ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মহননের পথে অস্ট্রেলিয়া

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 আত্মহননের পথে অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া এখনও থেকে থেকে দাবানলের আগুনে জ্বলছে। এর মধ্যেই দেশটির সরকার আরও কয়লা খনি উত্তোলনের পরিকল্পনা করার আহ্বান জানিয়েছে। দাবানলের আগুনে জ্বলতে থাকা বর্তমান পরিস্থিতিতে নেয়া এই সিদ্ধান্তগুলোর ফলে অস্ট্রেলিয়ায় আগামী দিনগুলোতে দেখা যেতে পারে- পিটু মাস্ক, সরিয়ে নেওয়ার আদেশ, জলবায়ু উদ্বাস্তু, সতর্কবার্তা সাইরেন, ঝড়, রক্তিম সূর্য, ভয়, বায়ু বিশোধক এবং সম্প্রদায়গুলো তৃতীয় বিশ্বের শিবিরগুলোতে হ্রাস পেয়েছে। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ২০১৯ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখা যায়,অস্ট্রেলিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প ইতোমধ্যে বিশাল সর্বস্বত্ব রচনা করে চলেছে। দেশটিতে এখনও ৩৭,৮০০ জন কয়লা উত্তোলনে নিযুক্ত রয়েছে। কোটি কোটি মৃত প্রাণী এবং পাখির ফোলা ও পচা দৃশ্য দেখেছে বিশ্ব। দাবানলের আগুনে শতাধিক আদিবাসীর সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। অধিক সংখ্যক কালো নটর ডেমস আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের ভূমির সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগের শারীরিক প্রকাশই যার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বহু শতাব্দী বিতাড়নের পরে এটি যেন তাদের জন্য অনেক বড় একটি সহিংসতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হয় এখানে যেন সর্বত্রই এক ভয়াবহ শোক বিরাজ করছে এবং যা ঘটে চলেছে তার জন্য তা অনেকটাই হতে পারে। দক্ষিণ উপকূলের একজন দুগ্ধচাষক ফারান টেরলিচ যার দুই বন্ধু আগুন ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে। যেটিকে তিনি একটি বর্ষণকারী মহাসাগর হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন যার ফলে লোকেরা মারা যাচ্ছে। হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন অঞ্চলে অনেক বাড়ি আগুনে পুড়লেও সেখানে আর পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। যদিও অনুমোদিত নতুন বিল্ডিংয়ের কারণে তারা সাশ্রয়ী হতে পারবে না। তার পরেও যদি নির্মিত হয় তবে সেগুলো বীমাযোগ্য নাও হতে পারে। স্থানীয় ইকোসিস্টেমগুলোর মতো স্থানীয় অর্থনীতি কখনই পুনরুদ্ধার করতে পারে না। নতুন একটি সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে যে অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেকেরও বেশি সরাসরি আগুনে পুরে ছাই হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমবর্ধমানভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে। দাবানলের কারণে দেশটির মোট ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলারে। মোট দেশীয় পণ্যে ইতোমধ্যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করেছে যে কোন অর্থনৈতিক পতন এড়াতে কয়লা খনি এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ কিনতে বাধ্য করা যেতে পারে। ব্রিটেনের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড বেটস বলেছেন, ‘তাপমাত্রা যদি প্রাক-স্তরের চেয়ে তিন ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায় তবে এটি আমাদের জানিয়ে দেয় যে ভবিষ্যতের বিশ্ব কেমন হতে পারে।’ এই ভয়াবহ নতুন বাস্তবতার বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটি ভীতিজনক নতুন ধারণা হচ্ছে সর্বনাশ। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক ড্যানিয়েল সেলারমাজার বলেছেন, এই শব্দটি এমন একটি অপরাধকে আহ্বান করে যা আমরা পূর্বে কল্পনা করতে পারিনি। কারণ আমাদের এর আগে কখনও সাক্ষ্য দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক মিসেস সেলারমাজার যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ইকোসিস্টেম হত্যার বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ার অগ্নিকান্ডের ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিতে যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, এটি আরও কিছু বিষয়। যেটা সব কিছুর হত্যাকান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ুবিদ মাইকেল ম্যানের মতে, ‘অনুমানযোগ্য যে অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ অংশই মানুষের বাসস্থানের জন্য খুব গরম এবং শুষ্ক হয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি উদীয়মান সমুদ্র থেকে আগত ধ্বংসের মুখোমুখি নিম্ন-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের চেয়ে আলাদা নয়। তবুও গত আগস্টে যখন সেই রাজ্যগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় আদিবাসীরা। তাদের বসবাসের বেশির ভাগ এলাকা পুড়ে গেছে। এ ছাড়া গ্রামের অনেক স্থাপনাতেও আগুন লেগে যায়। তবে এসব ঘটনায় তেমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সব আদিবাসীকে গ্রামের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়াতে দেখা যায়, প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে জরুরী ভিত্তিতে সেনাবাহিনী মাঠে নামিয়েছিল ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার। ভিক্টোরিয়া রাজ্য সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ও যান পাঠাতে রাজি হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেনল্ডস। তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়া আগুন থেকে বাঁচতে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোয় আশ্রয় নিয়েছিল অসংখ্য মানুষ। যে দুটি রাজ্য দাবানলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলসে বিশেষ সামরিক যান ব্ল্যাক হক ও চিনুক হেলিকপ্টার পাঠায় অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনী। দুর্গত ব্যক্তিদের উদ্ধার ও সহায়তা দেওয়ার কাজও করে সামরিক বাহিনী। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে নিউ সাউথ ওয়েলস রুরাল ফায়ার সার্ভিসের কমিশনার শেন ফিটসিমন্স বলেছিলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে সমুদ্রে আশ্রয় নিচ্ছে। নিউ সাউথ ওয়েলসে এর চেয়ে ভয়াবহ দাবানল আমরা কখনও দেখিনি।’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কাছেও জরুরী সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছিল। সপ্তাহ খানেক ধরে দাবানলে পুড়তে থাকা সিডনিতে আতশবাজি বন্ধ রাখার বিষয়ে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল। ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ সেই পিটিশনে সইও করেছিল। তবে সিডনির ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ সবুজ সংকেত দেওয়ার পর আতশবাজি নিয়ে সব ধোঁয়াশা কেটে যায়। আয়োজন করা হয় জমকালো প্রদর্শনীর। চলমান ডেস্ক
×