ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

বাকশাল ॥ দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রয়াস

প্রকাশিত: ১০:৪২, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাকশাল ॥ দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রয়াস

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। বাকশাল গঠিত হলে স্বইচ্ছায় তার নতুন দলে যোগদান করা শুরু করে অনেকে। যারা তার আদর্শের অনুসারী ছিলেন, পাশাপাশি বিশ্বাসঘাতকরাও যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশায় ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন করেন। এতে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল একীভূত হয়েছিল। বাকশাল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে যাতে প্রত্যেক মানুষের কাছে অন্ন পৌঁছে, কেউ অপুুষ্টিতে না ভোগে, দারিদ্র্যের চরম অভিঘাত থেকে মুক্তি পায়, মানুষের উন্নয়নে যেন সর্বাত্মক নিয়োজিত হওয়া যায়। বাকশাল গঠনের মৌল উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছিল তিনটি স্তম্ভের ওপরÑ প্রশাসনিক, আইন প্রণয়নকারী এবং আইন ব্যবস্থা রায়দানকারী। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধন করার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ থেকে শোষকদের হটাতে চেয়েছিলেন তিনি। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষদের জীবনে সোনার বাংলা অর্জনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা বস্তুত ছিল মানুষের দুঃখ মোচনের মৌল উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সূচিত। অর্থনৈতিক মুক্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার মৌল উৎসধারা। দেশের দায়িত্বভার আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের পর থেকেই তিনি কিভাবে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার করা যায়, সে জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন। দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনাকে প্রতিহত করতে চেয়েছেন। যে সমস্ত অবকাঠামো পাকিস্তানী বাহিনী ও তার স্থানীয় দোসর আলবদর-আলশামস ও রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধকালীন ধ্বংস করে দিয়েছিল, যুদ্ধকালীন যে সমস্ত অস্ত্র সামগ্রী ছিল, তার অনেকাংশই পুনরুদ্ধার করা দুঃসাধ্য ছিল। তার পরও তিনি সমস্যা সমাধানের তরে নিবেদিত ছিলেন। পাশাপাশি বহুমাত্রিক দলে কিছু কায়েমি স্বার্থবাদী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ছিল, অতি বাম গ্রুপ ছিল, যারা রাজাকার ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। অতি ডান গ্রুপও সেদিন ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে ঘৃতাহুতি দেয়। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সম্পূর্ণ দেশের অবকাঠামো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গবাদিপশু, চাষাবাদের সাজসরঞ্জাম, শিল্প-কল-কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ওই সময়ে বিভিন্ন শিল্প-কল-কারখানার মালিকদের ৯৮% ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। ফলে জাতীয়করণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য যে সমস্ত সম্পদের প্রয়োজন ছিল তা ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানীরা। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত, ভাঙ্গাচোরা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ২% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যবস্থা করেন, যা সে সময়ে চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩%। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেদিন দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল’ গঠন করেছিলেন। এটি আসলে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার চেয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য যাতে পরিবর্তিত হয়, সে উদ্দেশ্য নিয়েই রচিত হয়েছিল। আশা করেছিলেন, ‘বাকশাল’-এর মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অর্থনেতিক উন্নয়ন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা যায়, জনসংখ্যার ঊর্ধগতি রোধ করা যায়, সামাজিক অসাম্য দূর করা যায়। সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে। মানুষের ভাগ্য ফেরানোর জন্যই ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সূচনা। ‘বাকশাল’ সাময়িক পদ্ধতি ছিল নাকি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ ছিলÑ এ বিতর্কে না গেলেও এটা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু শিল্পায়ন, কৃষি উন্নয়নের যে উদ্যোগ বাকশালের মধ্যে প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছিলেন, তা মূলত মেইজী শাসকেরা ১৮৬৮ থেকে ১৯১২ সালের দিকে যেভাবে জাপানকে শিল্পায়নে সহায়তা করেছিলেন তার মতো। বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় উক্তি স্মরণ করছিÑ ‘এই দেশ হিন্দুর না, এই দেশ মুসলমানের না। এই দেশকে যে নিজের বলে ভাববে এই দেশ তার। এই দেশের কল্যাণ দেখে যার মন আনন্দে ভরে উঠবে এই দেশ তার। এই দেশের দুঃখে যে কাঁদবে এই দেশ তার এবং এই দেশ তাদের যারা এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।’ বস্তুত বঙ্গবন্ধুর অমোঘ উক্তি এখনও প্রযোজ্য। একটি শ্রেণী ভোগ-বিলাস-ব্যসনে ব্যাপৃত। তারা নিজেদের এদেশকে মাতৃভূমি বলে মনে করে না, বরং বিদেশকে সেকেন্ড হোম বিবেচনা করে ভিন্ন দেশে পরিবার পরিজনসহ স্থানান্তর করতে সচেষ্ট রয়েছে। পুঁজি পাচার করে থাকে নিয়মিত। এরা এক বিশেষ ধরনের প্রজাতি, যারা মাতৃভূমিকে ভালবাসে না। দেশের সাধারণ মানুষকে নীচু চোখে দেখে থাকে। এরা শিক্ষার নামে বড়াই করে অথচ এরা দেশপ্রেমহীন। ॥ ২ ॥ বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠন এদেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা-হতাশা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বিবেচিত করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পুরো পাকিস্তানী সময়কাল ও তৎপূর্ব সময়কালে এদেশের মানুষ বার বার বিদেশীদের দ্বারা নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়েছেন। বাঙালীরা সব সময়ই সাহসী জাতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাদের সাহসের জন্য পূর্বপুরুষরা, যারা গঙ্গা উপত্যকায় বসবাস করতেন, তাদের গঙ্গাঋদ্ধি বলে অভিহিত করা হতো। কিন্তু বাঙালী জাতির মধ্যে ঐক্যের দারুণ অভাব ছিল। এ কারণেই বহিঃশক্তি সুযোগ গ্রহণ করে শাসন করত। পাল, সেন, মুসলিম, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী আমলেও রক্তশোষক ভ্যাম্পেয়রা এদেশ শাসন করেছে। জাতির পিতা এমন একটি পরিবেশে শাসনভার গ্রহণ করলেন, যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে উন্নীত করে একটি সুসংবদ্ধ কাঠামো প্রদান করা; ত্রিশ লাখ মানব-মানবীর হত্যাযজ্ঞ এবং কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, একটি অরাজক অবস্থা পাকিস্তানী ও তাদের তাঁবেদাররা দেশে রেখে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জনকল্যাণকামী আমলাতন্ত্রের অভাব ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে যারা মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল, তাদের পুনর্বাসন করা ছিল কষ্টসাধ্য; একেবারে ভৌত অবকাঠামো ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চিমারা ভেঙ্গে দিয়েছিল। দেশের বর্ণাঢ্য ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজকে পশ্চিমা শয়তান ও তাদের স্থানীয় দোসররা ধ্বংস করে দিয়েছিল। কল-কারাখানার মূল মালিকরা পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভবসহ চলে গিয়েছিল। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় যুদ্ধকালীন কেবল এদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করেননি, তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রয়াসও গ্রহণ করতে হয়েছিল। চীন সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল। তবে বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে মুক্তিযোদ্ধাদের এক মাসের মধ্যেই অস্ত্র সমর্পণে সম্মত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার দু’মাসের মধ্যেই মিত্রবাহিনী অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের দেশে ফিরে গিয়ে অনন্য নিদর্শন রেখে যায়। তিনি দক্ষতার সঙ্গে এক বছরের মধ্যে সংবিধান রচনা করেন। ১৯৭৩ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং পরবর্তী বছর স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন করেন। ভেঙ্গে পড়া প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো আবার গড়ে তুলতে প্রয়াস গ্রহণ করেন। মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ অর্জনের জন্য তিনি বিশেষ ব্যবস্থা নেন। বস্তুত বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের অগ্রগতি-প্রগতি এবং শীর্ষ অবস্থান তৈরি করার যে নিরলস পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তাতে সর্বাগ্রে বাঙালীর উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং তাদের মধ্যে যাতে অসাম্য না থাকে সেটি সুনিশ্চিত করতে চেয়েছেন। বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের ভাষায়, বঙ্গবন্ধু বহুমাত্রিকভাবে সুদক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে দেশের মানুষের আত্মমর্যাদা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। জানি না, কেন আজ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বকে উন্নয়নের ধাবমান গতিতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকা-ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে না। এ সমস্ত ব্যক্তি তাদের নির্লোভ মন-মানসিকতা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা গুণ এবং জনকল্যাণমুখী কর্মকা- দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর হাতকে আরও শক্তিশালী ও বেগবান করতে সক্ষম হতেন বলে বিশ্বাস করি। ‘বাকশাল’ ব্যবস্থাটি নিয়ে তৎকালে গুপ্ত শত্রুরা নানামুখী গুজব রটিয়েছে। ষড়যন্ত্র করেছে। অথচ এটি ছিল ট্রানজিশন পিরিয়ডে মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রয়াস। সারা জীবন বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের সময়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরত গেলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তবে দুর্বল, অদক্ষ আমলাতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ঘরশত্রু বিভীষণদের জন্য তিনি যেভাবে তার সময়ের তুলনায় এক শ’ বছর এগিয়ে চিন্তা করতেন, সেটি বাস্তবায়নে সমস্যা দেখা দেয়। কালোবাজারি, মুনাফাখোর এবং ব্রিফকেস ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি রাজাকার-সর্বহারারা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু কায়েমি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী নানা অপপ্রচার তার উন্নয়ন কর্মকা-ের গতি কেবল শ্লথ করেনি, বরং পেছনের দিকে টেনে ধরতে চেয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু মনে করেছিলেন, সবাই যদি একত্রে বাকশালের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবে অংশ নেয় তবে রাষ্ট্র সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু সব সময়ে সাম্যের ওপর জোর দিয়েছেন। শোষণ থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচার কথা বলেছেন। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি কমিউনিস্ট নন, কিন্তু তিনি সমাজতন্ত্রী। তিনি পুঁজিবাদী নন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পুঁজিবাদ শোষণের হাতিয়ার। তিনি আরও মনে করতেন যে, সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদ মানুষকে শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আজকের মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পুঁজি চলে যাচ্ছে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাংলাদেশ ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে পুঁজি পাচার করে শহরে নিয়ে এসে ঋণ খেলাপীদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘এক দেশ, এক নেতা, এক জাতি- সকলের লক্ষ্য থাকবে দেশের উন্নয়ন’Ñ এই মহামন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে সে সময়ের অবস্থান থেকে তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গঠনের জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর এ প্রয়াস সঠিকভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ পেলে অনেক আগেই বাংলাদেশের জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যেত। কিন্তু কুচক্রী মহল মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নির্মমভাবে তাঁর মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে সপরিবারে হত্যা করে। মোশতাকের মতো বিশ্বাসঘাতক, জিয়ার মতো নিমক হারাম, মাহবুব আলম চাষীর মতো লোকেরা জুলিয়াস সিজারের মতো ব্রুটাসের চরিত্রে লিপ্ত হয়েছিল। দুঃখজনক যে, যারা সেদিন মিথ্যার বেসাতি গড়েছিল, সময়ের বিবর্তনে তাদের কাউকে কাউকে বড় বড় পদমর্যাদা হাঁকাতে দেখা গেছে পরবর্তীতে। আজ যে উন্নয়নের সূচনা হয়েছে সেটি ধরে রাখতে হলে প্রকৃত বঙ্গবন্ধু প্রেমিক এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গ দরকার। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভালভাবে শাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। আবদুল জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজরা বিপ্লবীপন্থী সমাজতন্ত্র কায়েমের পক্ষে ছিল, যার জন্য তারা জাসদ তৈরি করেছিল। এ সময়ে ঘাপটি মারা কিছু দুর্বৃত্ত লুকিয়ে থেকে দেশবিরোধী পঞ্চম শক্তি হিসেবে কাজ করতে থাকে। সর্বহারাদের দৌরাত্ম্য এ সময়ে চরমে ওঠে। শ্রমজীবী মানুষ যাতে শ্রমের মূল্য পায়, প্রতিটি মানুষ যাতে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সুযোগ পায়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এ সময়ে সরকার মুনাফাখোর ও লুটেরাদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনসমর্থন আকাশচুম্বী থাকায় লন্ডনভিত্তিক দি উইকলি স্পেকটেটর লিখেছিল যে, একমাত্র বঙ্গবন্ধুই পারেন বাংলাদেশকে বাঁচাতে। এ কঠিন কাজটি করতে গেলে তাকে অবশ্যই দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। অর্থনেতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে বঙ্গবন্ধু বদ্ধপরিকর ছিলেন। কিন্তু গুপ্তঘাতকরা তলে তলে এত বেশি মাত্রায় কানামাছির মতো চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের প্রপঞ্চ হঠকারিতায় বাঙালী জীবনের পরবর্তী একুশ বছর আঁধারে ছেয়ে গেল। কখনও কোন মানুষকে উপরে তুলে মিথ্যা প্রশংসা দিয়ে ভাসিয়ে রাখলে পেছনে দিয়ে গাছ কাটার মতো কেটে ফেলা সহজ হয়। ’৮৪-৮৫ সালের দিকে আমি যখন ছাত্রলীগের কর্মী এবং চট্টগ্রাম বেতারের সংবাদ পাঠক ছিলাম, সে সময়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে এসেছিলেন রেডিও বাংলাদেশের উপমহাপরিচালক (বার্তা) আমজাদ হোসেন। আমজাদ বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার পর ১৯৭৫ সালের এক দিনের ৭টার সংবাদের সময় ঢাকার বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর একজন সহকর্মী হাসতে হাসতে রেডিও থেকে বের হলেন। বললেন, আজকে শেখ সাহেবকে দিয়েছি। বুঝতে না পেরে উনি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন। বললেন, দশ মিনিটের মধ্যে সাড়ে আট মিনিটই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে খবর দিয়েছি। তিনি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলে, ওই সহকর্মী তাকে বললেন, আরে বুঝলেন নাÑ দশ মিনিটের মধ্যে সাড়ে আট মিনিট থাকলে পাবলিক ক্ষেপে যাবে। কি দুরভিসন্ধিমূলক প্রচার। ভাবতে অবাক লাগে, সে সময়ে গোয়েন্দা সংস্থা কোন খবরই তাঁকে দেয়নি। আমার সমস্ত শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল। আমি বললাম, কেন প্রতিবাদ করলেন না? তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন সত্যিকার সরকারী আমলার মতো। আমি প্রতিবাদে তাঁর প্রশিক্ষণ কক্ষ ত্যাগ করে চলে এলাম। মনে মনে বললাম, কত স্তরে, কত ভাবে বাঙালীর মুক্তির দিশারীকে মানুষের মনে বিষিয়ে দিতে চেয়েছিল। যুগে যুগে মীরজাফর, ঘসেটি বেগম, রায় দুর্লভ, জগৎ শেঠদের অভাব হয়নি। বর্তমানেও এমন ধারাটি সুযোগ সন্ধানীরা বহাল রেখেছেন কিনা, কে জানে! গণবাহিনীর নৃশংসতার কথা সে সময়ে সবাই জানত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেদিন যদি প্রতিবাদ করতে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামত, একটি করেও ঢিল ছুড়ত তবে কুচক্রীদের সাহস হতো না এমনটি করার। বরং তাদের সেদিনই সলিল সমাধি হতো। চারজন জাতীয় নেতা ছাড়া অধিকাংশই সেদিন গড্ডলিকায় ভাসছিল। দু-তিনজন প্রতিবাদ করে ভারতে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুসারে, বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে। এদিকে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে উদ্যোক্তা অর্থনীতির ছাত্রছাত্রীদের জন্য শতবর্ষে তারুণ্যের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়েছে। যারা লুটেরা, তদ্বিরকারী, স্বজনপ্রীতি করে থাকে তারা কখনও জাতির পিতার আদর্শ ধারণ করতে পারে না। সে যুগের জন্য বাকশাল ছিল একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ যা প্রতিটি মানুষকে সুখী করে তুলতে পারত। লেখক : ম্যাক্রোঁ ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও প্রফেসর Pipulbd(@gmil.com
×