ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তি, ভালবাসা ও মায়ার সঙ্কট

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 প্রযুক্তি, ভালবাসা ও মায়ার সঙ্কট

আমার বন্ধু হারুন-অর-রশীদ একজন নাট্যকর্মী হিসেবে সুবিদিত। মঞ্চ ও পর্দায় সুললিত অভিনয়, নাটক রচনা, নির্দেশনা, পরিচালনা, সর্বোপরি কন্টেন্ট গবেষণায় এক ঈর্ষণীয় মেধার অধিকারী হারুনের আরও অনেক পরিচয় আছে, যা আলোচনা করে আমরা বন্ধুরা গর্ববোধ করি। হারুন সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র, ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতা পড়েছেন ও পড়াতে পারেন, উন্নয়ন কন্টেন্ট বোঝেন ও বোঝাতে পারেন, এসব পেশাদারী গুণাবলী ছাড়াও আরও একটি মানবিক পরিচয় তুলে ধরতে আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। পেশায় পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা হয়েও হারুন-অর-রশীদ আমাদের কালের একজন দায়িত্ববান, সংবেদনশীল নিঃস্বার্থ মানুষ। সেই হারুন সাম্প্রতিক এক আড্ডায় আমাকে একটি বিস্ময়ের জিজ্ঞাসায় ফেলেছে- ‘আমাদের কালের ভালবাসা কি মায়ার সঙ্কটে পড়েছে সেলিম ভাই’? আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে এই প্রশ্ন অবিরত নয়, কিন্তু ঘরে ঘরে এই চিন্তা অবশ্যম্ভাবী। ইতোমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাবনা শক্তি আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। তার সবটুকু আমরা ব্যবহার করতে পারি বা না পারি, কিন্তু আমাদের মানবসমাজের মায়ার যে মানসশক্তি তার সঙ্গে কি কোন বিরোধ এসে পড়েছে? না হলে এই যে একাকীত্বের দর্শন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমাদের কপালে গেড়ে বসেছে, তা কি অবশ্যম্ভাবী ছিল? যদি পুরো ভারতবর্ষের কথা বাদ দিয়ে বাঙালীর জীবনচর্যা বা সংস্কৃতির কথাই বলি আমাদের পারিবারিক নিউক্লিয়াসে এসে ওই ব্যক্তির অধিকার চিন্তা কি আমাদের সামষ্টিক চিন্তাকে বাধা দিয়ে বসল না? আমরা কখন থেকে স্বার্থপর হয়েছি এই নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা নেই বটে, কিন্তু আমাদের বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না যে, আমরা ঘরে-বাইরে, সমাজে, কাজে, পথে-ঘাটে, এমনকি চিন্তায়ও স্বার্থপর হয়ে গেছি। আমাদের বিবেকের স্বাধীনতার নামে আমরা চিন্তাকে একপেশে করে সমাজ সংসারে বুদ্ধিহীন, দায়হীন এক নৈরাজ্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করছি। এমন হবার কথা ছিল না। হারুনের কষ্ট ওখানেই, আমারও। ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্যতম চ্যালেঞ্জ এখন সমাজে এর প্রভাব। কিন্তু তার আগে যদি আমরা আমাদের কাজগুলো ভাল করে বিবেচনা করি তাহলে উদ্দেশ্য থেকে আমাদের গন্তব্য কতদূর পৌঁছেছে তার একটা মূল্যায়ন পাব। এখন শুধু ই-মেইল, ইন্টারনেট সংযোগের ওপর কেউ বসে নেই। তথ্যপ্রযুক্তির উপযোগিতা নিয়ে সবাই হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ বিশেষ করে ফেসবুক। আমাদের দৈনন্দিন মনোসংযোগে ভূতের মতো চেপে বসেছে এক রিয়েল টাইমের দৈত্য, যে মানুষকে নড়তেও দিচ্ছে না, নিজেও নড়ছে না। পুরো সমাজটাকে সে ইন্টারনেটের সুযোগে নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে। ফলে এক নৈরাজ্যের ভার্চুয়াল জগতে বসবাসের যে স্বপ্নচিন্তা আমাদের গ্রাস করেছে সেখানে মানবিক ভালবাসার স্থান কোথায়? ফেসবুক এখন নিউজ দেয় আবার তথ্যও দেয়। কিন্তু তা কি ভুল না সঠিক তা যাচাইয়ের কোন উপায় নেই, যতক্ষণ না আর একজন একটা তথ্য দেবেন। কিন্তু যাচাই করবে কে? কে সত্য বলেছে, কে মিথ্যা বলেছে তা জানার উপায় নেই। ফলে ভার্চুয়াল চর্চা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এনে দিয়েছে পরচর্চা, পরনিন্দা, অহিতকর এক স্বপ্নহীন মিথ্যার কথামালা। যা শুধু ‘কথার কথা’– একে প্রযুক্তির ভাষায় ‘ফিল্টার’ করে নেয়ার কথা আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুদ্ধির স্বার্থচিন্তার যুদ্ধে আমরা হেরে যাচ্ছি, পেরে উঠছি না। আগের এক লেখায় লিখেছিলাম, আমরা ডিজিটাল যুগের ভয়াবহ আসক্তির মধ্যে ঢুকে পড়েছি, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ‘ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের’ বাইরের এক অচিন্ত্যনীয় সামাজিক ও পারিবারিক বিচ্ছিন্ন-সংস্কৃতির মধ্যে মানব সমাজকে ফেলে দিয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের অনাদিকালের যে আন্তঃসম্পর্ক তা বৃন্তচ্যুত হয়ে রক্তচক্ষুর পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক হয়েছে আলগা বাঁধনের, এমনকি স্বার্থের, যা হিসাবের খাতায় ‘ইজা’ রেখে প্রতিটি দিন শুরু করতে হচ্ছে। এই সুখ কি মানুষ চেয়েছিল? ডিজিটাল জগতে ভালবাসার সম্পর্ক হয়েছে বিভূতিকেন্দ্রিক, ‘তোমার মনে কি আছে তা আমার জানা দরকার নেই, আমার শুধু জানতে হবে তুমি কতক্ষণ আছ।’ আর সেভাবে জগত সংসারের অধিকার পরিকল্পনা হচ্ছে। দহন বলে এখন কোন শব্দ প্রেমের জগতে নেই। সেখানে ঠাঁই নিয়েছে সম্পদের অহঙ্কার, ধাতব সৌকর্যÑ যা নির্ধারণ করে দেয় প্রযুক্তির বেঁধে দেয়া সময়। মানুষের পেশা এখন পুরোপুরিই ডিভাইসনির্ভর। ফলে ভাবতে হচ্ছে আমাদের গন্তব্য কতটা সঠিক। হারুনের মতে, একদিন আমাদের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল ঘর থেকে। ঘর থেকে টোল, পাঠশালা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে আমরা এখন জ্ঞান সমাজে প্রবেশ করেছি। কিন্তু শিক্ষাচর্চার পথে পথে গত কয়েক শ’ বছরে আমরা আমাদের অর্জনের ইতিহাসে নিজেদের সম্পৃক্ত করে রাখতে পারিনি। হারুন বলছে, ‘প্রলোভন আমাদের ক্রমাগত ভালবাসাহীন করেছে সেলিম ভাই, এখন যা দেখি সবই মায়া। বাড়িতে একটি বিড়াল পুষলেও তো মায়া হয়। কিন্তু ভালবাসা না থাকলে সে প্রাণীর প্রতি আমাদের কর্তব্য পালন কেমন করে হবে?’ আমাদের সমাজজীবনের এই দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী ছিল না। যারা বলেন কালের বিবর্তন, তারা বাংলার মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ শিক্ষার ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করেন বা নিজেদের অজ্ঞতা থেকে এমন কথা বলেন। প্রযুক্তি আমাদের উন্নত করবে শিক্ষায়, মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায়, সমাজ গঠনে, এমনকি জাতি গঠনেও, কিন্তু নিশ্চয়ই আমরা এমন কামনা করি না যে, সে আমাদের শিক্ষা থেকে আলাদা করে অশিক্ষায় ফেলবে। আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করে সমাজে-সংসারে-পরিজনে স্বতন্ত্র মানুষের স্বার্থ সত্তা আবিষ্কারে মত্ত করবে। জাতিগত ও রাজনৈতিক বিভেদ, এমনকি হত্যালীলায় পরিণত করবে। হারুনের মতে, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের মন জয় করেছিলেন ভালবাসা দিয়েই। না হলে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নচিন্তা ছিল নিখুঁত ও বিস্ময়কর’। যে কোন ইতিহাসের ছাত্র হারুন রশীদের এই বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন। আমিও মনে করি, বঙ্গবন্ধু যদি নিখাঁদ ভালবাসার বন্ধনে বাঙালীকে বেঁধে নিতে না পারতেন তাহলে সাধারণ কৃষক সমাজ জমিজমা, ঘরবাড়ি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে কেন? হারুন বলেন, ‘এই ভারতবর্ষেই এমন সমাজ আছে ভাইয়ের হত্যার বদলা নিতে মা ছেলের হাতে অস্ত্র তুলে দেন। আর আমাদের বাঙালী মায়েরা বলেন, একজন গেছে যাক, তুই বাড়ি থাক। আর সেই মা-ই চোখের পানি আড়াল করে হাসিমুখে ছেলেকে পাঠালেন একাত্তরের যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর এই ভালবাসার বাংলাই আমার আপনার সম্পদ, যাকে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আগলে রেখেছেন। এই দু’জনের ভালবাসার শক্তিকে যদি আমরা অনুধাবন না করি তাহলে দুর্ভাগ্য কখনই আমাদের ছাড়বে না।’ যখন বাড়ি ফিরে আসি হারুনের এই কথাগুলো সারাপথ আমাকে এক প্রকার আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু তার মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ সাংস্কৃতিককর্মী, যে কিনা সরকারী পদ-পদবীতে বসেও তার সাংস্কৃতিক চরিত্রকে সামান্য বিসর্জন দিতে পারেনি, তার মতো এমন হারুন রশীদ আমাদের আরও প্রয়োজন হবে। আমি নিশ্চিত, প্রযুক্তি হোক, কালের তথাকথিত বিবর্তন হোক আর আমাদের স্বপ্নচিন্তায় যতই ঘোর অমনিশা আসুক, বঙ্গবন্ধুর মতো করে যদি দেশটাকে আমরা ভালবাসতে পারি, তাহলে বাধা-বিঘ্নের উল্টোরথে আমাদের চলার পথ কিছুতেই থেমে যাবে না। শুধু আমাদের বুঝবার দরকার, সেই ভালবাসা কি ও কেমন করে গড়ে ওঠে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×