স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাকে তার শান্তিনগর, চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর লোকেরা। তারপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রখ্যাত এই সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন স্মরণে ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ ও ‘সিরাজুদ্দীন হোসেন ও সমকালীন সাংবাদিকতা’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে রবিবার সন্ধ্যায়। চন্দ্রাবতী একাডেমি আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। সম্মানিত আলোচক ছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান, জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শামসুজ্জামান খান ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
প্রধান অতিথির আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেন, আমাদের সঙ্গে সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। আমি খুব ছোটবেলায় তাকে শুধু সিরাজ কাকা বলেই চিনেছি। তার সন্তানেরাও আমার বাবাকে ওয়াদুদ কাকা হিসেবে জেনেছে। তারা শুধু এক জায়গায় কাজ করেছেন এ জন্য বন্ধুত্ব তা না তারা একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আমরা পরবর্তীতে আমাদের ইতিহাস, দেশ ও আদর্শকে ভুলে গেছি। আজ যখন আমরা সঠিক পথে চলছি তখন আমাদের সিরাজ কাকার মতো আমার বাবার মতো মানুষদের জানতে হবে তারা কি বলেছেন এটা বুঝতে হবে। এই বই দুটি আমি মনে করি সে ধরনের ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে।
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান বলেন, আমাদের দেশে ষাটের দশকে খুবই একটা উত্তাল সময় বিরাজ করছিল। একদিকে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অন্যদিকে আইয়ুবের সৈরাচারী শাসন। এসবের মধ্যে সংবাদপত্রের কাজটা খুবই গুরুত্ব বহন করত। এই ঢাকা শহরে তখন পাঁচ অথবা ছয়টা পত্রিকা বের হতো। এরমধ্যে চারটি মূল ধারার পত্রিকা একসঙ্গে চলত। যেমন ইত্তেফাক, সংবাদ, পরবর্তীতে আজাদও যোগ দেয় এবং অবজারভার। অন্যদিকে মর্নিং নিউজসহ অন্য পত্রিকা আইয়ুব খানের পক্ষে ছিল। আমি তখন সংবাদে চাকরি করতাম। সে সময় সিরাজুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগটা ভাল ছিল। নীতি এবং আদর্শের দিক থেকে সংবাদ ও ইত্তেফাকের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল। এই সময় আইয়ুবের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচারে দুই পত্রিকার নীতির কোন অমিল ছিল না। যদিও অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য ছিল। তেষট্টি সালে ঢাকায় একটা দাঙ্গা হয়। সবুর খান এবং মোনায়েম খান এই দাঙ্গাটা লাগায়। হিন্দুদের এখান থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে এবং তাদের সবকিছু দখল করে। দেখা গেল দাঙ্গা বন্ধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় এই পত্রিকাগুলো নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত হয় যে চারটি পত্রিকা একসঙ্গে একটি ব্যানারে হেড লাইনে একটি আবেদন করা হবে। সেটি ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। পরে জেনেছি এটার মূল রাইটার ছিল সিরাজ ভাই। পরবর্তীতে আজাদ রবীন্দ্র শতবর্ষের বিরুদ্ধে প্রবল লেখা শুরু করে। কিন্তু সংবাদ ও ইত্তেফাক রবীন্দ্র শতবর্ষের পক্ষে নানা রকম কমিটি এবং তার কার্যক্রম তুলে ধরত। তখন যারা এসেছেন সাংবাদিকতায় তারা নতুন প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন। তারমধ্যে কেউ কেউ দেশ ভাগের আগে সাংবাদিকতা শুরু করেছেন। এরমধ্যে সিরাজ ভাই, কেজি ভাইসহ আরও অনেকে ছিলেন। এদের মধ্যে যারা একটু সিনিয়র ছিলেন তারা আবার পাকিস্তানপন্থী হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে যারা ছিলেন তারা মোটামুটিভাবে আস্তে আস্তে দেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশ আন্দোলনে শরিক হন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তখন সিরাজুদ্দীন হোসেনের অবদান নানাভাবে ছিল। তারমধ্যে শিরোনাম লেখাসহ অনেক কিছু। তখন যারা সাংবাদিকতার মূল ধারাটাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন তারমধ্যে সিরাজুদ্দীন হোসেন সাহেব একজন। সত্তরের পরে এই সাংবাদিকতার ধারাটা অন্যদিকে চলে যেতে থাকে। তখন সামনে আসে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের ধারায় তখন সমগ্র বাঙালী একসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, এদেশের সাংবাদিকতায় শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। তার জীবন আর সাংবাদিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তার নানারকম উদ্ভাবন, অর্থাৎ তিনি সংবাদের শিরোনাম তৈরি করেই সকলের মাঝে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকতার পাশাপাশি বাঙালীর অধিকার আদায়ের প্রতিও তিনি সচেতন ছিলেন। আওয়ামী লীগের যে রাজনীতি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনীতির ধারাটি বিকশিত হয়েছিল সেটির সঙ্গেও তিনি সম্পূর্ণভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার শুরুতেই তাকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যু বাঙালীর জন্য বড় রকমের ক্ষতি হয়েছিল। তবে তার লেখালেখি পর্যায়ভাবে প্রকাশ করতে পারলে আগামী প্রজন্ম তার কর্মময় জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেছেন, কিছু মানুষ আছেন যে যাদের কর্মযজ্ঞ দিয়ে তারা একটি কর্মফল নির্ধারণ করেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন সেরকম একজন মানুষ। আমরা ক্রমান্বয়ে মেধাশূন্য হচ্ছি। পথ থেকে বিপথে চলে যাচ্ছি। সিরাজুদ্দীন হোসেনের এই বই ও সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিয়ে যে বই প্রকাশ করেছে চন্দ্রাবতী একাডেমি, তারা তাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করেছে। দায় থেকে এ কাজটা করেছে। তিনি আরও বলেন, ২২/২৩ বছর বয়সে আমাদের অধিকার বঞ্চনার একটা ইতিহাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেসময় অনেকেই অনেক রকম কাজ করেছে। সাংবাদিকতা করেও কিছু মানুষ এ কাজে অবদান রেখেছিল। সিরাজুদ্দীন হোসেন সেরকম একজন।
কামরুজ্জামান কাজল বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বই প্রকাশ করতে পেরে আমরা গর্বিত। বই দুটি করতে তিন বছর সময় লেগেছে। অন্তত পনেরোবার বইগুলো সম্পাদনা করা হয়েছে। যে সম্পাদক ছিলেন, তারপরেও যে বই দুটো বের করতে পেরেছি আমাদের জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার। এবং ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পরিবারের প্রতি। তারা আমাকে এই বইগুলো করার সুযোগ করে দিয়েছে।
শুরুতে বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান ড. তৌহিদ রেজা নূরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন চন্দ্রাবতী একাডেমির নির্বাহী পরিচালক কামরুজ্জামান কাজল।