ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কানাডার বেগমপাড়া, মানববন্ধন এবং দেশের ভাবমূর্তি

প্রকাশিত: ০৮:০৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কানাডার বেগমপাড়া, মানববন্ধন এবং দেশের ভাবমূর্তি

কানাডার বাংলাদেশীদের বেগমপাড়ার কথা সকলেরই কমবেশি জানা। তবে বেগমপাড়া নিয়ে সম্প্রতি টরনটো এবং বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বেগমপাড়ার কিছু মানুষের অর্থের দাপট দেখানো এবং এখানকার সাধারণ বাংলাদেশীদের প্রতি এক ধরনের উষ্মা প্রকাশ বা তাদের অবজ্ঞা করার প্রবণতাই এর মূল কারণ। এক সময় এই বেগমপাড়ার সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল। এখন এদের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ থেকে অসংখ্য ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী এখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার নিয়ে এসে প্রাসাদসমান বাড়ি কিনে এবং ব্যয়বহুল গাড়ি হাঁকিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। কথিত আছে সেসব ধনাঢ্য ব্যক্তির বেগমরাই তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে থাকেন আর দেশেই থাকেন সাহেবরা। এ কারণেই তাদেরকে বেগমপাড়া বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবশ্য এখন অনেক সাহেবও এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছেন। বেগমপাড়ার সাহেবদের কোন প্রকার কাজকর্ম না করে এমন বিলাসবহুল জীবনযাপন করা এবং চলনবলনে অর্থের বাহাদুরি দেখানোর কারণেই বিষয়টি সকলের দৃষ্টিতে এসেছে এবং এর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। বেগমপাড়ার লোকেরা বৈধ অর্থ, না অবৈধ অর্থ; নাকি ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে সেই অর্থ এখানে নিয়ে এসেছেন, সেটি অবশ্যই প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমাদের মতো অতি সাধারণের এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে এটি অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তারা বৈধই হোক আর অবৈধই হোক, সেই অর্থ অবৈধ পন্থায় এখানে নিয়ে এসেছেন। অবশ্য তাদের কেউ যদি এই অর্থ বাংলাদেশের বাইরে উপার্জন করে থাকেন, তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা, বাংলাদেশে প্রচলিত ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি বছরে বৈধভাবে মাত্র তিন হাজার ডলারের বেশি দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারেন না। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বেগমপাড়ার লোকেরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার এখানে নিয়ে এলো কিভাবে? যদি ধরে নেয়া যায় যে, তারা সিঙ্গাপুর, হংকং বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন মানিচেঞ্জারের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে এই অর্থ কানাডায় নিয়ে এসেছে, তাহলেও তো কথা থেকে যায় যে, তারা সেই অর্থ অবৈধ পন্থায় দেশ থেকে এক্সচেঞ্জ হাউসে প্রেরণ করেছেন। অর্থাৎ, কানাডায় বৈধ চ্যানেলে অর্থ আনলেও, সেই লেনদেনের সূত্রটা অবৈধ। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কোন লেনদেনের শুরুটাই নির্ধারণ করে লেনদেনের প্রকৃতি কেমন হবে। অর্থাৎ, লেনদেনের সূত্রটা যদি অবৈধ হয়, তাহলে এই অর্থের দ্বারা সংঘটিত পরবর্তী সব লেনদেনই অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে, কানাডার মতো দেশে যেখানে কঠোর মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বলবত আছে, সেখানে এত অবৈধ অর্থ আসে কিভাবে। এটি আমার কাছেও এক বড় রহস্য। তবে কানাডা এমন একটি দেশ যেখানে নাগরিক দায়িত্বকে (সিটিজেন রেসপনসিবিলিটি) অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এখানে প্রত্যেক নাগরিক বা অভিবাসী প্রচলিত নিয়ম ও বিধিবিধান যথাযথভাবে মেনে চলবে, সেটাই সকলের বিশ্বাস। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা প্রতিটা বিষয় খতিয়ে দেখে না। তবে যখন তারা দেখার প্রয়োজন মনে করবে, তখন তারা সেটি ঠিকমতই দেখবে এবং আইন অমান্যকারীকে চরম শাস্তিই পেতে হবে। কোন অর্থ এবং কোন কানেকশনই তখন কাজে আসবে না। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো বাংলাদেশের এক কুখ্যাত সন্ত্রাসী, যে বাংলাদেশ ও কলকাতার পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কানাডায় এসে জেঁকে বসেছিল। এখানে ভাল অর্থ বিত্তের মালিকও হয়েছিল। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে ভালভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছিল এবং অভিবাসী মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগও ছিল। সম্প্রতি তার আসল পরিচিতি প্রকাশ পাওয়ায় এখানকার পুলিশ তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। আর এতেই অবস্থা বেগতিক দেখে সেই সন্ত্রাসী দ্রুত দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে। তাই বেগমপাড়ার বড়লোকেরা কানাডার মতো নিরাপদ দেশে এসে যতই নিশ্চিত থাকার চেষ্টা করুক না কেন, সেটা সবসময় নাও হতে পারে। তারা নিরাপদে ও নিশ্চিতে তখনই থাকবেন যখন তারা সবকিছু এখানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন করবেন। বেগমপাড়ার যে সকল ব্যক্তি এদেশে অর্থ এনে তা দিয়ে অট্টালিকাসমান বাড়ি কিনেছেন বা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন তাদের একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছে এবং সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, সমুদয় অর্থ তার নিজের ও পরিবারের বৈধ উপার্জন, যার ওপর উপযুক্ত হারে কর প্রদান করা হয়েছে। এই ধরনের ঘোষণাপত্রে যদি কোনরকম মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি মিথ্যা ঘোষণাকারী (মিসরিপ্রেজেনটেশন) হিসেবে অভিযুক্ত হবেন এবং তার সমুদয় সম্পত্তি বাজেয়াফত হয়ে যেতে পারে। এরকম মিথ্যা ঘোষণার কারণে সম্পত্তি বাজেয়াফত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার নজিরও এদেশে অনেক আছে। কয়েক বছর আগে লিবিয়ার গাদ্দাফির অনেক আত্মীয়স্বজন এভাবে কানাডায় এসে বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছিল। পরবর্তীতে সে সকল সম্পত্তি বাজেয়াফতের ঘটনা সকলেরই জানা। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বেগমপাড়ার লোকদের বড়লোকি মেজাজে চলাফেরা না করে অতি সাধারণভাবে থেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে সমাজে অবস্থান করে নেয়া উচিত ছিল। তারা প্রথমেই অট্টালিকাসমান বাড়ি না কিনে এই অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে পারতেন। ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করলে কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা যায়। যেগুলো এখানকার জনগণ, সরকার এবং সরকারী সংস্থা কিছুটা সহানুভূতির সঙ্গে দেখে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে এরকম দু-একজনের সঙ্গে আমার আলোচনার সুযোগ হয়েছিল এবং আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, বাড়ির পিছনে এত অর্থ ব্যয় না করে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করছেন না কেন? আমি তাদের এও বলেছিলাম যে আপনারা তিন মিলিয়ন ডলার দিয়ে বাড়ি না কিনলে দশ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা শুরু করতে পারতেন। কেননা, আপনি তিন মিলিয়ন দিলে ব্যাংক আপনাকে আরও সাত মিলিয়ন দিত। তাছাড়া বাংলাদেশী কানাডিয়ান হিসেবে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভাল ব্যবসাবাণিজ্য করা যায়। যাহোক, তারা সেদিকে অগ্রসর না হয়ে অট্টালিকাসমান বাড়ি এবং বিলাসবহুল গাড়ির পথেই অগ্রসর হয়েছেন। কেননা এখানকার বাংলাদেশী সমাজটাও হয়েছে সেরকমই, যেখানে কে কি করে সেটা বড় কথা নয়। কার কত বড় বাড়ি আছে, কে কত দামী গাড়ি চালায়, সেটই বড় কথা এবং সমাজে তাদের সম্মান ও কদর দুটোই বেশি। আর এ কারণেই বেগমপাড়ার লোকজন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মূল্যের বড় বড় বাড়ি কিনে এখানকার বাংলাদেশী অধ্যুষিত সমাজে তাড়াতাড়ি স্থান করে নেয়ার চেষ্টা করেন। সাম্প্রতিক তাদের এই চেষ্টা কিছুটা হিতে বিপরীত হতে শুরু করেছে। এখানকার সাধারণ বাংলাদেশীরা তাদের এমন আচরণ মোটেও সহজভাবে নিতে পারছে না। তারা এই বেগমপাড়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদলে প্রতিবাদও শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু বাংলাদেশী এখানকার বাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় একাধিকবার মানববন্ধনও করেছে। আরও মানববন্ধনসহ অন্যান্য প্রতিবাদ জানানো অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ থেকে আগত বেগমপাড়ার বড়লোক মানুষের বিরুদ্ধে এখানকার সাধারণ বাংলাদেশীদের মনের অবস্থা আমরা ভালভাবেই বুঝতে পারি। আবার এটাও ঠিক যে, কানাডা কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের মতো মানববন্ধন বা প্রতিবাদ জানানোর স্থান নয়। এখানে জনগণ মত প্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা করে থাকে। কিন্তু রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা বা প্রতিবাদ জানানোকে কোন অবস্থাতেই ভালভাবে দেখে না। কিছুদিন আগে এখানকার সরকার তালেবান সন্ত্রাসী ওমর খাদিরকে দশ মিলিয়ন ডলার দিয়ে তার দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি করেছে। বিষয়টি এখানকার কেউই ভালভাবে নেয়নি। তথাপি কেউ কোনরকম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ বা মানববন্ধন করেনি। এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা কঠোর হাতেই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কারও কাছে যদি সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকে তাহলে সে সেগুলো দিয়ে অনায়াসে এখাকার আরসিএমপি, কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি বা ফিনট্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের নজরে আনতে পারে। তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। আর এরকম উদ্যোগ নাগরিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেটি না করে মানববন্ধন বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলে বেগমপাড়ার লোকদের খুব একটা কিছু হবে বলে মনে হয় না। উল্টো সমগ্র দেশের ভাবমূর্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। কেননা, খারাপ কোনকিছু এখানকার কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তারা তো শুধু বেগমপাড়ার জন্য পৃথক কোন সিদ্ধান্ত নেবে না। দেখা যাবে বাংলাদেশীদের জন্যই তারা একটা বিরূপ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে বা কোন রেডফ্ল্যাগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর ফলে সকলেই নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হবে। শ্রীলঙ্কা থেকে একটি জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মানুষ এদেশে এসে এখানকার জনগণ ও সরকারের যথেষ্ট সহানুভূতির দৃষ্টিতে ছিল। এই সহানুভূতির সুযোগ নিয়ে তারা একদিন রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে তাদের ওপর থেকে সহানুভূতির দৃষ্টি মুহূর্তের মধ্যে চলে যায়। তাই হুজুগের বশবর্তী হয়ে কোন পদক্ষেপ কখনই গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ, এর সামগ্রিক ফলাফল মোটেই ভাল হয় না। তাছাড়া, বেগমপাড়ার যেসব বড়লোক অর্থের দাপট দেখিয়ে চলে তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করলে বা তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চললেই কোন সমস্যা থাকে না। আমি নিজে যেমন বেগমপাড়ার লোকদের সঙ্গে কোন পরিচয় রাখি না। তাদের কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি না এবং তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলি। সুতরাং আমার কোন সমস্যা হয় না। আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, এখানকার মূলধারার সমাজে এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। চাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য এবং স্থানীয় রাজনীতি- কোথাওই উল্লেখ করার মতো কোন স্থানে আমরা নেই। এরমধ্যে নতুন করে বৈরী অবস্থার সৃষ্টি করাও কল্যাণকর হবে না কারও জন্য। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×