ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কথা পাল্টে যাওয়া গান, বেসুরো গলা ছাপিয়ে উৎসব

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

কথা পাল্টে যাওয়া গান, বেসুরো গলা ছাপিয়ে উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে সবার খুব মাথা ব্যথা। না, তা বলা যাবে না। তবে ভোট চাইতে চাইতে দিনকে রাত আর রাতকে দিন করছেন যারা, তারাও এ শহরেরই বাসিন্দা। এবং সংখ্যায় নেহাত কম নয়। অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন পালা করে রাস্তায় নামছেন। এতবড় রাজধানী শহর। তাতে কী? প্রতিপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে মোটেও সময় লাগছে না। সমর্থকরা প্রার্থীর হয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। ভোট প্রার্থনা করছেন। দোয়া চাইছেন। হ্যান্ডশেক শেষে হাতটি এখন আর পকেটে পুরছেন না। বুকে চেপে ধরতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। আরও কত কী! রাজধানী ঢাকার অলিগলি, ফুটপাথ, রাজপথÑ সবখানেই অভিন্ন ছবি। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যথারীতি সামনের কাতারে আছেন। প্রচার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা। অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ, নানা বয়সীরাও। এমনকি মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মা, বাবা, স্ত্রী, নিকট আত্মীয়, বন্ধু, সুহৃদরা প্রচারে নামতে দ্বিধা করছেন না। নিবিড় পর্যবেক্ষণ বলছে, এসবে রাজনীতি আছে। আরও পরিষ্কার করে বললে, ‘পলিটিক্স’ আছে। আন্তরিক চাওয়া যে আছে। সেটিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ভোটারদের কাছে পৌঁছার আকুতি নিয়ে ছুটছেন প্রার্থী ও সমর্থকরা। প্রচার কাজের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি আনন্দঘন এবং উৎসবমুখর। মাতোয়ারা ঢাকা। বাঙালী এমনিতেই উৎসপ্রিয়। উপলক্ষ পেলেই হাসিরাশি আনন্দে মেতে ওঠে। ভোট এলেও, তা-ই। এ কারণে ‘ভোট উৎসব’ বলে একটি কথা বেশ চালু আছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘিরে সে উৎসবই চলছে এখন। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। ভোটাররা নিজ নিজ এলাকার জন্য মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন। দুই অংশে মেয়র এবং কাউন্সিলর পদে শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ৭৫৮ জন! বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে লড়ছেন কেউ। কেউ স্বতন্ত্র। মেয়র প্রার্থী মোট ১৩জন। বাকিরা কাউন্সিলর হিসেবে লড়ছেন। ওয়ার্ড সংখ্যা ১২৯। প্রচারও ওয়ার্ডভিত্তিক। ফলে যত দুর্গম এলাকাই হোক না কেন, সমর্থকরা সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন। প্রচারে বিবিধ কৌশল গ্রহণ করেছেন প্রার্থী ও তার সমর্থকগোষ্ঠী। সবচেয়ে বেশি কানে আসছে গান। জনপ্রিয় গানের সুরে ভোট প্রার্থনা করতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ের জনপ্রিয় গান খুঁজে নিয়ে মাইকে বাজানো হচ্ছে। প্রথমবার শুনে যে কারও মনে হবে, ভীষণ চেনা। আসলে চেনা শুধু সুরটা, গানের কথা পাল্টে ফেলা হয়েছে। মিউজিক ট্র্যাকের ওপর নতুন করে কথা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সুরে-ছন্দে বলা হচ্ছে, অমুক ভাইকে ভোট দিন। তমুক ভাইয়ের বিকল্প নেই। কাকে ভোট দিলে কী ধরনের সুফল মিলবে, তা-ও গানে গানে দিব্যি বলে দেয়া হচ্ছে। এই যেমন একটি মূল গানে বলা হয়েছে : দে দে পাল তুলে দে/মাঝি হেলা করিস না...। একই সুরে অনেকটা প্যারোডির মতো করে সমর্থক কণ্ঠ গাইছে : দে দে সিল মেরে দে, তোরা দেরি করিস না...। একইভাবে শিল্পী মমতাজের একটি জনপ্রিয় গানের সুর ব্যবহার করে বলা হচ্ছে : শুনেন আমার দাদি গো/ও আমার নানিগো/ও আমার ভাবি গো/শোনেন চাচি খালা/সব মার্কার চাইতে আমার নৌকা মার্কাই ভালা...। বিএনপির প্রার্থীরা গানে গানে ধানের শীষের প্রচার চালাচ্ছেন। একটি গানের কথা এ রকম : সবাই মিলে ভোট দেব ধানের শীষে/ধানের শীষে আছে রক্ত মিশে...। এভাবে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির প্রায় সকল প্রার্থী গানে গানে প্রচার চালাচ্ছেন। নাচও বাদ যাচ্ছে না। কয়েকদিন আগে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে রাস্তার দিকে তাকাতেই চোখ কপালে! একটি চলন্ত ভ্যানের ওপর নৃত্য করতে করতে যাচ্ছেন এক নারীশিল্পী। জায়গায় দাঁড়িয়েই নাচের মুদ্রা প্রদর্শন করছিলেন তিনি। গানের সঙ্গে তার এই নাচ। নাচতে নাচতে নাচতেই প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিলি করছিলেন তিনি। গানের পাশাপাশি সুন্দর ভরাট কণ্ঠও প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক সময় সিনেমার প্রচারে যেসব কণ্ঠ ব্যবহার করা হতো, অনেকটা সে রকম কণ্ঠ ভোটের প্রচারে কাজে লাগানো হচ্ছে। সুলিখিত বক্তব্য কিংবা প্রতিশ্রুতি ধারাভাষ্যের মতো করে পাঠ করছেন তারা। রেকর্ড করা কণ্ঠ মাইকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অলিতে-গলিতে। প্রাচারের সময় বাঁশ, কাঠ, প্লাইউড ইত্যাদি দিয়ে তৈরি নৌকা বা ধানের শীষ বহন করা হচ্ছে। সমর্থকরা একই রকম টি-শার্ট গায়ে দিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। তাদের জামায় নির্বাচনী প্রতীক। কেউ কেউ এই শীতেরকালে খালি গায়ে প্রার্থীর নাম লিখে বের হয়ে পড়ছেন। তবে উৎসবটা বেশি দৃশ্যমান হয় মেয়র প্রার্থীদের উপস্থিতিতে। তাদের উপস্থিতি মিছিলে অন্যরকম আবেগ-উত্তেজনা সৃষ্টি করে। গত কয়েকদিন এ ধরনের বেশ কয়েকটি মিছিল অনুসরণ করে দেখা যায়, হাজার হাজার নেতাকর্মী এতে অংশ নিয়েছেন। সামনের দিকে থাকছে একটি অগ্রবর্তী দল। তার পর পরই মেয়র প্রার্থী। বিশেষ ধরনের গাড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে নাড়তে যাচ্ছেন তারা। পেছনে নেতাকর্মীদের দীর্ঘ লাইন। সামনে-পেছনে একাধিক মাইক বাজছে। বড় বড় সাউন্ডবক্স বহন করা হচ্ছে। সেখান থেকে চলছে স্লোগান। মাইকে গান শুনে, মিছিলের আওয়াজ শুনে বাসার জানালায় উঁকি দিচ্ছে কৌতূহলী চোখ। হাঁটছেন মেয়র প্রার্থীরা। দীর্ঘ পথ হেঁটে চলেছেন। সামনে যাকে পাচ্ছেন জড়িয়ে ধরছেন। খুব বিনয় করে ভোট চাইছেন। চা বানিয়ে পান করানো, ক্রিকেট খেলা ইত্যাদিও দেখা যাচ্ছে। সমর্থকরাও পিছিয়ে নেই। আসা-যাওয়ার পথে প্রার্থীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। হ্যান্ডশেক করছেন। মোবাইলে ছবি তুলছেন। এমনকি একটি স্কুলের বাচ্চাদের ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের সঙ্গে সেলফি তুলতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে অন্যরকম ভোট উৎসব। তবে প্রচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়শই। তখনই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। উচ্চৈঃস্বরে গান বাজানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে কাউন্সিলর প্রার্থীরা পাড়ার মোড়ে মোড়ে অফিস করে সেখানে বিশাল সাউন্ডবক্স বসিয়েছেন। উচ্চৈঃস্বরে গান হচ্ছে। চলছে প্রচার। অনবরত বাজানোর ফলে স্থানীয়রা মারাত্মক সমস্যায় পড়ছেন। জবাবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক কাউন্সিলর বলছিলেন, এটা তো উৎসব। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও গানে গানে প্রচার চালানো হয়। আমি পশ্চিমবঙ্গে গানে গানে ভোটের প্রচার চালাতে দেখেছি। বাবুল সুপ্রিয়র মতো শিল্পীরা গান গেয়ে ভোট চেয়েছেন। মেঘালয়ের বিধানসভা নির্বাচনের সময় তো ভোটারদের ভোটদানে উৎসাহী করতে গানে গানে প্রচার চালায় খোদ নির্বাচন কমিশন। জনপ্রিয় শিল্পী ঊষা উত্থুপকে দিয়ে গান করিয়েছিল তারা। আমাদের এখানেও সব নির্বাচনে এমনটি হয়ে আসছে। তবে বাড়াবাড়ি রকমের প্রচার ঠিক না বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনটা আসলে হাসি-আনন্দে করতে পারলেই ভাল। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অহেতুক বিতর্ক করে কী লাভ? সঙ্গীতের ভাষা অপেক্ষাকৃত মধুর জানিয়ে তিনি বলেন,এ কারণেই গানে গানেও প্রচার সমর্থকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে এটা যেন কিছুতেই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে তিনি তার নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান। সমর্থকদের সরল চাওয়া মেনে নিতে গিয়ে কখনও কখনও প্রচারে ভোটারদের অসুবিধা হচ্ছে জানিয়ে একই দলের আরেক মেয়র প্রার্থী ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ভোটারদের মন জয় করার আন্তরিক চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। এটি করতে গিয়ে কিছু ভুল-ত্রুটিও হয়ত হচ্ছে, আমরা এ জন্য সত্যি দুঃখিত। বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবং ইশরাক হোসেনও সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর প্রচারের অম্লমধুর যন্ত্রণা সহ্য করে নগরবাসী বলছেন, শুধু প্রচারের বেলায় উৎসব- আনন্দ দেখালেই চলবে না, নির্বাচনের দিনও এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। তবেই সার্থক হবে ভোট উৎসব।
×