ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে না : বিসিবিএ

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাণিজ্যে  প্রভাব পড়বে না : বিসিবিএ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস এ্যাসোশিয়েসন (বিসিবিএ)। গুজবে কান না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-অস্থির ও উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু এখনো ঘটেনি। আমদানি-রফতানিতে চীনের বন্দর ও কাস্টম হাউসগুলো চালু হতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এই ভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, করোনাভাইরাসে প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সাময়িক যতটা চাপ তৈরি হয়েছে তা শীঘ্রই দূর হবে। তবে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এখন পর্যন্ত কোন প্রভাব না পড়লেও বড় বড় প্রকল্পের কাজ কিছুটা ব্যহত হতে পারে। কারণ যেসব প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা নববর্ষের ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন তাদেরকে এখন ফিরে না আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে করোনার প্রভাব কমে আসলে চলমান বাণিজ্য ও কাজের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা দ্বিগুন অ্যাফোর্ট দিয়ে পুষিয়ে দেয়া হবে। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে চীন সরকার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। চীনের এই দুর্র্যোগের সময় বাংলাদেশ পাশে থেকে প্রমাণ দিয়েছে তারাই প্রকৃত বন্ধু। ভবিষ্যতে চীন ও বাংলাদেশ একসাথে এগিয়ে যাবে। সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিসিবিএ আয়োজিত ‘চীন-এ করোনা ভাইরাস আক্রমন ও আমাদের করুণীয়’ শীর্ষক আলোচনায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। এছাড়া বক্তব্য রাখেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. জমির, সংগঠনটির সভাপতি যাদব দেব নাথ, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এ্যাডভোকেট কুতুব উদ্দিন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তরুণ কান্তি দাস, আওয়ামীলীগ নেতা ড. সেলিম মাহমুদ, পরিচালক ব্যরিষ্টার ইফতেখার জুনায়েদ, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত প্রমুখ। এর আগে চীনা রাষ্ট্রদূত জাতীয় প্রেসক্লাবে কূটনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিকাব আয়োজিত ‘ডিকাব টকে’ও করোনা ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে কথা বলেন। চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ যখন চীনকে দোষ দিচ্ছে তখন বাংলাদেশ চীনের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ চীনের বিপদের বড় ও পরীক্ষিত বন্ধু। ভাইরাস এমন একটি ফ্লু যা যেকোন দেশ থেকে সৃষ্টি হতে পারে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে জিকা ও এ্যাবোলা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তখন কিন্তু চীন কোন দেশকে ব্লেম দেয়নি। অথচ করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনকে ব্লেম দেয়া হয়। সোস্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ভুয়া নিউজ দেয়া হচ্ছে। এ কারণে এ নিয়ে যাতে ভুয়া নিউজ তৈরি না সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রদূত বলেন, করোনা ভাইরাস চীনের উহান প্রদেশে দেখা দিয়েছে। ওই প্রদেশে কেউ যেতে পারছে না, এমনকি কেউ ওখান থেকে বের হতে পারছে না। চীনের নাগরিক ও সারা বিশ্বের কথা চিন্তা করে প্রদেশটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। তবে ভাল খবর হচ্ছে উহানে এখন করোনার প্রভাব কমে এসেছে। গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি একেবারে নির্মূল হবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, বিশ্বের যেকোন জায়গায় যেকোন মুর্হূতে যেকোন ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু সেটা মোকাবেলায় প্রস্তুতিটা কেমন হবে সেটাই বড় বিষয়। চীন সরকার অত্যন্ত দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় চীনের সঙ্গে কাজ করতে আন্তরিক। করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে প্রতিনিয়ত তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন। চীনের রাষ্ট্রপ্রধানকে সর্বাত্বক সহযোগিতকার কথা জানিয়েছেন। চীন সরকার গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে এ বিষয়গুলো মনে রাখবে। ডিকাব আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত। এ কারণে ঢাকায় চীনের দূতাবাস চীনাদের এ দেশে থাকার ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন কাজে যুক্ত যারা চীনে ফিরে গেছেন, তাদের এখনই ফিরে আসতে নিষেধ করেছে। বাংলাদেশে থাকা কোনো চাইনিজ এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হননি। আবার চীনে থাকা কোনো বাংলাদেশী আক্রান্ত হননি। দুর্ভাগ্যক্রমে সিঙ্গাপুরে পাঁচ বাংলাদেশী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসা চলছে। বাংলাদেশে আট হাজারের মতো চাইনিজ কর্মী রয়েছেন জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনা নববর্ষ উপলক্ষে এই কর্মীদের এক দশমাংশ স্বদেশে ছুটিতে গেছেন। এই সংখ্যা খুব বড় না হলেও এরা কি-পারসন বিধায় প্রকল্পগুলোর কাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। লি জিমিং আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রফতানিতে হয়তো সাময়িক প্রভাব পড়েছে। তবে চীন সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। চীনা নববর্ষের ছুটি শেষ হয়েছে। সবাই কাজে যোগ দিতে শুরু করেছে। পণ্য আমদানি-রফতানিতেও গতি আসবে। করোনাভাইরাস ছড়ানোর কারণে চীনের বদলে বিকল্প বাজার খোলার বিষয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কথা-বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রদূত বলেন, হুট করে অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য খোঁজা এবং সে অনুযায়ী আমদানি করার সিদ্ধান্ত সহজ হবে না। রাষ্ট্রদূত বলেন, উহানে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত পাওয়া গেলেও এই ভাইরাস চীনেই সৃষ্টি হয়েছে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। পশ্চিমারা বারবার অপপ্রচার করছে যে, এই ভাইরাস চীনে সৃষ্টি হয়েছে, তা সত্য নয়। অনেক দেশ চীনকে দোষারোপ করছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। চীনের সরকার এ ইস্যুতে খুবই সতর্ক ভূমিকা পালন করছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মানুষের জীবন রক্ষায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, সেটা চীন অথবা চীনের বাইরে যেখানেই হোক না কেন। ভাইরাসের কোনো দেশ-সীমান্ত নেই মন্তব্য করে লি জিমিং বলেন, ১৬০ দেশ চীনকে এ নিয়ে সহমর্মিতা দেখিয়ে বলেছে, তারা আমাদের পাশে আছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) শনাক্ত করতে বাংলাদেশকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ৫০০টি স্বাস্থ্য পরীক্ষার উপকরণ (কিট) দিচ্ছে চীন। আগামী দুই দিনের মধ্যে উপকরণগুলো বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে। চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিংকে লেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠির কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, ভাইরাসের আক্রমণে স্বজন হারানো চীনা পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গাউন ও হাতমোজা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে লি জিমিং বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন খুব নিবিড়ভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমার মিলে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রপে বেশকিছু কৌশল প্রণয়ন করছে। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিষয়। চীন শুধু এটা নিয়ে ইতিবাচক সহযোগিতা করতে পারে। এদিকে, বিসিবিএ অনুষ্ঠানে সংগঠনটির সভাপতি যাদব দেব নাথ বলেন, চীন বরাবরই বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য অংশীদার। পৃথিবীর আর কোনো দেশের সঙ্গে এত সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের গুজব রটিয়ে চীনের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সোস্যাল মিডিয়ায় ভুয়া ও মিথ্যা তথ্যে ভরে যাচ্ছে। অথচ এগুলোর কোন সত্যতা নেই। চীনের অর্থনীতিতে ধস নামলে বাংলাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে বিপর্যয় তৈরি হবে। এ কারণে বিশ্বের সকল দেশের উচিত এই্ দুর্যোগের সময় চীনের পাশে থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করা। তবে আশার কথা হলো, চীনের সঙ্গে কাস্টম হাউস ও বন্দরগুলো আবার চালু হতে শুরু করেছে। নিজের প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার নিজস্ব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে চীনে। স্টাফরা কাজকর্ম শুরু করেছেন ওখানে। দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে করেন তিনি। ড. সেলিম মাহবুব বলেন, পশ্চিমা মিডিয়াগুলো গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি জটিল করছে। বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য ও উন্নয়ন অংশীদার চীন। এ কারণে গুজবে কান না দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে স্টেক হোল্ডার ও সরকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। শ্যামল দত্ত বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে গ্লোবাল পলিটিক্স চলছে। একটি পক্ষ গুজব ছড়িয়ে বিষয়টি অতি রঞ্জিত করছে। কিন্তু বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। মো. জমির বলেন, চীন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু তাই চায়নার সঙ্গে আছি, থাকবো। গুজবে কান না দিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে আসুন চায়নাকে সহযোগীতা করি।
×