেন, পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এমএলএ মোহাম্মদ এমদাদ আলী, বিডি হাবিবুলাহ, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, এ্যাডভোকেট কেবিএম শামসুল হক, আবদুর রাজ্জাক ভেন্ডার, মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া, মাখন লাল দেউরি, শামসুল আলম, রাধেশ্যাম দেবনাথ, শংকর লাল দাস, অধ্যাপক গাজী নেছার উদ্দিন, হোসেন মিয়া মোক্তার, মোশারফ হোসেন বিশ্বাস, আবদুল মন্নান মিয়া, ডাক্তার কামরুন নেছা, এ্যাডভোকেট জেবুন নেছা প্রমুখ। পরবর্তীতে এঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ¯েœহভাজনও ছিলেন। রেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও শহরে সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় পুলিশের এক গোপন সূত্রে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলি বর্ষণে শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার খবর পৌঁছালে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই খবরের ভিত্তিতে আজাদ ফার্মেসির দোতলায় বসে পটুয়াখালী মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের জরুরী বৈঠক। সিদ্ধান্ত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি শহরে হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল ও জুবিলি স্কুল ময়দানে গণসমাবেশ কর্মসূচী পালনের। বৈঠকের সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিক স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পৌঁছালে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নামে হুলিয়া জারি হয়। নেতারা আত্মগোপনে থেকে কর্মসূচী সফল করার উদ্যোগ নেন। কর্মসূচী উপলক্ষে কবি খন্দকার খালেক রচনা করেন ‘রক্তশপথ’ নামের লিফলেট আকারে কবিতা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তা ছাপানোর কাজে। পটুয়াখালী শহরের কোন প্রেস মালিক ‘রক্তশপথ’ ছাপতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ‘আর্টপ্রেস’ নামের একটি ছাপাখানা এটি ছাপতে রাজি হয়। যদিও এজন্য আর্টপ্রেসকে পরবর্তীতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর আর্টপ্রেস সরকারী কোন ধরনের ছাপার কাজ পায়নি। এটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে সে লিফলেট প্রেসে ছেপে বিলি করা হলে সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। চরপাড়া পুরাতন রেজিস্ট্রি পুল সড়কে বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কর্মসূচী সফল করতে শহরের আদালতপাড়ায় বড় মসজিদ মহল্লা রোডস্থ এ্যাডভোকেট এমদাদ আলীর বৈঠকখানার উত্তর পাশে বড়মসজিদ সংলগ্ন বড় মাঠে সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ। পটুয়াখালীতে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রকাশ্য সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন এ্যাডভোকেট মোঃ এমদাদ আলী। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বিডি হাবিবুলাহ, এবিএম আবদুল লতিফ, আবদুল করিম মিয়া, আলী আশরাফ এবং এ্যাডভোকেট এমদাদ আলীর দুই মেয়ে কামরুন নেছা ও জেবুন নেছা। এ সভার পরেরদিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি গণসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয় এবং তা সফল করার আহ্বান জানান হয়। ২২ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক ছাত্র যুব জনতার উপস্থিতি দেখে টনক নড়ে মহকুমা প্রশাসনের। তারা পরেরদিনের গণসমাবেশ কর্মসূচী বানচালে তৎপর হয়ে ওঠে। নেতাদের গ্রেফতারে পুলিশ মাঠে নামে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বাধা উপেক্ষা করে বায়ান্নর ২৩ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালী মহকুমা শহর প্রতিবাদের জনপদে পরিণত হয়। অনুষ্ঠিত হয় স্মরণকালের বৃহত্তম গণসমাবেশ। এ্যাডভোকেট এমদাদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, এ্যাডভোকেট গোলাম আহাদ চৌধুরী প্রমুখ। সমাবেশের এক পর্যায়ে সৈয়দ আশরাফ হোসেন উপস্থিত জনতার সামনে তুলে ধরেন ঢাকায় শহীদ হওয়া আবদুস সালামের রক্তমাখা শার্ট। শহীদ সালামের রক্ত রাখা শার্ট পটুয়াখালীতে নিয়ে আসার পেছনেও আরেকটি ঘটনা রয়েছে। সৈয়দ আশরাফ হোসেনের আপন এক ভাই ওই সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের গুলিতে শহীদ হন আবদুস সালাম। গুলিতে গুরুতর আহত অবস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। সৈয়দ আশরাফ হোসেনের চিকিৎসক ভাই কৌশলে শহীদ সালামের শরীর থেকে রক্তমাখা শার্টটি সরিয়ে ফেলেন এবং সেটি অত্যন্ত গোপনে সৈয়দ আশরাফের কাছে হস্তান্তর করেন। এ রক্তমাখা শার্টটি ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেন, এমন ভাবনায় সৈয়দ আশরাফ অত্যন্ত গোপনে তা নিয়ে দোতলা লঞ্চে ঢাকা থেকে পটুয়াখালী নিয়ে আসেন। যেমন ভাবনা, তেমনই তার বাস্তবায়ন। শহীদ সালামের রক্তমাখা সে শার্ট বাঁশের মাথায় বেঁধে সমাবেশে পাকিস্তানী শাসকদের নির্মমতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে তাৎক্ষণিক সমাবেশে উপস্থিত ছাত্র জনতা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সমাবেশ রীতিমতো বিক্ষোভে উত্তাল আকার নেয়। সমাবেশ শেষ হতেই উপস্থিত ছাত্র যুব জনতা কারও আদেশ নির্দেশের অপেক্ষা না করে পটুয়াখালী শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। শহর অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শহরের সর্বত্র বের হয় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ মিছিল। পালিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। জনতার বিক্ষোভ আঁচ করতে পেরে পুলিশ বাধ্য হয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকে বেশ কয়েকদিন। আন্দোলনের ঢেউ পটুয়াখালী শহর ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলেও। টিনের চোঙা মুখে নিয়ে সব জায়গায় উচ্চারিত হয় ‘তোমার আমার ভাষা, বাংলা ভাষা-বাংলা ভাষা’ সেøাগান। যদিও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সুকৌশলী সিদ্ধান্তে সবকিছুই চলছিল নিয়মতান্ত্রিক। কোথাও ছিল না আন্দোলনের নামে হটকারী কোন কার্যকলাপ। বরং কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখা হতো। এক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে পটুয়াখালীর যোগসূত্র রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন বাউফলের এবিএম আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আশরাফ হোসেন। তারা বাউফলেও ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলেন। একইভাবে আবদুল করিম মিয়া ও আবুল হাশেম মিয়ার উদ্যোগে এমএ রব মিয়া, আনোয়ার হোসেন রতন মিয়া, মোসলেম ফরাজি, আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার, আবদুল বারেক মিয়া, আজাহার মুফতি প্রমুখের সহায়তায় গলাচিপায় ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়। গণসমাবেশের দুদিন পরে ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে স্টিমারে পটুয়াখালী আসেন তৎকালীন এমএনএ গলাচিপার সামছুদ্দিন সানু মিয়া ও বেতাগীর আবদুর রহমান খান নুরু মিয়া। জনতা তাদের ঘেরাও করে। একপর্যায়ে গণরোষে তারা এমএনএ পদ থেকে পদত্যাগ করার পত্র লিখে দিতে বাধ্য হন। যা জাতীয় পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়। যদিও ঢাকায় ফিরে তারা তা অস্বীকার করেন এবং জোর করে তাদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র লিখে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এভাবে মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্বে সমানভাবে অংশ নিয়েছেন পটুয়াখালীর মানুষ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে রেখেছেন অপরসীম অবদান। বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে ওই সময়ে আরও একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়। যা পটুয়াখালীর রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। আর সেটি হচ্ছে ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। ১৯৫৪ সালে ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জানা মতে ভাষা শহীদদের স্মরণে দেশের এটিই প্রথম পাঠাগার। পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন এমএলএ এ্যাডভোকেট মোহাম্মদ এমদাদ আলী এবং এমএনএ আবদুল করিম মিয়া ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল এমএনএ আবদুল করিম মিয়াকে সভাপতি ও জালাল উদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে শহরের নতুন বাজার পুরাতন স্টিমার ঘাটে সৈজদ্দিন মিয়ার টিনের ঘরের দোতলায় এ পাঠাগার প্রতিষ্ঠাসহ প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী পাঠাগারটি আজও পটুয়াখালীতে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন কলাপাড়ার আলাউদ্দিন আহমেদ। তাঁর নামে পটুয়াখালী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শহীদ আলাউদ্দিন শিশু পার্ক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ১৯৬৪ সালে পটুয়াখালীতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। পটুয়াখালী সরকারী কলেজ প্রাঙ্গণে প্রথম স্থায়ী এ শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে পটুয়াখালী পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করে। পৌরসভা কার্যালয় প্রাঙ্গণে এটি নির্মাণ করা হয়। লেখক : সাংবাদিক
×