ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এশিয়ার একমাত্র পানি জাদুঘর ॥ সংরক্ষন করা হয়েছে ৮৭টি নদ-নদীর পানি

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২০

এশিয়ার একমাত্র পানি জাদুঘর ॥ সংরক্ষন করা হয়েছে ৮৭টি নদ-নদীর পানি

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ এশিয়া মহাদেশের একমাত্র পানি জাদুঘরের একটি কক্ষে দাঁড়িয়ে অবলোকন করা যায় আন্তজার্তিক ও বাংলাদেশের ৮৭টি নদ-নদীর পানি। স্বচ্ছ কাচের জারে সংরক্ষন করা হয়েছে এসব পানি। শুধু ৮৭ নদ-নদীর পানি দেখাই নয়; ওইসব নদ-নদীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারনা পাওয়া যাবে পানি জাদুঘর পরিদর্শন করে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের সহায়তায় ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্থাপিত হয়েছে এ “পানি জাদুঘর”। এরপর যতই সময় গড়িয়েছে ততই এ জাদুঘরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ব্যাপ্তি বেড়েছে। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আভাস এর সহযোগিতায় কলাপাড়া উপকূলীয় জনকল্যাণ সমিতি বর্তমানে পানি জাদুঘরটি পরিচালনা করছে। বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশ্ববর্তী পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামে নির্মিত পানি জাদুঘরের সামনে বালুর ওপর স্থাপন করা রয়েছে একটি নৌকা। এতে মানবসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারনে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীতে নৌকা আটকে থাকার বাস্তব ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া বাঁধ তৈরির ফলে শুকিয়ে যাওয়া নদী, প্রাচীণ বাংলার ঐতিহ্য নৌকা শুকিয়ে যাওয়া নদীতে পরে আছে, অর্ধ বালিতে ডুবন্ত নৌকার বুকে বিধে আছে দুটি গজাল মাছ। এর মাধ্যমে নদী ও নদীমাতৃক বাংলাদেশকে খুনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় ৫০০ বর্গফুটের দোতলা টিনের ‘পানি জাদুঘর’র দোতলায় সারি সারি করে সাজানো রয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ও নদী কেন্দ্রীক দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জীবিকা অর্জনের নানা উপকরন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-মাছ শিকারের ঝাঁকি, জাল, খুচনি জাল, নৌকা, চাঁই, পাল্লা, কাঁকড়া শিকারের চাই ইত্যাদি। এছাড়া আহবমান গ্রামবাংলার একসময়ের তাঁত বোনার মেশিন ও কৃষিজমির উৎপাদিত ফসল সংরক্ষনের জন্য মাটির তৈরি হাড়ি, বাঁশের তৈরি ডোলা, মুড়ি ভাজার তলছা এবং ঝাড়রা মাটির তৈরি খাদ্য রান্নার হাঁড়ি, পাতিল, খাবারের থালা, বাসন, পিতলের তৈরি থালা, বাটি, বদনা, মগিসহ নানা উপকরণ। জাদুঘরের দেয়ালে শোভা পেয়েছে দেশীয় খাল ও নদ-নদীর ছবি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জেলে এবং কুমার, তাঁতিসহ সর্বস্তরের মানুষের জীবনধারন ও জীবিকা অর্জনের নানা দৃশ্য। পানি জাদুঘরে রয়েছে বাংলাদেশের সাতশ’টি নদীর ইতহাস, বিভিন্ন নদীর পানি, নদীর ছবি, নদীর পানির ইতিহাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে পরিবেশে উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার চিত্রসহ বিভিন্ন তথ্য। রয়েছে গ্রামবাংলার মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরন, নদী নিয়ে গান, পল্লী শিল্প, কাঁসা ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের সাথে ৫৭টি আর্ন্তজাতিক অভিন্ন নদীর ইতিহাস। নদী মাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত নদীর চিত্র ও তথ্য খুঁজে পেতে পানি জাদুঘরে প্রতিদিন জ্ঞান পিপাসু মানুষের ভীড় থাকে লক্ষ্যনীয়। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের প্রধান অকর্ষন হচ্ছে পানি জাদুঘর। কুয়াকাটার যাত্রাপথে গাড়ি থামিয়ে পর্যটকরা দেখে যান পানি জাদুঘর। সপ্তাহের মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে পানি জাদুঘর। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য ফি নির্ধারন করা হয়েছে মাত্র ১০টাকা। পানি জাদুঘর দর্শনে এসে দর্শনার্থী কাজী আল-আমিন বলেন, যদি এখানে না আসতাম তাহলে নদী কেন্দ্রীক বাংলাদেশের এই চিত্র আমাদের অজানা থেকে যেত। নদী ও নদীর নব্যতা রক্ষায় আজ থেকেই আমাদের সোচ্চার হতে হবে। এখান থেকে সে অনুপ্রেরনা নিয়ে গেলাম। মানুষকে সচেতন করা এবং নদী ও পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলকে আরও শক্তিশালী করতে এশিয়ায় প্রথমবারের মত পানি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করায় এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এবং আভাসকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, পৃথিবীর পাঁচ ভাগের তিন ভাগই পানি। এরমধ্যে মিঠাপানির পরিমান মাত্র তিন থেকে চার শতাংশ। বাকি ৯৬-৯৭ শতাংশ পানি বরফ ও নোনা পানি। বিশ্বের প্রানী ও উদ্ভিদ জগতের সবধরনের কার্যক্রম সচল রাখতে মিঠা পানির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে মিঠা পানির পরিমান বেশি। এ দেশের মিঠা পানির মুল উৎস হলো প্রবাহমান নদ-নদী ও বৃষ্টি। মিঠা পানির প্রায় ৯০ শতাংশই নদীপ্রবাহ কমে যাওয়ায় শুল্ক মৌসুমে আমাদের দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পানি জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, জাদুঘর স্থাপনের পর পর্যটকদের আগমন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগত পর্যটকদের নদ-নদীর সৃষ্টির ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থার বিষয়ে স্পষ্ট ধারনা দেওয়া হয়। এতে পর্যটকদের ভেতর নদী বিষয়ে সচেতনা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিদিন এ জাদুঘর পরিদর্শনে কমপক্ষে এক থেকে দেড় শতাধিক পর্যটক আসে। দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকার পটুয়াখালী জেলার নিজস্ব সংবাদদাতা মোঃ মোখলেসুর রহমান বলেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরায়ত নদীর চিত্র দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা শহর, বন্দর ও গ্রামের দূষিত বর্জ্য ফেলে নদীর পানিকে দূষিত করা হচ্ছে। নদীর নাব্যতা নষ্ট করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্থ করার ফলে নদী দিনে দিনে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। নাব্যতার কারনে হারিয়েছে আমাদের গর্বের অনেক নদী। হারিয়ে গেছে নদী কেন্দ্রীক মাছ, গাছ, ফুল ও ফসল। মানুষের নদী কেন্দ্রীক জীবন-জীবিকা দিন দিন ব্যহত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নগর উন্নয়নের জন্য। কৃষি নির্ভর এই দেশে নদী হল অপার আর্শিবাদ। অথচ সেই নদী ও নদীর পানিকে রক্ষায় নেই তেমন কোন উদ্যোগ। তাই নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় সরকার ও নীতিনির্ধারকদের আরও উদ্যোগী, মানুষকে সচেতন করা এবং নদী ও পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলকে আরও শক্তিশালী করতে এশিয়ায় প্রথমবারের মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পানি জাদুঘর। তিনি আরও বলেন, আমাদের পটুয়াখালীর অনেক নদীতে আগে মিঠা পানি ছিলো। এখন অধিকাংশ নদীতে লবণ পানি। এখন আর পানি দিয়ে কৃষিকাজ করা যায় না, পরিবারের কাজে ব্যবহার করা যায়না। মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আমরা এটা চাইনা। পানি জাদুঘরে আমাদের কথা বলা হয়েছে। আমাদের জীবন, সংগ্রাম, পরিবর্তন ও প্রভাবের কথা রয়েছে এ জাদুঘরে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, পানির যে জাদুঘর হতে পারে, তা শুনে আমি বিস্মিত। এখানে এসে বুঝলাম আমরা আমাদের নদী ও পানি সাথে যুক্ত উপকরণগুলোকে জাদুঘরে পাঠানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছি। যেটা খুবই অনাকাঙ্খিত। আমাদের মাছ হারিয়ে গেছে, নদীতে মাছ নেই। ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। এগুলো বাঁচাতেই এই পানি জাদুঘর। বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও নদীকে বাঁচাতে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন সংগঠন ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা ঘোষণায় এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে পানি জাদুঘরে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় সাতশ’ নদী আছে। একশ’ বছর আগেও এর সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। নদীর সংখ্যা কমে যাওয়ার সাথে সাথে নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যেরও পরিবর্তন হয়েছে। বাঁধ, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ূ পরিবর্তনসহ নানাকারনে মানুষের জীবন-জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব পরছে। উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে আমাদের দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আবার সুন্দরবনে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি ঘটছে। আমরা লবনাক্ততার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জানি। পানি জাদুঘর দেখভালের দায়িত্বে থাকা এনজিও আভাসের নির্বাহী পরিচালক রহিমা সুলতানা কাজল বলেন, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নানাকারণে নদী মরে গেছে ও মরে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে দিনকে দিন। ফলে নদী পাড়ের মানুষের জীবন জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব পরছে। আমরা চাই নদীকে নদীর মতো বাঁচতে দিতে। পানি সম্পদ রক্ষায় তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আর সেজন্য আমাদেরই সচেতন হতে হবে। সে কারণেই এই পানি জাদুঘর। তিনি আরও বলেন, পানি জাদুঘরে মূলত এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। নদীর কথা, পানির কথাকে উপজীব্য করে এই পানি জাদুঘর। এই জাদুঘর মানুষকে, সরকারকে ও নতুন প্রজন্মকে সচেতন করবে। পানি জাদুঘরে রয়েছে বিভিন্ন গবেষণার বই, নদী ও পানির সাথে সম্পকৃত জীবন নিয়ে তৈরি গল্প চিত্র। এক কথায় এই জাদুঘরে আসলে একজন মানুষ বাংলাদেশের নদী, পানি, নদী পাড়ের মানুষের জীবন, জীবিকা, ইতিহাস ঐতিহ্য সব জানতে পারবেন। তিনি বলেন, এই পানি জাদুঘরটি সরকার নিজস্ব উদ্যোগে কুয়াকাটায় স্থানান্তর করলে দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশি-বিদেশী সর্বস্তরের মানুষ নদী সর্ম্পকে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
×