ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাঙ্গাইলে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে’ আগ্রহী হচ্ছে কৃষকরা

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

টাঙ্গাইলে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে’ আগ্রহী হচ্ছে কৃষকরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ দেশে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে নগরায়ন ও শিল্পায়ন। শ্রমিকরা বেশি টাকায় কাজ করছে নির্মাণ শিল্পসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে। এ কারণে দেশের কৃষি সেক্টরে প্রতি বছর শ্রমিক সংকট দেখা দিচ্ছে। ধান রোপন ও কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। শ্রমিক সংকটের কারণে অনেক সময় কৃষকের ধান মাঠেই পড়ে থাকে। এ সংকট থেকে দেশের কৃষি সেক্টরকে বাঁচানোর জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে খামার যান্ত্রিকীকরণ। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আয়োজন করে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ নামের যন্ত্রের প্রদর্শনী ও মাঠ দিবসের। প্রদশর্নীর মাধ্যমে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ এর সুফল ও সুবিধা সম্পর্কে কৃষকদের অবগত করা হয়। প্লান্টার দিয়ে ধানের চারা রোপন করে এর সুফল সম্পর্কে কৃষকদের অবগত করে তাদেরকে যন্ত্রটি ব্যবহারে উৎসাহী করা হচ্ছে। কৃষকরাও আগ্রহভরে যন্ত্রটির ভালোমন্দ পর্যবেক্ষন করছেন। তারা এ যন্ত্রটি ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। শ্রমিক নয়, কৃষিবান্ধব যন্ত্র ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ দিয়ে রোপন করা হবে ধানের চারা। এতে সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থের। যন্ত্রটি টাঙ্গাইলের কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করতে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সম্প্রতি জেলার ধনবাড়ী উপজেলায় কৃষকদের কাছে মেশিনটি পরিচিত করতে অনুষ্ঠিত হয় প্রদশর্নী ও মাঠ দিবস। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক প্রধান অতিথি থেকে যন্ত্রটির উদ্বোধন করেন। এই যন্ত্র দিয়ে একসাথে ৬ লাইনে ধানের চারা রোপন করা যায়। যন্ত্রটি একসাথে ১২টি ট্রে বহন করে চালাতে পারে। সনাতন পদ্ধতিতে এক বিঘা জমিতে ধানের চারা রোপন করতে কমপক্ষে চারজন শ্রমিককে কাজ করতে হয়। এতে করে কৃষকদের অধিক মুজুরী গুনতে হয়। যন্ত্র দিয়ে এক ঘন্টায় ০.৩৫ হেক্টর জমির ধান রোপন করা যায়। জ্বালানি খরচ ঘণ্টায় সাতশ’ গ্রাম। প্রতি হেক্টর জমিতে ২০ জন শ্রমিকের সাশ্রয় হয়। এ যন্ত্র দিয়ে ধানের চারা রোপন করলে কৃষকের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। ধানের চারা রোপনে যন্ত্রটি ব্যবহার করলে রোপন খরচ ৫০-৭৫ ভাগ কমানো সম্ভব হবে। এছাড়া রাইস ট্রান্সপ্লান্টার দিয়ে চারা রোপন করলে লাইন সোজা হয়। ফলে পরবর্তীতে আগাছা নিংড়ানো, সার ও কীটনাশক ছিটানো ও ধান কাটা সহজ হয়। স্থানীয় কৃষক গোলাম সরোয়ার বলেন, কম খরচ ধান রোপন করে কৃষকরা আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী এবং লাভবান হবে। একটি জমিতে ধানের চারা রোপন করলে শ্রমিকের খরচ যদি ৬শ’ টাকা হয়, সেখানে এই মেশিং দিয়ে যদি ধান রোপন করি তাহলে খরচ হবে দেড়শ’ টাকা। এই জন্যই এই মেশিং আমাদের জন্য সুবিধাজনক। অল্প খরচেই ধান আবাদ করা যাবে। ধনবাড়ির পাইস্কা গ্রামের কৃষক হযরত আলী বলেন, এ বছর ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিকের ব্যাপক সংকট পড়েছিল। আমার দুই বিঘা জমির ধান রোপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত যে খরচ হয়েছিল বিক্রি করে অনেক লোকসান হয়েছে। এই মেশিনের সাহায্যে চারা রোপন করে ধান কাটতে পারলে কৃষক অনেক লাভবান হবে। তবে মেশিনটির দাম অনেক বেশি। স্থানীয় আরেক কৃষক বলেন, আগে আমাদের অনেক কষ্ট করে ক্ষেত্রে ধান লাগানো ও ধান কাটানো হতো। এমনকি ধান রোপনের জন্য গরু-মহিষ দিয়ে ধান আবাদের জন্য জমি তৈরি করা হতো। সরকার থেকে কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রীককরণ করায় কৃষকদের জন্য খুব সহজ হয়েছে। এতে আমরা উপকৃতও হচ্ছি। এতে আমাদের কামলার খরচ কম হবে। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে একাধিক চালক বলেন, এই মেশিং নিয়ে ৫০ ডিসিমাল ধানের চারা রোপন করতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা। আর এতে প্রতি ডিসিমালে তেল খরচ হয় ১০ থেকে ১২ মিলিমিটার। অল্প সময়েই মধ্যেই একটি ক্ষেত্রের ধানের চারা রোপন করা যাবে। এতে কৃষদের ৮০ ভাগ খরচ কমে যাবে। যদি ৩৩ ডেসিমালে শ্রমিক দিয়ে ধানের চারা রোপন করানো হয় তাহলে প্রায় ১ হাজার টাকা খরচ হবে। আর যদি রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চারা রোপন করা হয়, তাহলে মাত্র ২শ’ টাকা খরচ হবে। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শ্রমিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ধান আবাদ করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে সরকার কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। মেশিনের মাধ্যমে ধান রোপন ও মাড়াই হলে কৃষকরা অনেক লাভবান হবে। মেশিন ক্রয়ে সরকার কৃষকদের আর্থিক সহায়তা করছে। এছাড়াও রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের দাম কয়েক লাখ টাকা। তাই প্রান্তিক সকল কৃষকের পক্ষে তা ক্রয় করা সম্ভব না। তবে সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে সামর্থ্যবান কৃষকরা তা ক্রয় করতে আগ্রহী হবেন। এতে অন্য কৃষকরা তা ভাড়া নিয়ে তাদের ক্ষেতের ধানের চারা রোপন করতে পারবেন। মূলত পরীক্ষামূলকভাবে এটির কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রজেক্ট আকারে এর কার্যক্রম শুরু হবে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই ১ বিঘা জমির ধান রোপন করা যাবে। এ ব্যপারে কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি বলেন, বর্তমানে ফসল উৎপাদন করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে না। এর মূল কারণ হলো শ্রমিকের দাম অনেক বেড়ে গেছে। চারা লাগানো ও কাটার মৌসুমে শ্রমিকের মুজুরী অনেক বেশী হয়। একজন শ্রমিক যে ধান কাটে তাতে কৃষকের লাভ হয় না। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষিতে ধান লাগানো ও কাটা দুটোই মেশিনে করা হবে। সরকার ওইসব যন্ত্রে অর্ধেক ভর্তুকি দিবে। এছাড়াও উপকুল ও হাওড় অঞ্চলে তিনভাগের দুই ভাগ ভর্তুকি দিবে সরকার। এই বছর যন্ত্র কেনার জন্য কৃষকদের চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হবে। কৃষি বিভাগের মাধ্যমে ইতিমধ্যে সারাদেশে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ এর ব্যবহার সুফল সম্পর্কে কৃষককদের অবহিত করা ও যন্ত্রটি ক্রয় করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
×