ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী আরেফ

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী আরেফ

আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদের ২১তম হত্যা দিবস। ১৯৯৯ সালের এই দিনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ চলাকালে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন বাঙালী জাতিসত্তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৬০ সাল থেকেই আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি যুক্ত হন। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার আগে তিনি পুরান ঢাকার স্থানীয় তরুণদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলা করেন। তিনি ভূগোল বিষয়ে বিএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছাত্রলীগ করার জন্যই নিয়মিত টিউশনি করতেন। কখনও হেঁটে, কখনও বাসে চড়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে সংগঠিত করতেন। ১৯৬০ সালে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে, সিরাজুল আলম খান ও মরহুম আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিন সদস্যের নিউক্লিয়াস গঠন করেন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে। এই নিউক্লিয়াস ১৯৬২ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর আস্থাশীল ছাত্রলীগের মাধ্যমে। নিজেকে সব সময় আড়ালে রেখে ছাত্রলীগের সব কর্মকান্ডে ও নিউক্লিয়াসকে দেশব্যাপী বিস্তৃত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন, জয় বাংলা বাহিনী গঠন, বাংলাদেশের পতাকা নির্ধারণ, মুক্তিযুদ্ধের আগে যেসব স্লোগান জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে তা সবই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কর্মকান্ড হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। কাজী আরেফ আহমেদ মুজিব বাহিনীর অন্যতম একজন রাজনৈতিক প্রশিক্ষক ও মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতাউত্তরকালে ছাত্রলীগের বিভক্তির পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত দৈনিক গণকণ্ঠের কার্যকরী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জাসদ গঠিত গণবাহিনীর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হলে বাংলাদেশের রাজনীতি ’৭১-এর পরাজিত শক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। সেই সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতাসীন পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আপোসহীনভাবে এগিয়ে যান। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে, আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে নেত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রেখে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি বারবার কারাবরণ করেন ও নির্যাতিত হন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন ও আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। কাজী আরেফের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই আমি ছাত্রলীগের কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। তৎপরবর্তীকালে ’৯০-এর গণআন্দোলন ও ’৯২-এর গণআদালত সফল করতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলাম। কাজী আরেফ আহমেদ সব সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু আজকে সেই সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের বিরোধিতা করেছেন তাদের অনেকেই আজকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রবক্তা। কাজী আরেফ যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন তা আজকের বিরাজিত অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কাজী আরেফ হত্যার বিচার হয়েছে, কিন্তু হত্যার নীল নক্সা যারা করেছেন তাদেরকে চিহ্নিত করা জরুরী। কাজী আরেফের মতো নেতা বারবার জন্মায় না। তিনি নেই, রেখে গেছেন তার অসমাপ্ত সংগ্রামী জীবন, আজ কাজী আরেফ বেঁচে থাকলে সাম্প্রদায়িক শক্তির এই পুনঃউত্থান প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে দুর্বলতাগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। রোহিঙ্গা সমস্যা, ভারতের এনআরসি সমস্যা, সামজিক অবক্ষয়, বিদেশে টাকা পাচারসহ বিরাজিত সমস্যাগুলো নিয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্যে আসার উদ্যোগ নিতেন। তাই আজকের এই প্রেক্ষাপটে কাজী আরেফের মতো একজন বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আপোসহীন নেতার খুব প্রয়োজন ছিল। কাজী আরেফের হত্যাদিনে তার প্রতি বিল্পবী শ্রদ্ধা ও রক্তিম অভিবাদন। লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা
×