ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

মেননের হুঁশিয়ারি ॥ সরকার অবহিত হোন

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

মেননের হুঁশিয়ারি ॥ সরকার অবহিত হোন

ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। বহুকাল পর তার মুখে কিছু সত্য কথা শুনলাম। জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষাণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় তিনি সরকারকে সতর্ক করে এমন কিছু কথা বলেছেন, যা এই মুহূর্তে বলা দরকার ছিল। শেখ হাসিনার এবারের মন্ত্রিসভায় মেনন অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় মনে দুঃখ পেয়েছিলাম। এখন মনে হয় তার মন্ত্রী না হওয়াটাই ভাল হয়েছে। সময়মতো জাতীয় সংসদে সত্য কথা বলার জন্য তার মতো দু’একজন সদস্য থাকা প্রয়োজন। মন্ত্রিত্ব সম্ভবত কুলুপ এঁটে দিয়েছিল রাশেদ খান মেননের মুখে। সেই কুলুপটা এখন সরে গেছে। তিনি মন্ত্রী নন, কিন্তু মুক্ত মানুষ। দলের ও তত্ত্বের ডগমা মুক্ত হয়ে তিনি যদি এখন সত্য কথা বলেন, তা শুধু জনগণকে নয়, সরকারকেও দিশা দেখাবে। সংসদের বক্তৃতায় সরকারকে একটি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছেন মেনন। তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের পাশাপাশি তথাকথিত বামপন্থীরাও ষড়যন্ত্র করছে। ধর্মবাদীরা তো বটেই। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ডান ও তথাকথিত বামও আজ এক হচ্ছে। তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই ডেসপারেট আক্রমণ চালাবে।’ এই বক্তৃতায় মেনন সরকারের বিভিন্ন কাজেরও সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে অমুসলিম বাঙালী লেখকদের লেখা তুলে দিয়ে বাংলা শিক্ষার মান নামিয়ে আনার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের যে সর্বনাশা খেলা চলছে, সে সম্পর্কেও সরকারকে হুঁশিয়ার করেন। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা ঢোকানো সম্পর্কে মেননের বক্তব্য নিয়ে পরে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ইচ্ছে আছে। মুক্তিযুদ্ধের যে লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন, সেই লক্ষ্যকে ব্যর্থ করার জন্য বিএনপি ও জামায়াতীরা তাদের শাসনামলে একেবারে স্কুলের নিম্ন শ্রেণী থেকে পাঠ্য বিষয়ের তথাকথিত ইসলামীকরণ শুরু করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করা হয়। তিনি এককালে বাঘা বাম রাজনীতিক থাকলেও কোমলমতি শিশুদের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের ব্যবস্থাটি কেন বন্ধ করতে পারেননি, তা এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। রাশেদ খান মেনন তখন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি তখন এ ব্যাপারে কি করছিলেন সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে কিছু জানালে ভাল হয়। বর্তমানে নতুন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। তিনি কি এ ব্যাপারে কিছু করার আগ্রহ ও আন্তরিকতা রাখেন? এ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা পরে করার ইচ্ছে রইল। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। মেনন বলেছেন ‘দেশে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের পাশাপাশি তথাকথিত বামপন্থীরাও ষড়যন্ত্র করছে।’ এ কথাটা অবশ্য কোন নতুন কথা নয়। মেননেরা এতদিনে স্বীকার করলেন মাত্র। তবে তার দ্বিতীয় সতর্কবাণীটি গুরুতর। তিনি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই তারা মরিয়া আক্রমণ চালাবে।’ আমাদের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের আর দেরি নেই। সরকারের উচিত মেননের এই সতর্কবাণীকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। আমরা স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বার্ষিকী পালন করব এ বছর ২৬ মার্চ। আগামী বছর (২০২১) আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। অর্থাৎ মাত্র এক বছর সামনে আছে। তার আগেই ডান ও তথাকথিত বাম মিলে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর হামলা চালাবে। এ কথার অর্থ কি হামলাটি আওয়ামী লীগ তথা হাসিনা সরকারের ওপর হবে? গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি একটি বায়বীয় কথা। সুনির্দিষ্ট বস্তুটি হলো আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ এখনও পূর্ণ সফল না হলেও তা প্রতিষ্ঠায় একমাত্র হাসিনা সরকারই ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। ভেতর ও বাইরের প্রবল বিরোধিতা, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির লক্ষ্যে পৌঁছতে এই সরকারই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এজন্য গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আঘাত আসার প্রথম হাতুড়িটা পড়ে আওয়ামী লীগের মাথায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করার চক্রান্ত সফল হয়েছিল। ২০০৪ সালে হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যার চক্রান্ত আংশিক সফল হয়েছিল। ভাগ্যের জোরে শেখ হাসিনাসহ অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েও মারা যাননি। মারা গিয়েছিলেন আওয়ামী মহিলা লীগের নেত্রী আইভি রহমান এবং হাসিনার সভায় আসা আওয়ামী লীগের অসংখ্য কর্মী এবং সাধারণ মানুষ। ২০০১ সালেও হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার চক্রান্তে জোট পাকিয়েছিল ডানপন্থী বিএনপি ও জামায়াত, সাবেক বামপন্থী এবং সুযোগসন্ধানী সুশীল সমাজ, ডান মৌলবাদী ও তথাকথিত বিভিন্ন বাম উপদল। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ্যান মেরির নেতৃত্বে ‘টুয়েসডে’ ক্লাব নামে কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশের কূটনীতিকদের সংঘ। সঙ্গে সাবেক বাম ও বর্তমানে নিরপেক্ষতার মুখোশধারী একটি মিডিয়া গ্রুপ। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পৃষ্ঠপোষকতায় গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশে ডান ও কথাকথিত বামদের চক্রান্তের ঐক্যজোটের চেহারা দেশবাসী ২০০১ সালে দেখেছে। দেখেছে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ড. কামাল হোসেনের সুশীল সমাজ ও সাবেক বামপন্থীদের দ্বারা সম্পাদিত দুই কাগজের দ্বারা সমর্থিত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে উগ্র মৌলবাদ ও সশস্ত্র জেহাদিস্টদের ভয়াবহ উত্থান। ২০০৮ সালে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় না এলে এবং পরবর্তী দুটি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় না থাকলে, দেশের মানুষ হয়তো সুশাসন এখনও পায়নি, কিন্তু ভয়াবহ তালেবানি শাসন থেকে বেঁচে গেছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান তিন দফার শাসনে পূর্ণ সুশাসন আসেনি, পূর্ণ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি একথা সত্য। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকরা গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছে। এগুলোর পুনর্গঠন ও পুর্ননির্মাণ সহজ কাজ নয়। এটা একটা বিপ্লবী সরকারের কাজ। তারা দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অনেক সময় তারাও পারে না। ১৯৪৯ সালে চীনে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শোষণ, শাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার ছিল তাদের। একদলীয় কর্তৃত্ব থাকার পরেও ১৫ বছরের মধ্যে তারা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। এখন কম্যুনিস্ট চীন নামেমাত্র কম্যুনিস্ট। ধনতন্ত্র তাকে গ্রাস করেছে। শোষণ, লুণ্ঠন, হত্যা, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ সমাজে আরও বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ একটি বিপ্লবী দল নয়। একটি গণতান্ত্রিক দল। সমাজ পুনর্গঠনে গণতন্ত্রের ভূমিকা কচ্ছপের মতো মন্থর। বিপ্লবের খরগোসেরা যেখানে অর্ধপথে ঘুমিয়ে পড়ে অথবা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়, সেখানে গণতন্ত্রের কচ্ছপ ধীরগতিতে হলেও নানা বাধা ও উতরাই পেরিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছায়। পৌঁছাতে তার একটু দীর্ঘ সময় লাগে এই যা। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক দল, লক্ষ্যস্থলে তার যাত্রাও কচ্ছপ গতির। তাছাড়া গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের তাপে ও প্রভাবে আওয়ামী লীগও চরিত্র হারিয়েছে। যেমন চরিত্র হারিয়েছে ব্রিটেনের লেবার পার্টি এবং ভারতের কংগ্রেস। আওয়ামী লীগও এখন নব্যধনী ও সুবিধাবাদীদের কবলে। কিন্তু দলটি এখনও গণভিত্তিক এবং দলের নেত্রী শেখ হাসিনা দলের ভেতরের ও বাইরের অপশক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করে কখনও লড়াই, কখনও আপসের পথে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার নিবু নিবু বাতি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এই মুহূর্তে তার বিকল্প কোন গণতান্ত্রিক দল নেই। বিকল্প গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে মোল্লাবাদী শাসন। এ কথা জানার পরও ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের (যে লড়াইয়ের ডাক রাশেদ খান মেনন দিচ্ছেন) বদলে যে বামেরা (মুজাহিদুল ইসলামের কম্যুনিস্ট পার্টিসহ) এই সরকারকে ফ্যাসিস্ট সরকার আখ্যা দিয়ে তাকে উৎখাতের ডাক দিচ্ছেন, তারা তলে তলে যে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দালালি করছেন, এ কথা কি তারা স্বীকার করবেন? এই তথাকথিত বামেরা এ কাজটি করেছিলেন দেশ মাত্র স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেও। আজকের রাশেদ খান মেননও সেদিন চীনপন্থী সেজে বঙ্গবন্ধুর সরকারের উচ্ছেদ চেয়েছেন। পরে পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসুর মতো ভুল বুঝতে পেরে নিজেদের সংশোধন করেছেন। সেদিনও বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ফ্যাসিস্ট সরকার আখ্যা দিয়ে তথাকথিত বামেরা এই সরকারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে সাহায্য জুগিয়েছেন। বিভ্রান্ত বামদের একাধিক গ্রুপ তো দক্ষিণবঙ্গে খুন, লুটপাটের সন্ত্রাস শুরু করেছিল। যে দেশে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রই ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বঙ্গবন্ধু তা প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন শাসন কাঠামো তৈরির লড়াই চালাচ্ছেন, সেই মুহূর্তে সেই সরকারকে উচ্ছেদের চক্রান্তে সাহায্য জুগিয়ে এবং ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে জাসদ (অবিভক্ত) কি অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে? দেশে ২১ বছরের জন্য সামরিক ও সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজত্ব ডেকে এনেছিল। রাশেদ খান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর যে আঘাত আসবে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, সেটা কি ধরনের আঘাত তা ব্যাখ্যা করেননি। ড. কামাল হোসেনের তড়পানি দেখে মনে হয় এই চক্রান্তে মধ্যপন্থী সুশীল সমাজও আছে। চক্রান্তটির চেহারা কি? ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি, না খাল কেটে কুমির আনার তো বিদেশী শক্তির সাহায্যে রক্তপাতহীন সরকার উচ্ছেদÑ যেটাকে বলা হয় শ্বেত ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানে অহরহ যা ঘটতে দেখা যায়। রাশেদ খান মেননকে ধন্যবাদ। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন সরকারের উচিত হবে এই চক্রান্তের রথীদের অনুসন্ধান এবং জনসম্মুখে এনে তাদের মুখোশ খুলে দেয়া। লন্ডন, ১১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০২০।
×