ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

করোনাভাইরাস ॥ পাল্টে দিয়েছে দৃশ্যপট

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

করোনাভাইরাস ॥ পাল্টে  দিয়েছে দৃশ্যপট

সারা বিশ্ব এখন যে বিষয়টির ওপর চোখ রাখছে তা হচ্ছে করোনাভাইরাস। তথ্যপ্রযুক্তির এই প্রাচুর্যের যুগেও একটি ভাইরাস নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে পুরো বিশ্বকে। হু হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। থামার যেন নামই নিচ্ছে না। ২০১৯-এনকোভি- যা নভেল করোনাভাইরাস নামে পরিচিত- সাম্প্রতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এশিয়ার বিভিন্ন অংশ এবং এর বাইরেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস। চীনে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫০০ ছাড়িয়েছে। এদিকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করলে তার মৃত্যুদ হতে পারে বলে জানিয়েছে দেশটির একটি আদালত। চীনে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ করোনাভাইরাসের উপসর্গ গোপন করলে কিংবা ভুল তথ্য দিলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আর এর শাস্তি হিসেবে এমনকি মৃত্যুদন্ড ও হতে পারে। চীনের একটি আদালত এমন নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা ডিপিএ। শনিবার আদালত এই সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভ্রমণের তথ্য লুকালেও তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। স্থানীয় সংবাদপত্র বেইজিং ডেইলি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে কেউ ভাইরাসটি ছড়াতে সহযোগিতা করলে তাকে মানুষের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলার অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে। গুরুতর ক্ষেত্রে নির্দেশনা অমান্যকারীদের ১০ বছরের জেল, যাবজ্জীবন কারাদ অথবা মৃত্যুদে র মুখোমুখি হতে হবে। এদিকে শনিবার চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনও একটি নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। সেখানে জ্বর, কাশি অথবা অন্য কোন রোগে আক্রান্তদের সড়ক, রেল কিংবা বিমানে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ইউরোপে প্রথম মৃত্যু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার ফ্রান্সে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইউরোপে এই রোগে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা এটি। মারা যাওয়া ব্যক্তি চীনের আশি বছর বয়সী নাগরিক। জানুয়ারির ২৫ তারিখ থেকে তিনি এবং তার কন্যা ফ্রান্সের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তার মেয়ের অবস্থা উদ্বেগজনক নয়। শিগগিরই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে বলে মন্ত্রীর বরাত দিয়ে জানিয়েছে ফরাসী সংবাদপত্র ল্যু ফিগারো। এর আগে চীনের বাইরে ফিলিপিন্স, হংকং এবং জাপানে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ফ্রান্সে এখন পর্যন্ত ১১ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। নতুন রোগ কোভিড ১৯ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে নতুন করোনাভাইরাসের কারণে হওয়া রোগের আনুষ্ঠানিক নাম কোভিড-১৯। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস এ্যাঢানম গেব্রেইসাস সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এখন রোগটির একটি নতুন নাম রয়েছে আমাদের কাছে। সেটি হলো কোভিড-১৯।’ এটি ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়ানোর পর এই ঘোষণা এলো। ডাক্তার গেব্রেইসাস বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আগ্রাসীভাবে এই নতুন ভাইরাসের মোকাবেলা করার জন্য। করোনাভাইরাস শব্দটি রোগ সৃষ্টিকারী নতুন ভাইরাসটিকে উল্লেখ না করে ওই গ্রুপের সব ভাইরাসকে ইঙ্গিত করে। ভাইরাসের নাম প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ট্যাক্সনমি অব ভাইরাসেস এই ভাইরাসটিকে সার্স-সিওভি-২ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। কোন বিশেষ গ্রুপ অথবা দেশকে কেন্দ্র করে যেন ভীতি না ছড়ায়, তা নিশ্চিত করতে ভাইরাসটির আনুষ্ঠানিক একটি নাম দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন গবেষকরা। চীনের অর্থনৈতিক অবকাঠামো লুনার নিউ ইয়ার চীনের পর্যটন ও সেবা খাতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। কিন্তু এ বছর হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো প্রায় জনশূন্য ছিল। অধিকাংশ কনসার্ট ও স্পোর্টিং ইভেন্ট বাতিল করা হয়েছে। একাধিক সিনেমা মুক্তি দেয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেগুলো স্থগিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের কারণে চীনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। যা শুধু বছরের প্রথম কোয়ার্টারের আনুমানিক হিসাব। করোনাভাইরাসের কারণে চীনে বেকারত্বের হারও বৃদ্ধি পেতে পারে। চলতি বছর চীনের চাকরির বাজার এমনিতেই চাপে ছিল। চীনের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রযুক্তি খাতে কাজের সুযোগ আগের চেয়ে কমেছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এ ছাড়া প্রতিবছর চীনের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ গ্রাম থেকে শহরে কাজের সন্ধানে আসেন। তারা খুবই কম মূল্যে নির্মাণ ও উৎপাদন খাতে কাজ করে থাকেন। কিন্তু এ বছর অনেক কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তাদের কাজ পাওয়া বেশ কঠিন হবে। বিশেষ করে হুবেই প্রদেশের ১০ লাখ কর্মজীবী মানুষকে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হবে। কারণ সেখানেই করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যে দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি তা নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে চীনের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে এ বছর জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে। বিদেশী কোম্পানিগুলো যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে করোনাভাইরাস যে শুধু চীনের অর্থনীতিকে সমস্যায় ফেলেছে তা কিন্তু নয়। বরং চীনের সঙ্গে যেসব দেশের ব্যবসায়িক লেনদেন বেশি তারাও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের বড় কিছু কোম্পানি একদিকে চীন থেকে পণ্য ক্রয় করে। আবার একইসঙ্গে চীনেই তারা বিক্রি করে। ফলে এখানে উভয় সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। এক দিকে তারা চাহিদা মোতাবেক পণ্য পাচ্ছে না। যা তারা চাইলে কোন দেশে বিক্রি করতে পারে। আরেক দিকে চীনের ক্রেতাদের তারা সাময়িকভাবে হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট এ্যাপল তাদের অধিকাংশ পণ্যই চীনে সংযোজন করে থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাসে ছড়িয়ে পড়ার পর এ্যাপল তাদের কর্মীদের চীন ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। কোম্পানিটি বর্তমানে দুই ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, তারা তাদের পণ্যের সরবরাহ সঠিক সময়ে পাবে কি না। আর দ্বিতীয়ত, তারা বছরের প্রথম কোয়ার্টারে চীনে কেমন ব্যবসা করতে পারবে। কারণ চীন এ্যাপলের জন্য বড় একটি বাজার। গত বছর তারা ছয় ভাগের এক ভাগ পণ্য চীনে বিক্রি করেছে। কিন্তু ভাইরাসের কারণে তাদের ৪২টি শাখা বন্ধ করতে হয়েছে। বাচ্চাদের খেলনা নির্মাণে শীর্ষে রয়েছে চীন। কিন্তু চীন-মার্কিন বাণিজ্যের যুদ্ধের কারণে এই খাতটি অনেক দিন ধরে বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অতিরিক্ত কর বসানোর হুমকি দেয়ার পর চীনের অনেক কোম্পানি দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক খেলনা তৈরি করেছিল। পাশাপাশি অধিকাংশ খেলনা তারা থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে মজুদ করে রেখেছিল। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পর এখন আর সে ধরনের হুমকি নেই। কিন্তু বর্তমানে তারা করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সামনেই জার্মানির নুরেমবার্গে আন্তর্জাতিক খেলনা মেলা হবে। সেখানে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে থাকে। পাশাপাশি তাদের থেকে বিভিন্ন কোম্পানি খেলনা ক্রয় করে থাকে। কিন্তু এই সময়ে চীনের অনেক খেলনা তৈরির কারখানা বন্ধ রয়েছে। ফলে তাদের ওপর নির্ভরশীল অনেক কোম্পানিও এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সূত্র : ইন্টারনেট
×