ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জান্নাতুন নিসা

কিছু কথা ও ভাষার গান

প্রকাশিত: ০৮:১২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 কিছু কথা ও ভাষার গান

পাথর যুগেও মানুষ গান গাইত; সম্ভবত তখন গান গাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিক কিছু শব্দ ও ছন্দের মাধ্যমে। সুরের মূর্ছনা বরাবরই মানুষকে আকর্ষণ করেছে, ভাললাগায় কিংবা ভালবাসায় অভিভূত করেছে প্রকৃতির কিংবা দেবীর আরাধ্য হয়ে। আবার এই গান কখনও কখনও মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে নতুন মাত্রায় সৃষ্টির জয়গানে কিংবা দেশমাতৃকার টানে এগিয়ে যাওয়ায়, এমনকি আন্দোলনে বীরসেনানী হতেও গানের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। গানের মূল যে ভাষা এই ভাষা নিয়ে বিরল হলেও রয়েছে আন্দোলন, রক্তাক্ত সংগ্রাম; বাংলা ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন-সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের প্রথম পর্ব থেকে ভাষার গান রচনা শুরু হয়। এই গান আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ভাষার প্রতি ভালবাসা, মমত্ববোধ, আন্তরিকতা এসব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মায়ের ভাষার প্রতি আকুতির এক অপরূপ দৃষ্টান্ত আমাদের এই অমর একুশ। ভাষার জন্য অকুতোভয় বাঙালী কী করে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে, তা আজ আর কারও অজানা নয়। ইউনেস্কো ও জাতিসংঘের বদৌলতে এই দিনটি আমরা ভাগ করে নিয়েছি পুরো পৃথিবীর সঙ্গে। আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কারে পৃথিবীর সকল দেশ আজ একীভূত। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের দেশটি ছোট হলেও আমাদের গর্জন অনেক বড়। সেই গর্জনের অনেক প্রাপ্তি যা আজও পৃথিবীকে অবাক করে দেয়। আর সে দেশের মধুর বোল আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কার আমাদের বাংলা ভাষা। অতুল প্রসাদ সেনের কথায়- ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।/মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা।/আ মরি বাংলা ভাষা।/মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা॥/কী যাদু বাংলা গানে-গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,/গেয়ে গান নাচে বাউলÑগান গেয়ে ধান কাটে চাষা।/মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা॥’ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি’ গানের সঙ্গে নগ্নপায়ে, স্নিগ্ধচিত্তে, হাতে ফুল, বুকে ভালবাসা নিয়ে স্মৃতির শহীদ মিনার; যুগে যুগে স্মৃতিরা ডানা ঝাপটায় এই সুরের ঐকতানে। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দী, মালয়, ইংরেজী, ফরাসী, সুইডিশ, জাপানীসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। গানটির সুরেই যেন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাইয়ের রক্তে রাঙা রাজপথ আর ছেলেহারা মায়ের অশ্রুভেজা নয়ন। সেই ভুলতে না পারার কাব্যে আরও কতশত গান রচিত হয়েছে ভাষার আবেগে। যুগ যুগ ধরে বাঙালীর হৃদয়ে ভাষা আন্দোলন আর একুশের চেতনাকে জাগ্রত করে রেখেছে একুশের গান। অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী ভাষার জন্য গান রচনা করেন- ‘শোনেন হুজুর-/বাঘের জাত- এই বাঙালীরা-/জান দিতে ডরায় না তারা,/তাদের দাবি বাংলা ভাষা/আদায় করে নেবে তাই।’ তিনি পরবর্তীকালে আরও গান রচনা করেন। যার পটভূমি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। দুটি গানের কয়েকটি চরণ- ১. ‘বাংলার বুকের রক্তে রাঙানো আটই ফাল্গুন/ভুলতে কী পারি শিমুলে পলাশে হেরি লালে লাল খুন।’ ২. ‘বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা যখন একই নামের সুতোয় বাঁধা’। একুশে ফেব্রুয়ারির নৃশংস ঘটনায় গর্জে ওঠে ভাষা সংগ্রামী গাজীউল হকের (১৯২৯-২০০৯) লেখনী। প্রথমে অবশ্য কবিতা হিসেবেই তিনি লেখেন- ‘ভুলবো না ভুলবো না/ভুলবো না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি/ভুলবো না/লাঠি-গুলি আর টিয়ার গ্যাস/মিলিটারি আর মিলিটারি/ভুলবো না।/রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই/এই দাবিতে ধর্মঘট/বরকত- সালামের/খুনে লাল ঢাকার রাজপথ।’ একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একাধিক ভাষাসংগ্রামী তাঁদের একুশের স্মৃতিচারণামূলক রচনায় গাজীউল হকের গানটিকে একুশের প্রথম গান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৫৩-৫৫ সালে এই গানটি গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো। গাজীউল হকের আরও একুশের গানের চরণ- ১. ‘শহীদ তোমায় মনে পড়ে, তোমায় মনে পড়ে।/তোমার কান্না তোমার হাসি আমার চোখে ঝরে।’ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হন। সে সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যালে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিক্যালের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠে। পরে কয়েকদিনে তিনি সম্পূর্ণ গানটি লেখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে সঙ্কলনে’ও এটি প্রকাশিত হয়- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কী ভুলিতে পারি।’ এতে প্রথমে সুর দিয়েছিলেন গীতিকার-সুরকার ও শিল্পী আবদুল লতিফ (১৯২৭-২০০৫)। পরবর্তী সময় এতে সুর যোজনা করেন আরেক মহৎ সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। গানটির করুণ বিষণ্ণ সুর প্রতিটি হৃদয়কে স্পর্শ করে। শোকবিহ্বল করে তোলে শ্রোতার হৃদয়। কথা ও সুরের এমন শৈল্পিক সুষমা এ গানকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গানে উন্নীত করেছে। পরে প্রভাতফেরির অনিবার্য গান হয়ে ওঠে এটি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একুশে নিয়ে আরও কয়েকটি গান রয়েছে। গানের কয়েকটি চরণ- ১. ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা/ফাল্গুন আজ চিত্ত আত্মভোলা/আমি কী ভুলিতে পারি/একুশে ফেব্রুয়ারি।’ ‘শহীদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া/দ্যাখো বাংলার হৃদয় এখন শহীদ মিনারে ভরা।/এত রক্তের প্রাণকল্লোল সাগরে দেবেই ধরা।’ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এবং খ্যাতনামা গীতিকার এবং সুরকার আব্দুল লতিফ একুশের গানের সুর তার জীবনে নিয়ে আসে বেশকিছু কালজয়ী গান। মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা, বাঙালীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তার গান- ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।/ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়।/ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় ফজল-এ-খোদার রচিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম/সকল শহীদ স্মরণে,/আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/তাদের স্মৃতির চরণে।/মায়ের ভাষায় কথা বলাতে/স্বাধীন আশায় পথ চলাতে/হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ/সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান/তাদের বিজয় মরণে’ গানটিতে সুরারোপ করেন শিল্পী আব্দুল জব্বার। এই গানটি আজও শ্রোতাদের হৃদয় সিক্ত করে চলেছে। শহীদ স্মরণে এ গানের আবেদন কখনও ম্লান হওয়ার নয়। একুশের অনেক গানে সুরারোপ করেছেন আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, মোমিনুল হক, নিজামউল হক, সমর দাস, সত্য সাহা, সাধন সরকার, আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, শেখ লুৎফর রহমান, খোন্দকার নূরুল আলম, অজিত রায়, লোকমান হোসেন ফকির, আবদুল জব্বার, খান আতাউর রহমান, প্রশান্ত ইন্দু, রমেশ শীল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবিয়াল ফণী বড়–য়া, আবেদ হোসেন খান, দেবু ভট্টাচার্য, বশির আহমেদ, রাম গোপাল মোহান্ত, সুখেন্দু চক্রবর্তী, হরলাল রায়, আলাউদ্দীন আলী প্রমুখ। তাছাড়া একুশের কবি, গীতিকার ও সুরকারদের নামের তালিকা এত বিশাল যে, তা আমার এই স্বল্প জ্ঞানে হয়ত সম্পন্ন করা সহজসাধ্য নয়। তবে এ কথা বলতে পারি, লেখার সংখ্যা নয়, তাদের প্রত্যেকের লেখনী বাঙালীকে দেশমাতৃকার ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ করেছে বলেই এ ভূখ-ে বাঙালীর যা কিছু অর্জন তার পুরোটারই পশ্চাদভূমি হিসেবে রয়েছে অমর একুশের অনন্য ভূমিকা। একুশ বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তাদের ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করেছে। যার ফলে একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। অমর একুশের ষাট বছরের অধিক সময় অতিক্রান্ত হলেও আজ পর্যন্ত একুশের গানের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য কোন সংগ্রহ বা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়নি। যার ফলে একুশের গানের অধিকাংশই এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে, পত্র-পত্রিকা ও সঙ্কলনের পাতায়। গানগুলো সংগ্রহের বিষয়ে উদ্যোগী না হলে অনেক গানই হারিয়ে যাবে কালের অতলে। এসব গানের সিংহভাগই রেডিওকেন্দ্রিক। ফেব্রুয়ারি এলেই এসব গান আমরা শুনতে পাই। বাংলাদেশ টেলিভিশনের পাশাপাশি বেসরকারী চ্যানেলগুলোও এই গানগুলোর প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে একুশের গানগুলো নবোদ্যমে প্রাণ ফিরে পাবে- এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের। লেখক : সাংবাদিক
×