ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের পাশে ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

মানুষের পাশে ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’

দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। উভয় পরীক্ষাতেই ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড হয়েছেন। শিক্ষাজীবন থেকেই মানবিক বিষয়গুলো ভাবাত তাঁকে। সম্মান প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় গ্রামের এক মেধাবী মেয়ের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছেন। সে মেয়েটি গত বছর ময়মনসিংহ মেডিক্যাল থেকে বিএসসি নার্সিং শেষ করছে । ২০১৭ সালে ৩৫তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে সাতক্ষীরা সরকারী কলেজে যোগদান করেন তিনি। সরকারী চাকরিতে যোগদান করে আরাম আয়েশে দিন না কাটিয়ে মানব সেবা, মানবিক কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করেন ইদ্রিস আলী। তাঁর নেতৃত্বেই ২০১৮ সালে গড়ে ওঠে ‘হিউম্যানিটি ফার্স্ট’ নামক একটি মানবিক সংগঠন। মানবিক এই প্ল্যাটফর্মের মধ্য দিয়ে বিগত দুই বছরে ৯৫টি মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ৩৫ জন রোগীকে সুস্থ হতে আর্থিক ও অন্যান্য বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। রোগীদের মধ্যে কেউ জন্মগত হার্ট ছিদ্র, কারও বা ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার, হার্নিয়া, কারও আলসার, কেউবা আবার কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত। কেউ এক্সিডেন্টের রোগী, কারও পায়ে গ্যাংগ্রিন এমন বিভিন্ন ধরনের রোগীর পাশে আর্থিক থেকে শুরু করে রক্ত সংগ্রহ করা পর্যন্ত সারাক্ষণ সেবা দিয়ে যান তিনি। কখনও বা অসুস্থ পশুপাখিকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটেন, কখনও বা ছোটেন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে। ছুটির দিনগুলোতে তিনি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বেড়ান অসহায় ও অসুস্থ রোগীর সন্ধানে। সুস্থ হলে নিজ উদ্যোগে রোগীকে বাড়িতেও পৌঁছে দিয়ে আসেন। কোন কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে চিকিৎসা পরবর্তী কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে দেন। শিক্ষার আলো থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না থাকে, অর্থের অভাবে যেন কোন মেধাবী শিক্ষার্থী মাঝপথে ঝরে না পড়েÑ এ জন্য নিজের ভেতর এক ধরনের তাড়না অনুভব করেন তিনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে ৩৪টির উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি ও তাঁর সংগঠন। মোরাল প্যারেন্টিং ক্যাটাগরিতে ১৭ জন অসহায় ছেলেমেয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছেন। (মোরাল প্যারেন্টিং হলÑ মেধাবী অথচ গরিব এমন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের পুরো ব্যয়ভার গ্রহণ করা)। এই শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই এতিম-অসহায়। কিছুদিন আগে একটি ছেলে বিমান বাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। এর আগে একটি ছেলে ইসলামী ফাউন্ডেশনে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি পেয়েছেন। এ ছাড়া অসংখ্য শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার ফর্মফিলাব, নতুন বছরের বই কিনে দেয়া, চাকরি জোগাড় করে দেয়া, বিনা পয়সায় প্রাইভেট টিউশনির ব্যবস্থা করা, চাকরির বই সংগ্রহ করে দেয়া প্রভৃতি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো থেকে প্রদত্ত অর্থ তিনি মানব সেবার কাজে ব্যয় করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের বইপাঠে উৎসাহিত করার জন্য নিজের ক্রয়কৃত বই তাদের সরবরাহ করেন। মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাঠচক্র করেন। শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস বাড়াতে তাদের নিয়ে কলেজে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রিডিং ক্লাব’। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নে তিনি একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া আরও দুটি লাইব্রেরিতে বই সরবরাহ করেছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটিভিত্তিক লাইব্রেরি করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি সুন্দরবন উপকূলবর্তী অঞ্চলের স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে নিতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলবর্তী গ্রাম পাতাখালীতে হাসি-খেলা-ছন্দে, শিখি মহানন্দে- স্লেøাগানকে উপজীব্য করে ‘স্কুল অব হিউম্যানিটি’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ স্কুলের কার্যক্রম নিয়ে জাতীয় ইংরেজী দৈনিক ‘ঢাকা ট্রিবিউন’, ‘বাংলাদেশ পোস্ট’সহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন আঞ্চলিক পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন করেছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরে একটি বেসরকারী প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন। সুন্দরবন উপকূলবর্তী বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, নীলডুমুর অঞ্চলে ঝরে পড়া শিশুদের নিয়ে আরও দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ইদ্রিস আলী এব্ং অন্য আর যেসব মানবিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন তার মধ্যে রয়েছে- দুস্থ, অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ইতোমধ্যে তিনি ১৮ জন এমন মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া ৫ জন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কন্যার বিয়েতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পাওয়া সাহায্যের মাধ্যমে সম্পূর্ণ খরচ বহন করেছেন। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত একজন ভিক্ষুক, একজন প্রতিবন্ধী ও একজন স্বামী পরিত্যক্ত মহিলাকে ঘর নির্মাণে সহায়তা করেছেন। গরিব অসুস্থ ব্যক্তিদের রক্ত সরবরাহের লক্ষ্যে ‘ব্লাড ফর হিউম্যানিটি’ নামক একটি ব্লাড ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শুরু করে খুলনা সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের রক্তের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে এ সংগঠনটি। শীতকালে গরিব শীতার্তদের শীতের পোশাক সরবরাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেইন গেটে ‘মহানুভবতার দেয়াল’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি শীতে অসহায় মানুষের উষ্ণতা দিতে একটু হলেও সহায়তা করেন। ঈদ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে গরিব অসহায় মানুষের ফ্রি চিকিৎসারও ব্যবস্থা করে থাকেন। রমজান মাসে গরিব অসহায় রোজাদারদের জন্য মাসব্যাপী ফ্রি ইফতারি ও সেহরির ব্যবস্থা করে থাকেন প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া ঈদের সময় ছিন্নমূল বাচ্চাদের নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করাও ইদ্রিস আলীর কাজের অন্তর্ভুক্ত।এ যাবত ৫টি ইদে গরিব অসহায়দের মধ্যে নতুন পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন তিনি। সময় পেলেই ইদ্রিস আলী ছুটে যান বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে তাদের প্রয়োজনীয় খোঁজ নেন। বিভিন্ন সময়ে তাদের খাবার ও নতুন পোশাক সরবরাহ করেন। ইদ্রিস আলী বর্তমানে সুন্দরবন উপকূলবর্তী অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে পূর্ব প্রস্তুতি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সুন্দরবন রক্ষা বিষয়ক জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন। ইদ্রিস আলীর এমন সব মানবিক কাজ নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন টেলিভিশন ও জাতীয় দৈনিকে একাধিক প্রতিবেদন বেরিয়েছে। গত ২৭ মে ২০১৯ যমুনা টেলিভিশনের সকালের বাংলাদেশে ইদ্রিস আলীর মানবিক কার্যক্রম নিয়ে লাইভ সম্প্রচার হয়েছে। এ ছাড়া ২ অক্টোবর, ২০১৯ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রজন্ম পাতায় ‘এক মানবিক প্রভাষকের গল্প’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১৪ অক্টোবর, ২০১৯ ঢাকা ট্রিবিউন ও ১৫ অক্টোবর ২০১৯-এ বাংলাদেশ পোস্ট পত্রিকায় ইদ্রিস আলীর প্রতিষ্ঠিত মানবতার স্কুল নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও ইদ্রিস আলির মানবিক কাজ নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
×