ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

শেখ মুজিব ॥ বাঙালীর ভাষারাষ্ট্রের পিতা

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  শেখ মুজিব ॥ বাঙালীর ভাষারাষ্ট্রের পিতা

॥ চার ॥ বন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে আটকাদেশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। খুলনার ডিআইবি ১১ জুন ১৯৫১ তারিখের স্মারকপত্রের সঙ্গে নং ১৭৩৪/৩৮-৫১ তে এ ধরনের একটি তালিকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আইবিকে প্রদান করার জন্য প্রস্তুত করেছিল। পাকিস্তানী শাসকবর্গের নির্দেশে এজেন্সির লোকজন সদা-সর্বদা তার প্রতি লক্ষ্য রাখত। শুধু তাই নয় কোন ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হতো তাও নিচের তালিকা থেকে স্পষ্ট। The Following original Government Orders and grounds of detention served on security prisoner sk. Mujibur Rahman are enclosed 1. G. O. No 756 H. S dated 7.3.5.1 (Release order) 2. G. O. No 2667 H.S dated 25.10.50 ( Detention Order with G.D) 3. G. O. No 2143 H.S dated 19.9.50 (do) 4. G. O. No 881 H.S dated 16-3-50 (do) 5. G. O. No 147 H.S dated 28.1.50 (do) (26) F/N-606-48.PF.Part-3) ১৯৫১ সালের ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আদেশ প্রদান করা হলেও তা কার্যকর হয় ১৪ তারিখের একদিনের জন্য। অর্থাৎ তাকে জেলে ধরে রাখা শাসকবর্গের নিকট অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে সরকারী নথিতে লেখা হয় : On 14th March Sk. Mujibur Rahman (para 216) (AML- son of lutfur Rahman of tangipara Gopalganj) was released on bail from Gopalganj court. He was taken out in a procession by some students and a meeting was held. Mujibur Rahman address the meeting criticizing government for gaoling Maulana Bhasani and others without trial and urging the students to unite. Mujibur Rahman was arrested the same day u/s 18 (1) Bengal special powers ordinance as enacted and continued in operation by act of 1951. Hortal was observed the next day at Gopalganj Bazaar on the initiative of the local students who took out a procession (150) and shouted slogans condemning unjustified detention, urging release of Mujibur Rahman. demanding Bengali to be the state language and denouncing oppression perpetrated by French government in Morocco. The procesionists also held a meeting and adopted a resolution to fight for the release of Sk. Mujibur Rahman.(27) F/N-606/48(PF).Part-3 উপরের স্ফীতাক্ষর বাক্যগুলোর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে শেখ মুজিবের বাংলা ভাষার জন্য বলিষ্ঠ দাবি এবং পৃথিবীর অন্য দেশে সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর সমর্থনের কথা। গোপালগঞ্জ কোর্ট এলাকায় সমবেত এক ছাত্র সভায় শেখ মুজিব সকলকে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল নিম্নরূপ : The subject addressed the gathering of the students near Gopalganj Court urging them to unite and fight against the present Government and alleging that he was detained so long, only because he Pressed the government, to concede to the legitimate demands of the peasants and labourers. In the evening of 14.3.51 at 17-30 hrs the subject was arrested u/s 18 (1) of The B.S.P.O as enacted and continued in Operation by the East Bengal act I of 1951 and… no accommodation in Gopalganj sub-Jail he was forwarded to Faridpur Jail on 17.3.51 (28) (Ref: 28.351, DIG, I-B.রিপোর্ট, F/N-606-48PF.Part-4) জেলে অবস্থানকালে শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে সোহরাওয়ার্দীর লাহোরের ঠিকানায় যে চিঠি লিখেছিলেন সেই চিঠি সম্বন্ধে পুলিশ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। কারাভোগ যেমন শেখ মুজিবের জীবনের একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় ছিল, তেমনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পত্র লেখাও তাঁর নিয়মিত কাজ ছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী জেলে গিয়েও শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে আসতেন, তাঁর কুশল বার্তা নিতেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে গভীরভাবে স্নেহ করতেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ববঙ্গে এসে শেখ মুজিবের মামলা পরিচালনা করেছেন। তিনি তাঁর ডায়রিতে উল্লেখ করেছেন যে, He was my star organizer|। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন তার The Making of the Prime Minister গ্রন্থে এই অভূতপূর্ব উক্তির উল্লেখ করেছেন। জেলের অভ্যন্তরে বন্দী অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দায়ের করা হয়। সরকারী নথিতে লেখা হয় : Sk. Mujibur Rahman of Faridpur. He is a joint secretary of the party is now detained as security prisoner in D.C jail, is an active member with Militant Outlook, was convicted in a case u/s 147 P.P.C on 12.9.50 and sentenced to R.I. for 3 months, and then specific case u/s 143/1888 PPC is pending against him in Faridpur.(29) (Ref: PPS. 254, 246-245 of 613-50,Extract from Awami Muslim League Organization in East Bengal. অপরদিকে ঐ সময় তাঁর বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ কোর্টে ১৪৭ ধারা মোতাবেক পাকিস্তান পেনাল কোডে মামলাটি দায়েরকৃত বিচারাধীন ছিল। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে পূর্ববাংলার স্বরাষ্ট্র (জেল) বিভাগ থেকে নম্বর 2153/I-H-ইস্যুকৃত আদেশে বলা হয় : He is requested tp arrange the transfer of prisoner sk. Mujibur Rahman from the Faridpur Jail to the Khulna pending the trail of the case against him under section 147 PPC in the court at Gopalgonj. সরকারের জরুরী আদেশ মোতাবেক (৪ জানুয়ারি ১৯৫১) Inspector General of prisons তাঁর অফিসের memo No 15-con-14151 -তে লিখেছেন : Copy forwarded for information and necessary action to the supdt, Faridpur Jail. The prisoner should at once be transferred to Khulna Jail. The date of transfer of the security prisoner should be reported to this office atonce. এই নির্দেশের ভিক্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর থেকে খুলনার জেলে স্থানান্তর সম্পর্কে লেখা হয় : I beg to report that being directed I escorted Security Prisoner Sk. Mujibur Rahman from Faridpur jail to Khulna Jail and made over the said security prisoner to Jail authority on 13.1-51. (30) (Ref: Copy of report dated 13.1.51 of AS.I. Mir Afsaruddin of Faridpur DIB to the supdt of Police, DIB. Khulna. F/N. 606-48 PF. Part-3) শেখ মুজিবকে হয়রানি করতে সরকার সবসময়ই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। শেখ মুজিব এমনই এক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন যাকে এভাবে নিরস্ত করার পদক্ষেপই সরকার নেয়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তাঁর ওপর প্রচন্ড এক মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব হয়রানিমূলক গ্রেফতার, জেলগেটে গ্রেফতার, নতুন নতুন মামলায় গ্রেফতার- এসবই এক ধরনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। একই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের থেকে তাঁর মুক্তি ও পুনরায় গ্রেফতার করার আদেশও লক্ষ্য করা যায়। লক্ষণীয় যে, একই দিন 7th March 1951, Dacca, No- 756,H-S সংখ্যক স্মারক মারফত শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে দেওয়া সরকারী নির্দেশ ছিল : আশ্চর্যের বিষয় এই আদেশের কপি বিলি করা হলেও Deputy Director, Intelligence Bureau, Government of Pakistan, 8, Kumartali Lane, Dacca, কে নিম্নলিখিত আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবকে পুনরায় ১৮ ধারায় গ্রেফতার করা হোক। (৪০) (Ref:F/N-606-48, PF-Part-3) রেডিও গ্রামের ভাষ্য এ কথাই প্রমাণ করে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সরকারের মনে সবসময়ই ভয়ের উদ্রেক করতো। শেখ মুজিবকে বন্দী না করা পর্যন্ত পুলিশ বিভাগের ঘুম হারাম হয়ে যেত। এ কারণে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিশ্চিত হতো যে, শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা স্বস্তি পেত না। (৪১) (প্রাগুক্ত) পুলিশ বিভাগ, কারা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য এজেন্সি শেখ মুজিবের গ্রেফতার, পুনরায় গ্রেফতার ইত্যাদি কাজ নিয়ে যে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকত তা উপরের রিপোর্ট থেকে বুঝা যায়। (Ref: F/N-606-48,PF-Part-3) ১৪ মার্চ ১৯৫৪ সালে ফরিদপুর পুলিশ সুপার SDPO গোপালগঞ্জ Dintell জেলা Dacca and Supdt, Police DIB Khulna কে-লেখা Radiogram দ্বারা শেখ মুজিবকে গ্রহণ ও গ্রেফতার করার কথা জানানো হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন তারিখে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার, জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তর ইত্যাদি কাজ এত ঘন ঘন করার মূল লক্ষ্যই ছিল তার মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব কখনোই ভেঙে পড়েননি। (প্রাগুক্ত)। শেখ মুজিবকে নিয়ে জেলের অভ্যন্তরে এ ধরনের আদেশ-নির্দেশ জারি, চালাচালি দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। খুলনা পুলিশ সুপার ডিআইবি ১৪-৩-৫১ তারিখ এসব সরকারী আদেশ নির্দেশের সার-সংক্ষেপ করেছেন নি¤েœাক্তভাবে। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে তাঁকে জড়ানোর চক্রান্ত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই করা হয়েছে। যে কোন উপায়ে তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংহার করতে বদ্ধপরিকর ছিল পাকিস্তানী শাসকচক্র। শেখ মুজিবের গ্রেফতার এবং মুক্তি নিয়ে জেলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন তৎপরতা চলতে থাকে। ১৬-৩-৫১ তারিখে তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে আসা হয় এবং এই খবর জানাজানি হয়ে যায়। ২৪-৩-৫১ তারিখ পুলিশের ডিআইবি ফরিদপুর যে রিপোর্ট লিখেন তাতে জানানো হয় যে, ১৬ মার্চ যে কয়েক ঘণ্টার জন্য শেখ মুজিব মুক্তি পান সেই সময়ে তিনি আগত ছাত্রদের মিছিলে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন, মাওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করায় সরকারের তিনি সমালোচনা করেন। পরের দিন গোপালগঞ্জ বাজারে হরতাল পালিত হয়। ছাত্ররা স্লোগান দেয় : ‘মুজিবের মুক্তি চাই- বেআইনী আটক চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, মরক্কোতে ফরাসীর অত্যাচার বন্ধ চাই’ ইত্যাদি। ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা জেলের অভ্যন্তরে থাকতেও দেখা যায়- তাঁর মতো অসম সাহসী অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে থাকা মানুষ আর কাউকেই তো দেখা যায় না। ফরিদপুর জেলে ২২ মে পুনরায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাতকার নিতে আসে গোয়েন্দা পুলিশ। রিপোর্টে লেখা হয় : সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিত শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কিত তথ্যের বিবরণী তৈরি করে সরকারের উর্ধতন মহলে প্রেরণ করত। সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেছিলেন যে, যদি শেখ মুজিবের মতো তার পাঁচজন মানুষ থাকত, তাহলে গোটা দেশই তার সঙ্গে থাকত। ঢাকা ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক [email protected], www.bijoyekushe.net.bd, www.bijoydigital.com
×